শুরু হলো ভাষার মাস

39

‘সালাম সালাম হাজার সালাম/ সকল শহীদ স্মরণে/ আমার হৃদয় রেখে যেতে চাই/ তাদের স্মৃতির চরণে/ মায়ের ভাষায় কথা বলাতে/ স্বাধীন আশায় পথ চলাতে/ হাসিমুখে যারা দিয়ে গেল প্রাণ/ সেই স্মৃতি নিয়ে গেয়ে যাই গান/ তাদের বিজয় মরণে/ বাংলাদেশের লাখো বাঙালি/ জয়ের নেশায় আনে ফুলের ডালি/ আলোর দেয়ালি ঘরে ঘরে জ্বালি/ ঘুচিয়ে মনের আঁধার কালি/ শহীদ স্মৃতি বরণে…
শুরু হল বাঙালির রক্তে রাঙানো মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার মাস ফেব্রুয়ারি। বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী ফাল্গুন মাস। এই আগুনরাঙা ফাগুন মাসেই একদিকে শোক অন্যদিকে দ্রোহী চেতনা ও অহংকারের যুগপৎ দ্যোতনা ভর করে বাঙালি জাতির চিন্তা ও মননে। ১৯৫২ সালে মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় রাজপথে বুকের তাজা রক্ত বিলিয়ে দিয়েছিলেন বাংলার অকুতোভয় দামাল ছেলেরা। সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ অনেক ভাষা-সংগ্রামীর আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাঙালির মাতৃভাষার অধিকার অর্জনের এমন গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় বিশ্ব-ইতিহাসে বিরল। ভাষা-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির ভেতরে স্বাধিকারের যে চেতনা ঠাঁই করে নিয়েছিল, তার সফল ও ঐতিহাসিক পরিসমাপ্তি টানা হয় একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে। জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধের বিজয়গাঁথা বিশ্ব পরিমন্ডলে বীর বাঙালিকে স্বাধীন জাতি হিসেবে পরিচিতি দান করে।
ঔপনিবেশিক ইংরেজ শাসনের জাঁতাকলে প্রায় দু’শ বছরের নিষ্পেষিত হয়েছিল উপমহাদেশের মানুষ। সুদীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পর ১৯৪৭ সালে ইংরেজ শাসনের অবসান হলেও কোনো লাভ হয়নি বাংলার মানুষের। ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার ফলে বাংলার মানুষ মূলত আবার বন্দী হলো পাকিস্তানি দুঃশাসনের জাঁতাকলে। যে দুঃশাসন আমাদের দেশের মানুষকে চরম দুর্ভোগ ও দুর্যোগের দিকে ঠেলে দেয়। তাই পাকিস্তানি দুঃশাসন, শোষণ, জুলুম, নির্যাতন-নিষ্পেষণ থেকে মুক্তির জন্যে বাঙালিরা স্বাধিকার ও স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখে। আর এই স্বপ্নকে বাস্তবতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যান সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান।
বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের ধ্বংস করার জন্য পাকিস্তানিরা প্রথমেই আঘাত হানে আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলার ওপর। তারা উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করে। অথচ সারা পাকিস্তানের শতকরা ৫৮ জনের মুখের ভাষা বাংলা। কাজেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি ছিল তৎকালীন সাত কোটি বাঙালির প্রাণের দাবি। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি স্বৈরশাসকরা বাঙালির ন্যায্য দাবিকে পদদলিত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা এম.এ. জিন্নাহ উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। এর তিন দিন পর ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি পুনরায় উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করার কথা উল্লেখ করেন। অবশ্য জিন্নাহ দুটি অনুষ্ঠানেই তীব্র প্রতিবাদের সম্মুখীন হন। এই অবিস্মরণীয় প্রতিবাদের নেতৃত্ব দেন শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছাত্ররা।
১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পাকিস্তানে নতুন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকার এক জনসভায় উর্দুকে রাষ্ট্রভাষার ঘোষণা দেন। বাংলার মানুষ প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তারা ডাক দেয় আন্দোলনের। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পূর্ব বাংলার সচেতন ছাত্র, শিক্ষক, সাংবাদিক, সাহিত্যিকসহ সর্বস্তরের জনতা আন্দোলনের জন্য সংগঠিত হতে থাকে এবং আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। এ আন্দোলনের চূড়ান্ত আকার ধারণ করে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রæয়ারি অর্থাৎ আটই ফাগুন। এ দিন প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশনকে সামনে রেখে সারাদেশে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ব্যাপক কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। আন্দোলনের গতিধারা দেখে তৎকালীন পাকিস্তানি সরকার ভীত হয়ে পড়ে। আন্দোলন দমাতে ২১ ফেব্রæয়ারি সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। একইসাথে সকল প্রকার মিটিং, মিছিল, সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ওইদিন হৃদয়ের গহীনে লালিত মাতৃভাষার প্রতি প্রগাঢ় মমত্ববোধ থেকে উৎসারিত অসীম সাহস সঞ্চয় করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাজপথে নেমে আসে। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’-দাবিতে রাজপথে ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। শহীদ হন সালাম, বরকত, রফিক ও জব্বারসহ অনেকে। আহত হন অগুনতি ছাত্র-জনতা। তাদের এই আত্মত্যাগ বাঙালির মাতৃভাষার আন্দোলনকে আরও শাণিত করে। ‘মরতে শেখা’ বাঙালির ভাষা-আন্দোলন ব্যাপক তীব্রতা লাভ করে। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি শাসকচক্র বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একুশের প্রথম বার্ষিকী পালন করা হয়। এ দিনের স্মরণে আয়োজিত এক সমাবেশে তিনি ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। ওই বজ্রকণ্ঠের ভাষণে তিনি বাংলা ভাষার গুরুত্বের পাশাপাশি স্বাধিকারের কথাও উল্লেখ করেন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট সরকারের একজন মন্ত্রী হিসাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা ভাষার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫৫ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সাথে সাথে বাংলার স্বাধিকারের দাবিও তোলেন। ১৯৫৬ সালে গণপরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জোর দাবি তোলা হয়। এ বছরেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি প্রদান করা হয় সাংবিধানিকভাবে। এভাবেই ভাষার লড়াইকে পর্যায়ক্রমে স্বাধিকার এবং স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার সংগ্রামে রূপ দেয়া হয় বাষট্টির শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলন, ছেষট্টির ঐতিহাসিক ছয় দফার আন্দোলন, ঊনসত্তরের ছাত্র আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের সাধারণ নির্বাচন, সর্বোপরি একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে। সশস্ত্র নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতষ্ঠা হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। স্বাধীনতা অর্জনের পর বঙ্গবন্ধু অফিস-আদালতসহ জাতীয় জীবনে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন ও ব্যবহারের নির্দেশ দেন। ১৯৭২ সালের সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে মর্যাদা দেয়া হয়। ভাষাকেন্দ্রিক জাতীয়তাবোধ সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান স্বাধীন রাষ্ট্রের সরকার প্রধান হিসেবে তিনি ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলা ভাষায় প্রথম ভাষণ দেন। এ ভাষণের মাধ্যমে তিনি বিশ্ব দরবারে বাংলা ভাষার মর্যাদাকে অনন্য মহিমা দান করেন। উক্ত ঐতিহাসিক ভাষণের ইতিহাস বাংলা ও বাঙালির গৌরবের অধ্যায়ে স্বণাক্ষরে লেখা রয়েছে।
ইতিহাসের পথ ধরে ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু-তনয়া ও জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকার গঠন করার পর পুনরায় বাঙালি জাতীয়তাবাদী ভাবধারাকে বিকশিত করার বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেন। তিনি জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে বাংলা ভাষায় ভাষণ দেন। তার সরকারের উদ্যোগেই ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণা করে। বাঙালির জাতির ইতিহাসে আরেকটি নতুন অধ্যায় সংযোজিত হওয়ার পর ২০০০ সাল থেকে বিশ্বে একশ’ ৮৮টি রাষ্ট্র প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে।