শুভ নববর্ষ মহামারী করোনাসহ সকল কূূপমন্ডূকতা দূর হোক

142

আজ পহেলা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষ ১৪২৭ বঙ্গাব্দ। স্বাগতম বাংলা নববর্ষ। দৈনিক পূর্বদেশের পক্ষ থেকে সকল পাঠক, লেখক, বিজ্ঞাপনদাতা ও শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা। গতকাল ১৪২৬ বঙ্গাব্দের শেষ সূর্যের অস্তের পর থেকে বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ সারাদেশের কোটি বাঙালি করোনা ভাইরাসের কারণে প্রতিকূল পরিবেশে এ দিনটিকে ঘরে বসে বরণের প্রস্তুতি নিয়েছে। নগর-মফস্বলে বৈচিত্র্যময় সবুজ প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে আজ নতুন বর্ষের নতুন দিনে দেশবাসী সংকল্প বাঁধবে ‘আজি বাঁধিতেছি বসি সংকল্প নূতন/ অন্তরে আমার/সংসারে ফিরিয়া গিয়া হয়তো কখন/ভুলিব আবার।/তখন কঠিন ঘাতে /এনো অশ্রু আঁখিপাতে/ অধমের করিয়ো বিচার। /আজি নব-বর্ষ-প্রভাতে/ ভিক্ষা চাহি মার্জনা সবার’। মহান মুক্তিযুদ্ধের পর হয়ত এবারই প্রথম কোন রকম আনুষ্ঠানিকতা ও আয়োজন ছাড়া নিবৃত নীরবে ১৪২৬ বঙ্গাব্দের বিদায় হয়। ঠিক একইভাবে বরণ করা হবে নতুন বর্ষকে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্ষবরণের সকল আনুষ্ঠানিকতা বন্ধের নির্দেশসহ সকল দেশপ্রেমিক জনতাকে ঘরে বসে দিনটি উদ্যাপনের আহবান জানিয়েছেন। বাঙালি জাতি উৎসবপ্রিয়। যেকোন জাতীয় দিবস ও নববর্ষকে বরণে বাঙালি নানা রঙে সাজায় তাদের আয়োজন। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারী করোনায় যেন সবকিছু থমকে গেছে। যার ফলে এবার বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বছরের ব্যাপক রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি থেকে শুরু করে স্বাধীনতা দিবস এবং সর্বশেষ বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সকল আনুষ্ঠানিকতা বন্ধ করে দেয়া হয়। মহামারী করোনা ভাইরাসের সর্বগ্রাসী রূপ ঠেকাতে এ পর্যন্ত কোন প্রতিষেধক বা ভেক্সিন আবিষ্কার না হওয়ায় বর্তমানে এর একমাত্র মহাষৌধ মানুষে মানুষে দূরত্বে থাকা যা ইতোমধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আমাদের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বারবার বলে আসছেন সামাজিক দূরত্ব হিসাবে।
সরকারের দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে যেকোন সামাজিক বিচ্ছিন্নতা পরিবেশ বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর। সাধারণ মানুষ সাময়িক এ বিধানকে মেনে নেবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। এ ছাড়া পান্তা-ইলিশ পহেলা বৈশাখের সংস্কৃতির অংশে পরিণত হয়েছে অনেক আগে। এবার পরিবার পরিজন নিয়ে এ ভোজনের আয়োজন করা যাবে, তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, আজ করোনার কারণে দেশের ব্যাপক মানুষ অনাহারে অর্ধহারে দিন যাপন করছেন। আজ আমরা বেশি দামের পান্তা ইলিশের ভোজন সম্ভ্রম করে বরং আমাদের প্রতিবেশি কর্মহীন নি¤œ আয়ের মানুষগুলোর জন্য একবেলা খাবারের আয়োজন করাই হবে আমাদের পক্ষ থেকে তাদের জন্য নববর্ষের বড় উপহার। সরকারপ্রধানও এবার নববর্ষের খাবারের তালিকা থেকে ইলিশ বাদ দিয়ে শাক-সবজি, পোড়া মরিচ, ভর্তা ও দেশীয় অন্যান্য মাছ রেখেছেন বলে গণমাধ্যম সূত্রে আমরা জানতে পারি। প্রধানমন্ত্রীর এ উদ্যোগ দেশের সাধারণ মানুষকে অনুপ্রাণিত করবে নিঃসন্দেহে।
এ দিবসটি বাঙালি জাতি ছাড়াও পার্বত্যজেলায় বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ- গোষ্ঠী যেমনÑচাকমাদের ‘বিঝু’, ত্রিপুরাদের ‘বৈসুক’, মারমাদের ‘সাংগ্রাই’, তংচঙ্গ্যাদের ‘বিষু’, অহমিয়াদের ‘বিহু’ এবং সর্বোপরি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বৈসাবি উৎসবের মাধ্যমে উদ্যাপন করে থাকে। বর্ষবিদায় ও বরণের আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানাদির মাধ্যমে তারা এখনও তাদের সামাজিক ঐতিহ্য ও আভিজাত্যকে সুদৃঢ় রাখার বিশেষ উদ্যোগী ভূমিকা পালন করে। নিজস্ব বর্ষপঞ্জিকার সূত্র ধরে নববর্ষের বিভিন্ন উৎসব উদ্যাপন-এর মাধ্যমে বংশ পরম্পরায় পালন করে আসছে। কিন্তু সরকারি নির্দেশনা মেনে তারাও আজকের সকল আনুষ্ঠানিকতা বন্ধ করে ঘরে বসেই উপাসনার মাধ্যমে তিনটি পালন করবেন। একইভাবে আমাদের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ঘরে বসে তাদের বর্ষবরণ উপলক্ষে পূজাপার্বণ সম্পন্ন করবেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, নববর্ষের বাংলা সনের ‘সন’ শব্দটি আরবি, ফারসিতেও এটি ব্যবহার হয়। মোগল সম্রাট আকবর ৯৬৩ হিজরি (চান্দ্রবর্ষ) ২ রবিউসসানি, ইংরেজি ১৪ এপ্রিল ১৫৫৬ সাল থেকে পহেলা বৈশাখ পালনের রেওয়াজ শুরু করেন। সৌর বৎসর (বঙ্গাব্দ) ও চান্দ্রবর্ষ (হিজরি) উভয়ের অপূর্ব সন্ধিক্ষণে রাজজ্যোতিষী আমীর ফতেউল্লাহ সিরাজীর সূ² হিসাব-নিকাশের মাধ্যমে শুভক্ষণ গণনার দিন হিসেবে ১লা বৈশাখকে নববর্ষ উদ্যাপনের দিন হিসেবে ধার্য করা হয়। এই বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হয়েছিল হিজরি সনকে উপেক্ষা করে নয় বরং হিজরি ৯৬৩ সালকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে। শুধুমাত্র ফসল তোলার সময়কে সৌরবর্ষের সাথে সামঞ্জস্য করার লক্ষে সূর্যকে মানদÐ ধরে সৌরবর্ষ অথবা ফসলিবর্ষ হিসেবে এটিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু এই সৌরবর্ষ ও চান্দ্র বৎসরের ব্যবধানকে যথাযথভাবে সংযোজিত করে নতুন বঙ্গাব্দের পরিচয় বহনে এই দিনের প্রারম্ভ। ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত এই বঙ্গাব্দের প্রচলন এবং এই নববর্ষকে বরণ করার যে অনুষ্ঠান তা সকল কিছুই মুসলমান শাসকদেরই সৃষ্ট এবং চিরায়ত বাংলা সংস্কৃতিরই বিবর্তনিক রূপ। এটি শুধু বাঙালি জাতীয় কৃষ্টিকে সমৃদ্ধ করে না, বাঙালি সমাজের কৃষি ও অন্যান্য আর্থ-সামাজিক প্রতিটি প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাÐে নতুন অলংকারে ভূষিত করে। অথচ গোষ্ঠীবিশেষ বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করার লক্ষে বিকৃত তথ্য দিয়ে বাঙালির শাশ্বত ঐতিহ্য ও কৃষ্টি চর্চায় বাধা সৃষ্টির অপপ্রয়াসে লিপ্ত হয়েছে, যা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
বাঙালি ব্যবসায়ীদের কাছে আজকের দিনটি বিশেষ তাৎপর্যবহ। ঐতিহ্যবাহী হালখাতা নিয়ে তারা আজ বছরের নিকাশ গুছাবে। তবে পরিস্থিতির কারণে তারাও ডিজিটাইলাজেশনের মাধ্যমে এ হালখাতার পাঠ চুকাবেন। আমরা বাংলার চিরায়ত এসব ঐতিহ্য চির জাগরুক থাকে- এমন প্রত্যাশর সাথে আরো কামনা করি দেশের জনজীবনে যে মহামারীর মহা দুর্যোগ তা বিতাড়িত হোক, বিপরীতে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি বয়ে আনুকÑ এ চিরায়ত বাংলা নববর্ষ।