শেয়ার রম্য

215

এক
বাসুদেব মন্ডল একটি ফরমায়েশী লেখা লিখতে বসেছেন। ফরমায়েশী লেখা মানে পত্রিকার সম্পাদক সাহেব একটা গদ্য কার্টুন চেয়েছেন।
বাসুদেব মন্ডল কোনকিছু লেখার আগেই নাম ঠিক করে নেন। কী নিয়ে লেখা যায় তা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন। চোখ চলে গেছে টেবিলে রাখা পত্রিকায়।
পত্রিকার প্রথম পাতায় শেয়ার বাজারের চিত্র। মতিঝিল এলাকায় বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভ।
বাসুদেব মন্ডল লেখার নাম ঠিক করলেন। লেখার খাতা টেনে লিখলেন ‘শেয়ার রম্য’।
রম্য লেখাটিতে তাঁর চোখ আটকে গেছে।
তিনি ভাবছেন- “রম্য মানে কি শুধু হাসি ? না। হাসির নিচে লুকিয়ে থাকে বেদনা। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় যাকে বলেছেন, মাপা হাসি চাপা কান্না।”
তাঁর মনে পড়ল সৈয়দ মুজতবা আলীর পন্ডিতমশায়ের কথা। মাথার মাঝে খেলা করছে গল্পের শেষ অংশ-
“আমি, ব্রাহ্মণী, বৃদ্ধামাতা, তিন কন্যা, বিধবা পিসি, দাসী একুনে আমরা আটজন।
লাট সায়েবের তিনঠ্যাঙা কুত্তার পিছনে মাসে পঁচাত্তর টাকা খরচ হয়। এইবার দেখি, কি রকম আঁক শিখেছিস। বলতো দেখি, যদি একটা কুকুরের পিছনে মাসে পঁচাত্তর টাকা খরচ হয়, আর সে কুকুরের তিনটে ঠ্যাং হয় তবে ফি ঠ্যাঙের জন্য কত খরচ হয়?
আমি ভয় করছিলুম পন্ডিত মশাই একটা মারত্মক রকম আঁক কষতে দিবেন। আরাম বোধ করে তাড়াতাড়ি বললুম, আজ্ঞে পঁচিশ টাকা।
পন্ডিত মশাই বললেন, ‘সাধু সাধু’।”
বাসুদেব মন্ডল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বসলেন সোজা হয়ে।
দুই
এখন তিনি শেয়ার ব্যবসা নিয়ে ভাবছেন।
শেয়ার ব্যবসা নিয়ে বাসুদেব মন্ডলের তেমন কোন অভিজ্ঞতা নেই। যদিও এক সময় শেয়ার ব্যবসা করার একটা সম্ভাবনা তৈরী হয়েছিল।
সহকর্মী ইমরান শেখর বলেছিলেন, ‘একটা চাকরিতে আজকাল হয় না। পার্টটাইম কিছু করতে হয়। কেউবা হোমিওপ্যাথি, আর কেউবা ডিসপেনসরি নিয়ে আছেন। আমি আছি, শেয়ার ব্যবসায়। সপ্তাহে বৃহস্পতিবার স্টক হাউজে যাই। বাকি দিনগুলো ফোনে ফোনে চলে। যাবেন নাকি ?’
ইমরান শেখর মনের মধ্যে কৌতুহল জাগিয়ে দিয়ে ছিলেন। তাঁর সাথে বারতিনেক স্টক হাউজে গিয়েছিলেন। বিও হিসাব খোলার জন্য ফরম ফিলাপ করেছিলেন।
তারপরের দিনের ঘটনা।
সেদিন বিদ্যালয়ে পৌঁছতে খানিক দেরি হয়েছিল। সকালের সমাবেশ শেষ। তারও মিনিট পাঁচেক পর বাসুদেব মন্ডল এলেন।
হেডস্যার তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে। বাসুদেব মন্ডলকে দেখেই বললেন – আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। চলেন বসি।
হেডস্যার আর বাসুদেব মন্ডল মুখোমুখি বসেছেন।
হেডস্যার হেসে বললেন – বিজ্ঞানীদের বিনিয়োগকারী হতে নেই, উদ্যোক্তা হতে হয়।
– বুঝলাম না স্যার।
– বুঝলেন না? আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়কে নিয়ে আপনার একটা লেখা পড়েছিলাম। বেঙ্গল ক্যামিক্যালের প্রতিষ্ঠাতা। তাছাড়া কী দরকার? আপনার মতন চিন্তাশীল একজনের ফটকা ব্যবসায় যাওয়ার।
এরপর পূরণকৃত বিও ফরম আর জমা দেওয়া হয় নাই।
তিন
শেয়ার বাজারে তখন মন্দাভাব। আর মন্দাভাবে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ক্ষোভ-বিক্ষোভ-হতাশা কাজ করে।
বাসুদেব মন্ডল ইমরান শেখরের শেয়ার ব্যবসার অবস্থা জানতে চেয়েছিলেন। তিনি শুনিয়েছিলেন এক গল্প। সেই গল্পের কথা মনে পড়ে গেল –
“মাতার দুই ছেলেকে মোয়া বিক্রির জন্য হাটে পাঠিয়েছেন। বড় ভাইকে এক টাকা দিয়ে বললেন, পথে ক্ষুধা লাগলে দুই ভাই মিলে কিছু খেয়ে নিস্।
দুই ভাই মোয়া নিয়ে হাটে চলেছে। কিছু দূর গিয়ে বড় ভাই ছোট ভাইকে বলে, ক্ষুধা লেগেছে। এই নে টাকা। একটা মোয়া দে। আর কিছুদূর গিয়ে গিয়ে ছোট ভাই বলে, এই নাও টাকা। একটা মোয়া দাও। এইভাবে চলেছে তাদের মোয়া খাওয়া।
বেলা শেষে যখন ঘরে ফিরছে, তখন তাদের একজনের হাতে মায়ের দেওয়া টাকা। অন্যজনের হাত শূন্য। সেই টাকাও ঘরে ঢুকার আগ মুহূর্তে খরচ করে ফেলে।”
ইমরান শেখর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্লাস নেওয়ার জন্য বের হয়েছিলেন।
চার
বাসুদেব মন্ডল শেয়ার নিয়ে হাসির কোন খোরাক পাচ্ছেন না। শেয়ার বাজার নিয়ে যারা টুকটাক নাড়াচাড়া করেন, তাদের জন্য সাধারণ বার্তা – সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখতে নাই। কেনার চেয়ে বেচাতে পারদর্শী হতে হয়।
বাসুদেব মন্ডল চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন। তিনি বিড়বিড় করে বলতে থাকলেন – শেয়ার, শেয়ার, শেয়ার। তা এক সময় রূপান্তরিত হলো – মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা, পরিসংখ্যান।
বাসুদেব মন্ডল শেয়ার নিয়ে মাপা হাসি চাপা কান্নার গল্প পেয়ে গেলেন। মনে মনে তিনি সেই গল্প দাঁড় করিয়ে ফেললেন।
“মার্কিন রম্য লেখক স্যামুয়েল ল্যাং হর্নক্লিমেন্স। এই নামে নয়. বরং ছদ্ম নামেই তিনি পরিচিত। মার্ক টোয়েন। যার অর্থ ‘বারফুট গভীর জল’। ছিলেন মাঝি। ১৮৫৭ সালে মিসিসিপি নদীতে স্টীম বোট চালকের কাজ নেন। স্বপ্ন নাবিক হয়ে সমুদ্র পথে সারাবিশ^ ভ্রমণ। সেই স্বপ্নপূরণ নাই। কিছু সময়ের মধ্যে ছেড়ে দেন বোট চালকের কাজ।
পরে সেই স্বপ্ন থেকে লেখালেখির জগতে নাম নিলেন ‘মার্ক টোয়েন’।
বই লিখে মোটা অর্থের মালিক হয়েছেন। অর্থনীতিবিদ বন্ধুদের কাছে কোথায় টাকা বিনিয়োগ করা যায় তার পরামর্শ চাইলেন। তখন আমেরিকার শেয়ার বাজার খুব উর্ধ্বমুখী এবং পরিসংখ্যানবিদরা ভবিষ্যবাণী করলেন পরের বছর শেয়ার বছর আরো চাঙা হবে।
মার্ক টোয়েন তাঁর সমুদয় অর্থ শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করলেন। আর সেই বছরই শেয়ার বাজারে ভয়াবহ ধস নামল। সর্বশান্ত মার্ক টোয়েনের সব ক্ষোভ গিয়ে পড়ল পরিসংখ্যানের ওপর। তিনি বললেন – “ঞযবৎব ধৎব ঃযৎবব ষরবং; ষরবং, ফধসহ ষরবং ধহফ ংঃধঃরংঃরপং.”
পাঁচ
বাসুদেব মন্ডল সোজা হয়ে বসলেন। ভাবলেন – আচ্ছা মার্ক টোয়েন কিডিমের গল্প জানতেন? আর জানলেও কী? ধস যখন নামে তখন ডিম এক ঝুড়িতে রাখাও কী? একাধিক ঝুড়িতে রাখাও কী? কিন্তু তিনি কি আগপাছ চিন্তা করেছিলেন? বাজার যত দ্রুত চাঙা হবে পরবর্তী ধস নামার সম্ভাবনাও ততই বাড়বে।
বাসুদেব মন্ডলের মাথায় এই নিয়ে লিমেরিক লেখার খেয়াল জেগেছে। তিনি তা নিয়ে ভাবলেন। একটা লিমেরিক ধরা দিয়েছে। তিনি পটাপট লিখে ফেললেন –
মিথ্যা, ডাহামিথ্যা, পরিসংখ্যান
মার্ক টোয়েনের মিথ্যার গান
যদি যেতো গভীরে
সত্য বলতো-আহারে!
রৈখিক কার্ভ কি জীবনের সোপান ?
বাসুদেব মন্ডল লেখাটির দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ থাকালেন। এরপর চোখ ফেললেন খোলা জানালায়।
দেখা যাচ্ছে নীলাকাশ। সেখানে বসেছে তারার মেলা।
বাসুদেব মন্ডলের স্বাতী নক্ষত্রের কথা মনে পড়ল। বেশ কয়েকদিন ধরে স্বাতীনক্ষত্র দেখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না।
মনে মনে বললেন – লেখার ছক মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেছে, এখন স্বাতীকে খুজি।
তিনি স্বাতী নক্ষত্রের টানে বের হলেন।