শুভ মহালয়া

49

মনোজ কুমার দেব

শুভ মহালয়া। পিতৃপক্ষ আর দেবী পক্ষের সন্ধিক্ষণই মহালয়া। ‘মহালয়’ শব্দ থেকেই মহালয়া। শ্রীশ্রী চন্ডীপাঠের মধ্য দিয়ে দেবী দুর্গার আবাহণই মহালয়া হিসেবে পরিচিত। আর এই ‘চন্ডী’তেই আছে দেবী দুর্গার সৃষ্টির বর্ণনা ও দেবীর প্রশস্তি। শারদীয় দুর্গাপূজার একটি গুরুত্বপর্ণ অনুষঙ্গ হলো এই মহালয়া। মহালয়া মানেই মৃন্ময়ী মায়ের চিন্ময়ী হয়ে উঠার শুভক্ষণ। মহালয়া মানেই শারদ উৎসবের ক্ষণগণনা শুরু। তবে চান্দ্র তিথির গণনায় প্রতি তৃতীয় বছরে একটি বাড়তি মাস বা মলমাস হওয়ায় এবছর দুর্গাপূজা আশ্বিনের পরিবর্তে কার্তিক মাসে অনুষ্ঠিত হবে।
একাধিক ধর্মীয় কাজের সমন্বয় ঘটেছে বলে এ তিথি নানা দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। মহালয়ার আগের পনের দিন পিতৃপক্ষ। এ পিতৃপক্ষ হচ্ছে পূর্ববর্তী প্রজন্মকে স্মরণ করার, পরম্পরাকে শ্রদ্ধা জানানোর এক প্রশস্ত পক্ষ। সনাতন ধর্ম অনুসারে পিতৃপক্ষে প্রয়াত পিতৃ পুরুষের আত্মার মহাসমাবেশ হয়। প্রয়াত আত্মার মহাসমাবেশকেই বলা হয় ‘মহালয়’ আর মহালয় থেকে ‘মহালয়া’ শব্দের উৎপত্তি। মহাভারতেও দাতাকর্ণের মৃত্যুর পর এ বিশেষক্ষণে পিতৃপুরুষের তর্পণের বিশেষ উল্লেখ আছে। রামায়ণেও উল্লেখিত আছে প্রয়াত পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে শ্রী রামচন্দ্রের শুভতর্পণের কাহিনী। পুরাণ মতে, মহালয়ার দিনেই দেবী দুর্গা মহিষাসুর বধের দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। দেবতাদের সম্মিলিত শক্তির ধারক দশ প্রহরণ ধারিণী দেবী দুর্গা নয় দিনের যুদ্ধে মহিষাসুরকে পরাজিত করেন আর ‘শুভ দশমী’ তিথি চিহ্নিত হয় বিজয়ের স্মারক ‘বিজয়ী দশমী’ হিসেবে। আবার তাত্তি¡ক বিশ্লেষণে ‘আলয়’ শব্দের অর্থ গৃহ। আমাদের দেহটাই পবিত্র দেবগৃহ বা দেবালয়। মহালয়ার এ দিনে এ পবিত্র দেবালয়ে জ্যোতির্ময়ী দেবীকে অধিষ্ঠানের আমন্ত্রণ জানানো হয়।
শুভ মহালয়ার সাথে সম্পর্কিত দেবী মহামায়ার আবির্ভাব কাহিনী। দেবী মহামায়ার স্বরূপ বুঝতে হলে ফিরে তাকাতে হবে পৌরাণিক যুগে। দেবী মহামায়া পরম বিদ্যা আদ্যা শক্তি। এ বিশ্ব ব্রহ্মাÐ তাঁরই দিব্য রূপ। তিনি নিত্যা, সনাতনী ও পরমেশ্বরী। এ মহামায়ারই কাহিনী বিবৃত হয়েছে পুরাণে। আঠারটি পুরাণের এক পুরাণ হচ্ছে মার্কন্ডেয় পুরাণ। সে পুরাণের শ্রীশ্রী চন্ডী মহাগ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে মহামায়া বন্দনার এক অপূর্ব কাহিনী। চৈত্র বংশীয় বিখ্যাত রাজা সুরথ সসাগরা পৃথিবীর অধিশ্বর হয়েও রাজনৈতিক চক্রান্তে রাজ্য হারা হলেন। সহযোগী ও আত্মীয় স্বজন কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে তিনি বনবাসী হলেন। একদা উপস্থিত হলেন বেদজ্ঞ মেধস মুনির শান্ত তপোবনে। দৈবচক্রে সেখানে উপস্থিত হন দারা পুত্র পরিজন কর্তৃক বিতাড়িত আরো এক ভাগ্য বিড়ম্বিত মানুষ- সমাধি বৈশ্য। রিক্ত, নিঃস্ব হয়েও নিকটজনের মায়া-মমতা তাঁরা ভুলতে পারছিলেন না। এ সমস্যা থেকে মুক্তি দেখালেন বেদজ্ঞ মহাঋষি মেধস। তাঁরই পরামর্শে রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য জগৎ পালিনীম হামায়াকে তুষ্ট করে কৃপা লাভ করলেন। বসন্তকালে এ পূজা হয়ে ছিল বলে কালক্রমে তা ‘বাসন্তী পূজা’ নামে অভিহিত হয়।
ত্রেতাযুগে শ্রী রামচন্দ্র সীতা উদ্ধারের জন্য লংকা জয়ের মানসে অকাল বোধনের মাধ্যমে দেবী মহামায়াকে জাগ্রত করেন। ‘বোধন’ শব্দের অর্থ জাগরণ। তাই মহালয়ার পর শুক্ল পক্ষের প্রতিপদে ঘট স্থাপন করে শারদীয় পূজার সূচনা করা হয়। প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য যে, শ্রাবণ থেকে পৌষ মাস দক্ষিণায়ন। এরপর উত্তরায়ন। দক্ষিণায়ন দেব তাদের বিশ্রামের কাল। তাই শরৎ কালের পূজোয় বোধন প্রয়োজন।
সার্বজনীন দুর্গোৎসবের বিশাল কর্মযজ্ঞের ক্ষণগণনা শুরু হলো আজ শুভমহালয়া থেকে। এ শুভক্ষণ থেকে আসুন আমরা ঐতিহ্যকে স্মরণ করি, পরম্পরাকে সম্মান জানাই। জগৎ জননী মায়ের সন্তান হিসেবে ভাতৃত্ব বোধে উদ্বুদ্ধ হই। পবিত্র এ ক্ষণ থেকেই শুরু হোক আত্ম জাগরণ আর আত্ম শুদ্ধির দিন।

লেখক সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ
ডা. ফজলুল-হাজেরা ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম