শৈল্পিক সুরনির্ঝরে সুন্দরের আরাধনা

687

অলোকসামান্য ঋষি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে কালের পর কাল আমাদের যাপিত জীবনের প্রতিটি আঁধার আলোকিত করে চলেছেন তাঁর সৃজনী ক্ষমতায়। সুদীর্ঘ সময় পরও বহুমাত্রিক রবীন্দ্রনাথ আমাদের মাঝে নতুনভাবে আবিষ্কৃত হচ্ছেন তাঁর রচনা সম্ভারের মহিমান্বিত আভায়, সংগীতের সুর লহরীতে। তাঁর সকল সৃজনশীল কর্মযজ্ঞে আজো তিনি আমাদের প্রেরণার উৎস হয়ে বিরাজ করছেন। সাহিত্য-সংস্কৃতির সব কটা শাখায় বাতিঘর হয়ে সমানতালে আলো ফেলেছেন। একজন সৃষ্টিশীল মানুষ হয়ে তিনি বাঙালি জাতিসত্তাকে আলো-আঁধারে, দুঃখ- সুখে উত্থানের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন। প্রকৃতি প্রেম, সৌন্দর্যবোধ, আবেগপ্রবণতা, চেতনা, অসীমের খোঁজ এবং রোমান্টিসিজমের বৈশিষ্ট্য নিয়ে গড়ে ওঠা কবি সত্তার মাঝেই আমরা খুঁজে পাই বাংলা সঙ্গীতের শ্রেষ্ঠ গীতিকার ও সুরকার রবীন্দ্রনাথকে।
রবীন্দ্রনাথের গান কবিতা, উপন্যাস আর ছোট গল্প অসাধারণ এবং অপূর্ব আবেদন নিয়ে আমাদের প্রতিদিনের জীবন যাপনে জড়িয়ে আছে । আর কিছু না হোক শুধু গানগুলো যেন কী অবলীলায় আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষণের সাথে মিশে আছে। তাই প্রতিদিনকার জীবনের পরতে পরতে রবীন্দ্রনাথ আপন বিভায় আমাদের মননে সদা জাগ্রত। নিজ গান সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, এই পার্থিব জীবন ও পৃথিবীর মানুষকে আমি ভালোবেসেছি। এই ভালোবাসা রেখে গেলাম আমার গানের সুরে গেঁথে। মানুষ যদি মনে রাখে, তবে এই গান দিয়েই রাখবে। রবীন্দ্রনাথকে বাঙালি আপন করে নিতে পেরেছেন বলে তারা জানেন রবীন্দ্রনাথ কিভাবে আজও প্রাসঙ্গিক, আজো জীবন ও মননের এক অবারিত ক্ষেত্র। জগতের নানা গ্লানি, ক্লেদ, বীভৎসতা, সংগ্রাম এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ কিভাবে প্রশান্তির শীতল ছায়া বিলিয়ে দীপ্যমান । রবীন্দ্রনাথ আমাদের চেতনায় নিরন্তর হেঁটে চলেছেন । অবিরত রাবীন্দ্রিক প্রশান্তির আকাশতলে আমরা রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করি আমাদের ভালোবাসায়, আমাদের স্বপ্নে, আকাক্সক্ষায়। রবীন্দ্রনাথ আমাদের আপনজন, আমাদের প্রাণের মানুষ, আমাদের আরাধ্য। প্রতিভার বিপুল ব্যাপ্তিতে তাঁর গান, তাঁর কবিতা আমাদের অন্তর স্পর্শ করে, তাঁর সুরের নির্যাসে প্রাণে নবতর প্রেরণা জাগে। আমাদের জীবন চেতনায়, আমাদের জীবন ধারায় এবং জীবন সুষমায় রবীন্দ্রনাথ এক অপরূপ শিল্প নৈপুণ্যে অবধাবিত,উদ্ভাসিত। জীবনের ব্যর্থতা, সংকট, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হতাশা যখন মানুষকে বিপর্যস্ত করে তখন রবীন্দ্রনাথের আশ্রয় শীতল পরশ বুলিয়ে যায়। রাবীন্দ্রিক আশ্রয়ে নিজেকে আত্মস্থ করে সৌন্দর্যলোকের সন্ধান পাওয়া যায়। যারা সুন্দরকে ভালোবাসেন তারা কখনোই অসুন্দরের কাছে পরাস্ত হয় না। অসুন্দর তাদের কাছে পদানত হয়। ফলে রবীন্দ্র সংস্পর্শ মানুষকে উদ্বেলিত করে, আন্দোলিত করে, নির্ভয় করে, স্থিতিশীল করে, মুক্তবুদ্ধির সম্মিলনে নবতর জীবন চেতনায় উৎসারিত করে। তিনি তাঁর অনন্য সাধারণ সৌন্দর্য চেতনায় তাড়িত হয়ে সৃষ্টি করেছেন অসাধারণ সৌন্দর্যময়তায় ভরপুর কাব্য ও সঙ্গীত জগৎ। তাঁর সঙ্গীত আর কাব্য সাহিত্য মূলত সত্য আর সুন্দরের জয়গান -এক কথায় তাঁকে বলা চলে ‘সৌন্দর্য নির্যাসের উৎস’। তাঁর কাব্য জগতে অবগাহন করে পাঠক সৌন্দর্যের অপার আনন্দে ভেসে যায়। আর তাঁর সঙ্গীতের নিবিষ্ট অনুরণন শ্রোতাকে মোহাবিষ্ট করে এক অপার্থিব আনন্দানুভ‚তিতে।
বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর সমগ্র রচনা সম্ভারের ভেতরে রয়েছে অলৌকিক এক শক্তির উৎস। যা সাধারণ সচেতন পাঠককে অতিসহজেই মুগ্ধ করে। তাঁর কবিতা, ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ কিংবা চিত্রকলা, নাট্যকলায় কাব্য-নাটকের বিপুল বিস্তার আকাশের সীমা ছাড়িয়ে অনন্তে ছড়িয়ে যায়। সাহিত্য ভুবনে যিনি সূর্যের মতোই প্রদীপ্ত ও তেজস্বী, তাঁর হিমাদ্রিসম কাব্য সাধনার একটা স্বর্ণখচিত দিক হলো রবীন্দ্রসংগীত। সংগীতে তিনি বিশাল এক উচ্চতার অধিকারী, এক বিশাল প্রতিভাধর স্রষ্টা, যা আমাদের কাছে অনন্ত আকাশের মতোই অসীমতার প্রতীক। তাঁর রচিত গানের সংখ্যা প্রায় ২,২৩০টি হলেও এ সব গানের প্রকাশ, ভাষা বিন্যাস, সৃজনীসুধা, কথা, ব্যঞ্জনা, সুর, বিষয় বৈচিত্র্য হৃদয়স্পর্শী। গানগুলো নানাবিধ অনুভ‚তির অনুধ্যানে ঋদ্ধ এবং জীবন ঘনিষ্ঠ। তাঁর গান মানব সংসারের নানা রূপময়তায় পরিপূর্ণ। আর কথা সুর ও বোধ বিন্যাসে তা অতলান্ত সমুদ্র গভীর। গানের নক্ষত্রখচিত আকাশ সৃষ্টি করেছেন স্বকীয় এক আবেগী আকর্ষণ ও বৈচিত্র্য বিন্যাসী রূপমাধুর্যে এবং তিনি তা করেছেন অন্তরের গভীরতম ও বোধনস¤পৃক্ত এক বিরামহীন সৃষ্টিশীলতাকে অঞ্জলি দিয়ে। মানুষ, প্রকৃতি, সৃষ্টিকর্তা, পরিবেশ, জীবজগৎ, ভালমন্দ, ন্যায়-অন্যায় এবং সুন্দরকে তিনি নিজের মতো করে মুক্তবুদ্ধি, যুক্তি, স্বাধীন ও স্বকীয় মননশীলতার শৈল্পিকতায় আত্মস্থ করেছেন। তিনি তাঁর নিজস্বতা, অনুভব ও বিশ্লেষণের সাবলীলতায় কবিতা, গান, উপন্যাস, ছোট গল্প, নাটক গীতিনাট্যে প্রকাশ করেছেন প্রবহমান জীবনের নিত্যদিনের চালচিত্র। গানকে জীবন ও প্রাণের সারাৎসার গণ্য করে এবং ঈশ্বরপ্রেম, অঞ্জলি ও আরাধনাকে মাধ্যম করে সুরের ভেলায় চড়ে তিনি ছুটেছেন সম্মুখে। তিনি আনন্দের বন্যায় ভেসে গেছেন প্রেমের উজ্জয়িনীপুরে; নূপুর নিক্কনে যেখানে বেজেছে অনুধ্যানী সুর, যা জীবন ও জগৎকে অফুরন্ত এক শান্তি সুখের প্রস্রবনে ভরপুর। তিনি ভেদ করতে চেয়েছেন সুরের মাধবী মায়ায় যত অন্ধকার, যেখানে গানকে সকল সাধনার চিরন্তনীকে প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করেছেন। মুক্তির বার্তা নিয়ে এসেছে এ গান, যা পৃথিবী, মানুষ, প্রকৃতি ও ঈশ্বরের মাঝে নির্মাণ করেছে সেতুবন্ধন। তিনি গানকে বেঁধেছেন ঐকান্তিকতায়। গান গেয়েছেন, গেয়ে শুনিয়েছেন, কথা ও সুরের ইন্দ্রজালে ভেসেছেন, ভাসিয়েছেন এবং সুরের ভেলায় ভাসিয়ে চিরন্তনী এক পথ তৈরি করেছেন। এখানে তিনি সৃষ্টি সুখের উল্লাসে ভেসে চলা এক অনন্য স্বপ্নবান শিল্প স্রষ্টা ।
রবীন্দ্রসংগীতের আবেগময়তা এবং সৌন্দর্যের আবেদন বাঙালির কাছে রবীন্দ্রনাথের কবিতার সমান্তরালে মুগ্ধতার সৌরভ ছড়ায়। ‘বাংলায় এমন কোনো গৃহস্থ বাড়ি নেই, যেখানে রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়া হয় না বা কেউ গাওয়ার চেষ্টা করে না… এমন কী নিরক্ষর গ্রামবাসীরাও তাঁর গান গেয়ে থাকে।’ রবীন্দ্রনাথের গানের বিষয়বৈচিত্র্য বর্ণনা করতে গিয়ে বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, ‘আকাশে মেঘ করে, নদীতে ছায়া পড়ে, একা চাঁদ আকাশ পাড়ি দেয়, হাওয়ায় গাছের পাতা দোলে, হঠাৎ একটু লাল রোদের ফালি ঘরে এসে পড়ে, সূর্যাস্ত আকাশে সোনা ছড়ায়, আবার শীত সন্ধ্যার ক‚ন্যতা আকাশকে রিক্ত ক’রে যায় – যখন যা কিছু চোখে পড়ে, যা-কিছু মন দিয়ে ছুঁই সে-সমস্তই বয়ে আনে রবীন্দ্রনাথের কত গানের কত বিক্ষিপ্ত চরণ।’ তাঁর সাহিত্যের বিপুল বিস্তারের মাঝে সংগীত বড়ো একটি জায়গা জুড়ে আছে। সংগীতের সুর বাণীতে তিনি পূর্ণিমার রশ্মি ছড়িয়ে বিদগ্ধ মানুষের মনোলোক বিকশিত করে চলেছেন।
রবীন্দ্র মানসে কল্পনার সাথে আছে ভাববাদের মেলবন্ধন। তাঁর গানগুলো সুর প্রধান নয় বাণী প্রধান আর এই বাণীর মাঝেই লুকিয়ে আছে কল্পনা আর ভাববাদী দর্শনের পূর্ণ প্রকাশ। রবীন্দ্রনাথের গানের কথা ও সুরে উপনিষদ, বৈষ্ণবপদাবলী ও বাউল গানের প্রভাব রয়েছে। সুরের দিক থেকে তাঁর গানে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, কীর্তন, শ্যামাসঙ্গীত, বাউল গান, ইত্যাদির ও প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। তিনি অনুপম অতুলনীয় শব্দালংকারের ভেতর দিয়ে স্বাদেশিক চেতনায় প্রকাশ করতে চেয়েছেন বঙ্গজননীর মহিমান্বিত অতীত আর গর্বিত উত্থানের মর্মবাণী: ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি/ চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস/ আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।’ তাঁর আমার সোনার বাংলা গানটি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীত ঘোষিত হয়। এভাবে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে কবি প্রতিনিয়ত উপস্থিত হন আমাদের কাছে এবং আমাদের দেশাত্মবোধক চেতনাকে উজ্জীবিত করেন। জাতীয় সঙ্গীতের সুর মূর্ছনা যখন ধ্বনিত হয় তখন আমাদের মাঝে রবীন্দ্রনাথের সরব উপস্থিতি অনুভব করি। এর আগেই অবশ্য কবির জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে গানটি ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের জাতীয় সংগীতের মর্যাদা লাভ করেছিল। রবীন্দ্রনাথ দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীত রচয়িতার বিরল মর্যাদার অধিকারী। বাংলাদেশকে তাঁর লাবণ্যময়ী জননী আখ্যায়িত করে গেয়েছেন ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি, তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী। ওগো মা, তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে’ এবং “বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু বাংলার ফল/ পুণ্য হউক পুণ্য হউক পুণ্য হউক হে ভগবান। কিংবা ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা। তোমাতে বিশ্বময়ীর, তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা’। তুমি মিশেছ মোর দেহের সনে, তুমি মিলেছ মোর প্রাণে মনে, তোমার ওই শ্যামলবরণ কোমল মূর্তি মর্মে গাঁথা’। রবীন্দ্রনাথের এ স্বদেশী সংগীতগুলোতে দেশ মাতৃকা অত্যন্ত নিরাকার হলেও এরই মধ্যে রয়েছে বিশ্বময়ীর, বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের সবসময় আশা ও স্বপ্ন জাগানিয়া আলোর দিব্যরথে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তাঁর সংগীতের স্বদেশ পর্বের গানগুলো দেশপ্রেমের ও দেশাত্মবোধের উৎসারণে সৃজিত। সোনার বাংলাকে ভালবাসা এবং বাংলায় জন্ম নিয়ে তাঁর জন্ম যে সার্থক হয়েছে সেভাবেই উচ্চারণ করেছেন। আবার দেশমাতৃকার স্বাধীনতা ও গণজাগরণের জন্য যেমন গানকে এনেছেন, তেমনি বলেছেন অত্যাচারীর বাঁধন যত শক্ত হবে ততো দ্রæতই সে বাঁধন ছিঁড়বে, দেশ মুক্ত হবে। দেশপ্রেমের সাথে দেশবাসীকে উজ্জীবিত করার জন্য এভাবে গানের কথায় সবার চিন্তার সাথে নিজেকে সংযুক্ত করেছেন। সবার মধ্যে নিজের মুক্ত ও মুক্তি চিন্তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। নিজেকে তাঁদের সাথে এক সারিতে দাঁড় করিয়েছেন, উদ্বুদ্ধ করেছেন, উৎসাহ দিয়েছেন এবং সাহস জুগিয়েছেন। জনগণের চিন্তা ও চেতনার সাথে একাত্ম হয়েছেন। ব্রিটিশ শাসন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে নিজের অভিমত প্রকাশ করে মুক্তচিন্তার সাথে সংহতি প্রকাশ করেছেন। এখানেই তাঁর সত্য পথ অনুসন্ধানের চিন্তা ও চেতনার মূর্ত প্রকাশ হয়েছে। অবশ্য ভিন্ন চিন্তার সুরে ও কখনো নিজেকে বেঁধেছেন তিনি। প্রেমমূলক গানে রবীন্দ্র চিন্তা যেন দার্শনিক ভাবধারায় পুষ্ট এক ক্লাসিক ও অবিনাশী উচ্চারণ। স্বদেশ বোধে তিনি গেয়েছেন ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে’, ‘বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি বারে বারে হেলিস নে ভাই’, ‘ওদের-বাঁধন যতই শক্ত হবে ততই বাঁধন টুটবে’। তাঁর বিশ্বজয়ী এমন অমর সংগীতের সুর আর বাণীতে পথহারা পথিকও আচমকা থমকে দাঁড়ায়, ভেবে ব্যাকুল হয়ে ভালোবাসার পরম পরশ পেতে চান, তখন শত না পাওয়ার বেদনাবিধুর মলিন অবয়বেও আনন্দে নেচে ওঠে মন।
কল্পনা যেহেতু শূন্য থেকে আসে তেমনি তাঁর গানে কল্পনার শুরু শূন্য থেকে। নিরালোক থেকে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে এই শূন্যতাকে রবীন্দ্রনাথ রাঙিয়ে দেন। তিনি সীমাহীন কল্পনায় অবগাহন করে রচনা করেন তাঁর এ গানটি – তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা/ মম শূন্য গগণবিহারী/ আমি আপন মনের মাধুরী মেশায়ে তোমারে করেছি রচনা। তিনি আবার তাঁর গানের সুধারসে অবগাহন করার জন্য সবাইকে আমন্ত্রণ জানান -জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণা ধারায় এসো/ সকল মাধুরী লুকায়ে যায়, গীতসুধারসে এসো। সৌন্দর্য চেতনায় রবীন্দ্রনাথের গানের সুরে বেজে ওঠে সুন্দরের আবাহন এই লভিনু সঙ্গ তব সুন্দর হে সুন্দর/ পুণ্য হলো অঙ্গ মম/ ধন্য হলো অন্তর। সুন্দর অন্বেষণে তিনি বিহার করেন ধ্যানে আর আধ্যাত্মিকতায়। যা তাঁর কল্পনাকে আরও বর্ণিল করে দেয়।
তাঁর পূজা পর্বের গানগুলোর কথা ও সুরে তিনি ঈশ্বর প্রেম, শ্রদ্ধা বা স্মরণ বিষয়টিকে তুলে অত্যন্ত নিপুণতায় তুলে ধরেছেন । এখানে তিনি সৃষ্টিকর্তার কাছে সুর বা পরম পুরুষের তর্পণের জন্য জ্ঞানকে প্রার্থনা করেছেন। মুক্তি খুঁজেছেন ঈশ্বর সৃষ্ট আলো, ধূলি ও ঘাসে। মনের ভেতর শুনেছেন তাঁর চরণধ্বনি যিনি দীনবন্ধু, চিরবন্ধু ও চিরশান্তির আশ্রয়স্থল। সব কাজ শেষ হলে তিনি নীরবে অথচ হাসি মুখেই ঈশ্বরের কাছে ফিরে যাবেন এ প্রত্যয়ও ব্যক্ত করেছেন আনন্দচিত্তে। পূজা অংশে ভক্তি-শ্রদ্ধাপূর্ণ পঙ্ক্তিগুলোকে তিনি সব সুরের অধিকারী মহান স্রষ্টাকে বিশ্বলোকের রাগীনিরূপে অর্ঘ্য দিয়েছেন। সীমার মাঝেই অসীম স্রষ্টার বাস । সেখানেই তিনি সুখময়তায় তাঁকে আবিষ্কার করেন সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর/ আমার মাঝে তোমার প্রকাশ তাই এত সুমধুর। পূজা পর্বের কয়েকটি গানের কিছু চরণে কবির আর্তি প্রকাশ পেয়েছে ‘কান্না হাসির দোল দোলানো পৌষ ফালগুনের পালা, তারই মধ্যে চিরজীবন বইব গানের ডালা’, ‘শান্তি কোথায় মোর তবে হায় বিশ্বভুবন মাঝে/ অশান্তি যে আঘাত করে তাইতো বীণা বাজে’, ‘সুরের গুরু দাওগো সুরের দীক্ষা, ‘অরূপ তোমার বাণী, অঙ্গে আমার চিত্তে আমার মুক্তি দিক যে আনি‘, ‘গানে গানে বন্ধন যাক টুটে’, ‘জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে, বন্ধু হে আমার রয়েছ দাঁড়ায়ে’, ‘ক‚ল থেকে মোর গানের তরী দিলেম খুলে, সাগর মাঝে ভাসিয়ে দিলেম পালটি তুলে’, ‘দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার গানের ও পারে’, ‘এবার আমায় ডাকলে দূরে, সাগর-পারের গোপন পুরে’, ‘আমার হৃদয় মাঝে লুকিয়েছিলে দেখতে আমি পাই নি’, ‘আমারে তুমি অশেষ করেছ এমনি লীলা তব’, ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে’, ‘ঐ শুনি যেন চরণ ধ্বনি রে, শুনি আপন মনে’, ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃত্থী, নিত্য নিঠুর দ্ব›দ্ব, ঘোর কুটিল পন্থ তার লোভজটিল বন্ধ’, ‘চিরবন্ধু চিরনির্ভর চিরশান্তি, তুমি হে প্রভু’, ‘সুন্দর বটে তব অঙ্গদখানি তারায় তারায় খচিত’, ‘যেতে যদি হয় হবে, যাব যাব যাব তবে, যাব চলে হাসিমুখে যাব নীরবে’। দেশ ও দেশের বাইরে যখন দুঃসময়ের ঘনঘটা তখন রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘শান্তির ললিত বাণী শুনাইবে ব্যর্থ পরিহাস’। আবার তিনিই শান্তির বারতা নিয়ে প্রার্থনার অঞ্জলিতে গেয়েছিলেন ‘বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি’। রবীন্দ্রনাথের এ প্রার্থনা ছিল স্রষ্টার প্রতি বিংবা সুকুমার বৃত্তির মুক্তচিন্তার মানুষগুলোর প্রতি।
প্রেম পর্যায়ের কিছু গানে রবীন্দ্রনাথ তাঁর আবেগমথিত সুরের আবেশ ছড়ানো কথামালায় প্রকাশ করেছেন হৃদয়ানুভ‚তি। এ সব কথামালা মনে মনে, প্রাণে প্রাণে সঞ্চারিত হয়ে চিরকালই মানুষকে প্রাণবন্ত করবে। গানের প্রতিটি কথা, প্রতিটি শব্দই যেন এক একটা মণিকাঞ্চন। কোনো কোনো প্রকাশ এমন সরাসরি ও সহজ যে, তা হৃদয়কে প্রতিক্ষণেই নাড়িয়ে দিয়ে যায়। যেমন ‘আমার মন মানে না দিনরজনী’ যেন সবই বলা হয়েছে অথচ কী নিটোল ও নির্মল। ‘তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম’ এ চিরকালীন কথা যেন চিরসুন্দরে মোড়ানো। ‘আমি তোমার প্রেমে হবো সবার কলঙ্কভাগী’ কি সরাসরি এক অপূর্ব উচ্চারণ, যা চিরকালীন মানুষের মনের বিশেষ আকুতিময় কথা। ‘কাঁদালে তুমি আমায় ভালবাসারই …’, ‘গোপন কথাটি রবে না গোপনে উঠিল ফুটিয়া নীরব নয়নে’ দেয়া-নেয়া, মিলন-বিরহ, রাগ-অনুরাগে কাব্যসিক্ত গীতমালাকে আনন্দ বেদনার সুরগাম্ভীর্যে মুড়িয়ে ভালবাসার রসে সিক্ত করে গীত বিতানে প্রেমপর্বের গান পর্বে গানগুলো যেভাবে উপহার দিয়েছেন, জীবন ও সময় বাস্তবতার বিচারে তা সত্যই অসামান্য। এ সব গান দ্বিমাত্রিক অর্থাৎ প্রেম ও পূজা ভাবসমৃদ্ধও বলা যায়। গীতবিতানের প্রেমের গান তাই এক অনন্য ছন্দ প্রবাহে প্রবাহিত এক অনবদ্য সঞ্চয়ন। ‘আমার নয়ন তব নয়নের নিবিড় ছায়া’, ‘তোমায় গোপন কথাটি, সখি রেখো না মনে’, ‘এসো আমার ঘরে এসো আমার ঘরে’, ‘খোল খোল দ্বার রাখিও না আর, বাহিরে আমায় দাঁড়ায়ে’, ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রæবতারা’, ‘সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে ফুলডোরে বাঁধা ঝুলনা’, ‘রোদনভরা এ বসন্ত সখী, কখনো আসেনি বুঝি আগে’, ‘মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে চলে, সেই দিন ভরা সাঁঝে’। তিনি যখন বলেন, ‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়েছিলে দেখতে আমি পাই নি তোমায়, দেখতে আমি পাই নি, বাহির পানে চোখ মেলেছি, আমার হৃদয়-পানে চাই নি ‘কিংবা ‘আমি চিনিগো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী, তুমি থাকো সিন্ধু পারে ওগো বিদেশিনী’, সখি ভালবাসা কারে কয়, আমি তোমার ই সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ, আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল, ভালবেসে সখি নিভৃত যতনে, বধূ মিছে রাগ করো না, মনে রবে কিনা রবে আমারে।
প্রকৃতি পর্বের গানের আবেশে কবির দৃষ্টিতে নৈসর্গিক সৌন্দর্য দৃশ্যমান। প্রকৃতির গানে কবি আপন অস্তিত্বকে মিশিয়ে দেন তোমার ফাগুন হাওয়ায় করেছি যে গান, আজ দখিন দুয়ার খোলা, আমার মল্লিকা বনে, এ সব গানই কথার যাদুময়তায় অপূর্ব অথচ চিরকালীন মানুষের কাছে চিরসত্য এক অভিজ্ঞান। রবীন্দ্রনাথের সব গান হাজারবার শুনলেও সাধ মেটে না, মন ভরে না। বারবার বেশি বেশি করে শুনতে ইচ্ছা করে। সব গানেই গানে-গানে, সুরে-সুরে, রবীন্দ্রনাথ খুঁজেছেন জীবন, জগৎ ও স্রষ্টাকে আর সুরধ্যানে পৌঁছে যেতে চেয়েছেন ঈশ্বরের কাছে। প্রকৃতি পর্বের গানের মাঝে রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতির সাথে নিবিড় সখ্যতা প্রোজ্জ্বল। প্রকৃতির অনুপম রূপে মুগ্ধ হয়ে এক অজানা অনুভবে পুলকিত রবীন্দ্রনাথ অনির্বচনীয় আনন্দে মেতে ওঠেন মোর ভাবানারে কী হাওয়ায় মাতালো/ দোলে মন দোলে অকারণ হরষে। এর পরের স্তরে তারা খুঁজে পান এক ধরনের জ্ঞানের সন্ধান । রবীন্দ্রনাথ মনের হরষে প্রকাশ করেন তাঁর সত্য সুন্দরের আরাধনাপূর্ণ গানের চরণ আনন্দলোকে মঙ্গল আলোকে বিরাজ করে সত্য ও সুন্দর। রবীন্দ্রনাথ ফিরে আসেন মাটির টানে অলীক কল্পনার চেয়ে বেশি সুখময়তায় এ মাটি, গাছ আর ফুল ফসলে। তিনি স্বপ্ন ভেঙ্গে নেমে আসেন সত্যি ধরা তলে; ফসলের মাঠে। আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায় লুকোচুরির খেলা / নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘে ভেলা/ আজ বিনা কাজে বাজিয়ে বাঁশি কাটবে সকল বেলা। রবীন্দ্রনাথ পরম আনন্দে এ পৃথিবীতে তাঁর জাগরিত সত্তার অবস্থান দেখেন আকাশ ভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ/ তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান/ বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান। রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে ক খনো গেয়ে ওঠেন – আনন্দ ধারা বহিছে ভুবনে / দিবস রজনী কত অমৃতরস উথলি যায় অনন্ত গগনে, “একি আকুলতা ভুবনে একি চঞ্চলতা পবনে ”, এসো এসো হে বৈশাখ, এসো শ্যামল সুন্দর, আষাঢ় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো, গেল রে দিন বয়ে, শরৎ আলোর কমলবনে, পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে, আয় রে চলে আয় আয় আয়, একটুকু ছোঁয়া লাগে, একটুকু কথা শুনি, মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে, আহা আজি এ বসন্তে, কত ফুল ফোটে। রবীন্দ্রনাথই বোধহয় একমাত্র কবি যিনি পরম মমতায় বলতে পারেন গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ আমার মন ভুলায় রে। ওরে কার পানে মন হাত বাড়িয়ে লুটিয়ে যায় ধুলায় রে’।
সংগীত বোদ্ধাদের দৃষ্টিতে রবীন্দ্রসংগীত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সংগীতের মর্যাদার আসনে আসীন। কারণ সারা বিশ্বে অন্য কোনো কবির গানে এমন দার্শনিকতার লেশমাত্র নেই। রবীন্দ্র সংগীত হলো এক চিরন্তন শুদ্ধ চেতনার সংগীত যা মানুষের ভাবনা রাজ্যে দোলা দেয়। তাঁর অসংখ্য গানের চিরন্তন বাণী মানুষের অন্তরে বারবার উচ্চারিত হয় ভালোবাসার অফুরন্ত মহিমায়। তৃষিত-তাপিত মনের বীনায় বারবার ঝংকৃত হয় ‘আমার পরান যাহা চায় তুমি তাই, তুমি তাই গো। তোমা ছাড়া আর এ জগতে মোর কেহ নাই কিছু নাই গো’। বাসন্তিক উল্লাসে রচনা করেন কবি ‘আহা আজি এ বসন্তে এতো ফুল ফোটে, এতো বাঁশি বাজে, এতো পাখি গায়, আহা আজি এ বসন্তে। তিনি তাঁর নিপুণ কাব্যকলায় আমাদের মাঝে সুরের মনোমুগ্ধ চিত্রকল্প তৈরি করেছেন। সেখানে আবেগ আছে। প্রেমের গূঢ় রহস্যের অনুভব অনুভ‚তির প্রকাশ আছে।
তাঁর সৃষ্টির যাবতীয় নির্মাণ বাঙালি মানসে এক অবিস্মরণীয় আলোর বিচ্ছুরণ ছড়িয়ে যেভাবে মানুষকে আন্দোলিত করছে,আলোকিত করে চলেছে সকল সচেতন নাগরিককে তা সত্যিই বিস্ময়কর। তাঁর অনেক কালজয়ী জনপ্রিয় গান আজো বিদগ্ধজন পাঠককে গভীরভাবে ভাবায়। তাঁর অমর সংগীতের মধুরবাণী বিশ্বলোকালয়েও সমানভাবে আদৃত-‘আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলা নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই লুকোচুরি খেলা’। কবির মনের অলিন্দে হামাগুড়ি সুখ-দুঃখের ব্যাকুল আকুতি। আরাধনায় তপস্যারত মনোভ‚মে বারবার ভেসে ওঠে কোনো এক অজানা গাঁয়ের পুষ্পবালিকার মনকাড়া মধুর হাসি, তখন কবি লিখেন ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’। এমন অসংখ্য গানের ভেতর রবীন্দ্রনাথ তাঁর মনমানসীর সন্ধান করেছেন বহুমুখি শব্দ চয়নে। তা বিবৃত হয়েছে অতুলনীয় প্রেমময় আকাক্সক্ষার বাণীতে। কবি দুঃখকে বিদায় জানাতে চান যেভাবে ‘আমার সকল দুখের প্রদীপ জ্বেলে দিবস গেলে করব নিবেদন আমার ব্যথার পূজা হয় নি সমাপন।’ তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে সে আগুন ছড়িয়ে গেলো সবখানে আবার কবি কান পেতে থাকেন কারো আগমন অপেক্ষায় এবং তিনি বলেন আমি কান পেতে রই…। এভাবে তার ব্যক্তিগত অনুভবের গান তাঁকে নিয়ে যায় কোন সুদূরলোকে – দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার গানের ওপাড়ে।
কবি মৃত্যুচিন্তায় ভাবেন তাঁর স্বপ্নের অপরূপ এ চেনা জগৎ একদিন অচেনা আঁধারে ঢেকে যাবে। তিনি স্রষ্টার কাছে নিজেকে সমর্পণ করেন – পথ আমারে সেই দেখাবে যে আমারে চায়/ আমি অভয় মনে ছাড়ব তরী এই শুধু মোর দায়। রূপ নারানের কুলে কবিতায় কবি দৃশ্যমান জগতকে মেনে নেন শত প্রতিক‚লতাকে স্বীকার করে নিয়ে বলেন- সত্য যে কঠিন সে কঠিনেরে ভালোবাসিলাম। এই সত্য হচ্ছে এই জগতের বেদনা, ক্ষয়, মৃত্যু; এসব মেনে নিয়েই কবি এই বস্তু-জগতে ফিরে আসেন। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছিলেন জীবনের এই ঋত আমরা পরিশোধ করি মৃত্যু দিয়ে। তিনি, উল্লেখযোগ্যভাবে, এই ক্ষয়িঞ্চু পৃথিবীর মাঝেও খুশির রেশ খুঁজে পান- আছে মৃত্যু, আছে দুঃখ, বিরহ দহন লাগে/ তবু শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে । এভাবেই রবীন্দ্রনাথ অনন্তের মাঝে ক্ষুদ্র নিজেকে সঁপে দেন ।

তিনি সুরের আবেগে বলে উঠেন – আমার যাবার বেলায়…, ‘তখন কে বলে গো সে প্রভাতে নেই আমি’। কবি অমর হয়ে থাকতে চান সুন্দর এ পৃথিবীর মানুষের মাঝে। কখনো কখনো মানুষের মাঝে তিনি বেঁচে থাকার যে ব্যাকুল আকুতি জানিয়েছেন তাঁর অসামান্য অমর সংগীতের বাণী আর সুর মূর্ছনায়। তা সত্যিকার অর্থেই চিরন্তন। যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে, আমি বাইবো না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে, চুকিয়ে দেব বেচাকেনা, মিটিয়ে দেব গো, মিটিয়ে দেব লেনাদেনা, বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে, তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে’। কবির এই গানের প্রতিটি সুর মিশ্রিত পঙক্তিতে রয়েছে জগতের চিরন্তনী ব্যাকুলতা, হৃদয়ের স্পন্দন, পৃথিবীর সৌন্দর্যে লীন হয়ে থাকার বাসনা।
স্মরণ বিস্মরণের স্রোতে ভাসে সময় ও জীবন। কবি বাস্তবে চিরকাল আমাদের মাঝে থাকবেন না এ কথা চিরন্তন সত্য। তারপর ও আমাদের প্রাত্যহিক জীবন পরিক্রমায় তিনি আপন সৃষ্টির মাঝে অমরত্ব নিয়ে জীবন্ত হয়ে আছেন। আমাদের আনন্দে তাঁর কাব্য সমুজ্জ্বল, আমাদের অশ্রæতে তাঁর গান করুণ; তাঁর প্রেমের গানে কায়া পেয়েছে আমাদের হৃদয়াবেগ। তাইতো তিনি আমাদের প্রাণের মানুষ-মনের মানুষ, তিনি আমাদের গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি আমাদের জীবন-মরণ সীমানা ছাড়ানো বন্ধু। রবীন্দ্রনাথের মহান জীবনস্রোতের মাঝে বাঙালি জাতি একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ জগত সংসারে মানব পাথারে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেভাবে মানুষকে পরম ভালোবাসার মন্ত্রজালে জড়িয়ে রেখেছেন তা অন্য কোনো কবির পক্ষে সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন ‘তুমি ডাক দিয়েছো কোন সকালে কেউ তা জানে না, আমার মন যে কাঁদে আপন-মনে কেউ তা মানে না, ফিরি আমি উদাস প্রাণে, তাকাই সবার মুখের পানে, তোমার মতো এমন টানে কেউতো টানে না’। এমন অসাধারণ গানের টানে কবি মানুষকে আপন আলোয় কাছে টানতে পেরেছেন , তা কেবলই বিশ্বকবির গান।
যতদিন এ পৃথিবী থাকবে ততদিন বাঙালি জাতি রবীন্দ্রনাথের অমর সংগীতের চিরন্তন বাণীর উৎস সন্ধানে গবেষণা করে যাবে। আপন আলোয় অনাবিল আনন্দের স্রোতধারায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অমর ও অক্ষয় হয়ে থাকবেন মানুষের মাঝে আনন্দ-বেদনার উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে। আজো রবীন্দ্রনাথের উজ্জ্বল উপস্থিতি আমাদের আনন্দ দেয়। বিশেষ করে তাঁর প্রতিটি গানের অসাধারণ আবাহন মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো আকর্ষণ করে, কখনো কখনো সেই সুরধ্বনিতে আবেগে অশ্রুতে বাকরুদ্ধ হয়ে আসে। তাঁর অমূল্য অবদানের কাছে বাঙালি চিরকাল ঋতী। তাঁর শিল্পিত সুরনির্ঝরে আমরা আচ্ছন্ন হয়ে ক্রমাগত মুগ্ধতায় খুঁজে ফিরি তাঁকে এ বিশ্ব চরাচরে । তাই তাঁরই সুরে তাঁকে স্মরি – তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে মম ।