শুভ জন্মদিন সোনার বাংলার অভিযাত্রী শেখ হাসিনা

60

অ্যাড. সালাহ্উদ্দিন আহমদ চৌধুরী লিপু

৭৪তম শুভ জন্মদিনে বাংলাদেশের সফল প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি জননেত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনাকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধাময় ভালোবাসা। ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তৎকালিন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার পাটগাতি ইউনিয়নের টুঙ্গীপাড়ার গ্রামে মধুমতি নদীর অববাহিকায় নিভৃত পল্লীতে জন্মগ্রহণ করেন। শেখ হাসিনার পূর্বপুরুষ শেখ বোরহানউদ্দিন ১৪তম শতাব্দিতে ইরাক থেকে এসে ফরিদপুরে গোড়াপত্তন করেন। বংশ পরম্পরায় তিনি তারই বংশধর। তিনি ১৯৫৪ সালে পরিবারের সাথে ঢাকায় আসেন। ১৯৬১ সালের ০১ অক্টোবর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের ৬৭৭ নং বাড়িটিতে তিনি স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনা ১৯৯৪ সালের ১৪ আগস্ট বাড়িটি জাদুঘরে রূপান্তর করে বঙ্গবন্ধু ট্রাষ্টকে হস্তান্তর করা হয়। ১৯৫৬ সালে তিনি প্রথমে ঢাকার টিকাটুলিতে নারী শিক্ষা মন্দির বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৬৫ সালে আজিমপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় হতে এস,এস, সি, ১৯৬৭ সালে বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা মহাবিদ্যালয় হতে এইচ, এইচ, সি এবং ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্নাাতক ডিগ্রি পাস করেন। তৎকালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সদস্য, রোকেয়া হল শাখার সাধারণ সম্পাদক, সরকারি ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ভিপি, ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও পরে সভাপতি ছিলেন। রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার ফতেহপুরের অধিবাসী প্রখ্যাত পরমাণু বিজ্ঞানি ড. ওয়াজেদ মিয়ার সাথে ১৯৬৭ সালের ১৭ নভেম্বর তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ড. ওয়াজেদ মিয়া ১৯৬১ সালে ঢাকা বিম্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল ছাত্র-সংসদের ভিপি ছিলেন। ১৯৬৭ সালে তিনি লন্ডনের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন এবং তিনি ১৯৯৯ সালে চেয়ারম্যান পদ হতে অবসর গ্রহণ করেন। ড. ওয়াজেদ মিয়া ২০০৯ সালের ০৯ মে ৬৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তাদের দাম্পত্যজীবনে পুত্র সজিব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুল জন্মলাভ করেন। শেখ হাসিনার পিতামহ শেখ লুৎফুর রহমান ও মাতামহি সায়েরা খাতুন। চার ফুফু যথাক্রমে শেখ ফাতেমা বেগম, শেখ আছিয়া বেগম, শেখ আমেনা বেগম ও শেখ খোদেজা বেগম, একমাত্র চাচা শেখ আবু নাছের। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠন করলে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করা হয়। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি থেকে ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ছিলেন এবং তিনি ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি হতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করে সরকার পরিচালনকালিন সময়ে বিশ্বাসঘাতকের দলের হাতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে নিহত হন।
জাতির এক ক্রান্তিলগ্নে ১৯৮১ সালের ১৩-১৫ ফেব্রæয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বি-বার্ষিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাকে দলের সভাপতি নির্বচিত করা হয়। ১৯৭৫ সালের পট পরিরবর্তনের পর দীর্ঘ ৬ বছর নির্বাসিত জীবন শেষে শেখ হাসিনা হাজারো প্রতিকুলতার মাঝে ১৯৮১ সালের ১৭ মে মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তন করে দলের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শেখ হাসিনা গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে অনেকবার কারাবরণ করতে হয়। প্রতিপক্ষগণ শেখ হাসিনাকে মোট ২১ বার হত্যার প্রচেষ্টা করে, কিন্তু তিনি স্রষ্টার কৃপায় অলৌকিক ভাবে বেঁচে যান। অনেক সংগ্রাম, ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রথমবার ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন, দ্বিতীয়বার ২০০৯ সালের ০৬ জানুয়ারি এবং তৃতীয়বার ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি, চতুর্থবার, ২০১৯ সালের ০৭ জানুয়ারি সহ সর্বমোট পাঁচ মেয়াদে সরকার গঠন করে।
বঙ্গবন্ধুর রক্তের বাহক শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনার আত্মজীবনী নিয়ে রচিত তথ্যচিত্র ‘হাসিনা এ ডটরস টেল’ দেখে সত্যই খুবই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। এ অসামান্য প্রামণ্য দলিলটি দেখে জানতে পেরেছি, বঙ্গবন্ধু সপরিবারে হত্যাকান্ডের পর তাদের দুর্বিসহ নির্বাসিত জীবন কিভাবে কেটেছে। এমনকি নির্বাসনে তারা নিজের নামটি পর্যন্ত ব্যবহার করতে পারেনি। উদ্বাস্তু হিসেবে তাদের ভারতে থাকতে হয়েছে। তারা গোটা পরিবারকে হারিয়ে বাস্তবের মুখোমুখি হলেন। দেখলেন চেনা ও কাছের মানুষগুলো হঠাৎ পরিবর্তিত হয়ে অচেনা রূপধারণ করলেন। তৎকালিন পররাষ্ট্রসচিব হুমায়ুন রশীদ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাগন্ধী ব্যতীত আর্থিক বা অন্যান্যভাবে তাদেরকে সাহায্য সহযোগিতা করেননি। শেখ হাসিনা ৬ বছর রাজনৈতিক আশ্রয়ে ভারতে নির্বাসিত জীবন অতিক্রান্ত করেন।
শেখ হাসিনা একজন নির্মোহ, নির্লোভ নারী এবং তিনি অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপন করেন। আত্মপ্রত্যয়ী ও দৃঢ়চেতা নারী ক্ষমতার গন্ডির মধ্যে থেকেও তিনি ক্ষমতার ভোগ বিলাসিতায় মত্ত হননি। শেখ হাসিনা ভীষণ পরিশ্রমী, নিষ্ঠাবান ও ধর্মপরায়ন নারী। তার কাছে নেই কোন ক্ষমতার অহংকার, দম্ভ ও গৌরব। গত ৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, “সকালে উঠে আমি জায়নামাজ খুঁজি, নামাজ পড়ি। নামাজ শেষে কোরআন তেলাওয়াত করি। তারপর এক কাপ চা টা আমি নিজে বানিয়ে খাই। ছোটবোন বাসায় থাকলে দুজনের যে আগে ওঠে সে বানায়। মেয়ে পুতুল আছে। সেও আগে উঠলে বানায়। আমরা নিজেরা করে খাই। তার আগে বিছানা থেকে ওঠার আগে নিজের বিছানাটা নিজে গুছিয়ে রাখি। এরপর বই-টই যা পড়ার পড়ি। আর ইদানীং করোনাভাইাসের পরে সকালে একটু হাঁটতে বের হই। গণভবনে একটি মাছের লেক রয়েছে। হাঁটার পরে লেকের পাড়ে যখন বসি, তখন ছিপ নিয়ে বসি মাছ ধরি। পিতা বঙ্গবন্ধুর কাছে উল্লেখ করে বলেন, আব্বার নির্দেশ ছিল-একজন রিকশাওয়ালাকেও আপনি বলে সস্বোধন করতে হবে। ড্রাইভারকে ড্রাইভার সাহেব বলতে হবে। কাজের যারা লোকজন তাদের কখনও চাকর-বাকর বলা বা হুমকি দেয়া যাবে না। তাদের কাছে কিছু চাইতে হলে ভদ্রভাবে চাইতে হবে। এ কারণে আমি প্রধানমন্ত্রী হতে পারি, তারপরও আমার বাড়িতে গৃহপরিচালিকা যারা আছে, কারো কাছে যদি এক গ্লাস পানিও কখনও চাইতে হয়, তাদের জিজ্ঞাসা করি, আমাদের একটু এটা দিতে পারবে? এই শিক্ষাটা বাবা দিয়ে গেছেন। এখনও মেনে চলি। আমরা সবাইকে সমানভাবে সমাদর করি। বরং যাদের কিছু নেই তাদের দিকে একটু বেশি নজর দিই।” তার মানবিক গুণাবলি প্রবাদতুল্য, তিনি বাংলাদেশের একজন আইডল। সুদীর্ঘ ৭১ বছরের পুরানো এই সংগঠন ৩৯ বছর নিরবচ্ছিন্ন নেতৃত্ব দিয়ে, মৃত্যুকে জয় করে শেখ হাসিনা অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক ভাবধারার প্রতিকে পরিণত হয়েছে এবং বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ। প্রযুক্তি,রন্ধন, সঙ্গীত ও বইপড়ায় তার বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। তিনি অনেক গুণে গুণান্বিত। শুধু একজন প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদও নয়, একজন লেখিকাও। হাজারো ব্যস্ততার মাঝেও তিনি সৃজনশীল লেখনিতে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩০টি গ্রন্থ রচনা করেছেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, শেখ মুজিব আমার পিতা, আমাদের ছোট রাসেল সোনা, অসমাপ্ত আত্মজীবনী (গ্রন্থে রূপান্তর), আমার স্বপ্ন আমার সংগ্রাম, আমরা জনগণের কথা বলতে এসেছি, বাংলাদেশের স্বৈরতন্ত্রের জন্ম, সামরিকতন্ত্র বনাম গণতন্ত্র, বিপন্ন গণতন্ত্র, ওরা টোকাই কেন, দারিদ্র্য বিমোচন কিছু কথা, সাদাকালো, সবুজ মাঠ পেরিয়ে, PEOPLE AND DEMOCRACY, THE QUEST FOR VISION-2021.

শেখ হাসিনা গণতন্ত্র, শান্তি ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও জীবনমান উন্নয়নে অনন্য অবদানের জন্য ৩০টির অধিক পুরস্কার অর্জন করেছেন। এছাড়া শেখ হাসিনাকে ভারতের ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়, বেলজিয়ামের ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্রের ব্রিজপোর্ট বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকার বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়, আ্যবাটয় বিশ্ববিদ্যালয়, জাপানের ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব লিবারটি ও বৃটেনের ডানডি বিশ্ববিদ্যালয় সন্মান সূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করেন।
দেশরত্ম শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ সমৃদ্ধি ও অগ্রগতির পথে এগিয়ে চলেছে। শুধু বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়ক নয়, আন্তর্জাতিক নেতা হিসেবে ইতিমধ্যে বিশ্বমত ও নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণে তিনি সক্ষম হেেয়ছেন। অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা, মেধা, বিচক্ষণতা, আত্মপ্রত্যয় ও দুরদর্শিতার কারণে তিনি এখন বিশ্বনেত্রী। বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে আজ তিনি সমাসীন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এগিয়ে যাচ্ছেন দৃঢ় ও দীপ্ত পদক্ষেপে দেশের গন্ডি অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বিশ্ব ভাবনাকে সম্মুখে রেখে সিদ্ধান্ত জানাতেও পিছপা নন। শেখ হাসিনা দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতি নিয়ে ক্ষমতায় আরোহন করলেও তাঁর দুরদর্শী বিভিন্ন পদক্ষেপে বাংলাদেশের অর্থনীতি আজ মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। একটি স্বয়ং সমপূর্ণ ও সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে গড়ে উঠেছে। তিনি আজ নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অন্যন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, যে কারণে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের জন্য রোল মডেল। দেশ ও বিশ্ব পরিমÐলে শেখ হাসিনা আজ গণতন্ত্র, উন্নয়ন, ন্যায়বিচার ও শান্তির প্রতিক। বিশ্ব বিখ্যাত ফোর্বস ম্যাগাজিন জরীপে বিশ্বের ৪৭তম ক্ষমতাধর নারী শেখ হাসিনা। যুক্তরাষ্ট্রের সাময়িকি ফরচুনে প্রকাশিত তালিকা মতে, বিশ্ব সেরা ৫০ নেতার মধ্যে শেখ হাসিনা দশম স্থানে। কানাডার আন্তর্জাতিক উন্নয়ন মন্ত্রী মেরী ক্লদ বিবেউ বলেছেন, শেখ হাসিনা নারীর ক্ষমতায়নে দক্ষিণ এশিয়ার স্তম্ভ।
প্রধানমন্ত্রী নিজের জীবনের চেয়ে দেশ ও দেশের জনগণকে বড় মনে করেন। তাই নিজের জীবনের ঝুঁকি থাকা সত্তে¡ও এই করোনা মহামারিতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। জীবন জীবিকা নিশ্চিত করতে এখন পর্যন্ত ১ লাখ ১২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার ২১ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন এবং হতদরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য নগদ অর্থ প্রণোদনা ও ১০ টাকা মূল্যের চাল প্রদান করেছেন এবং বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় শেখ হাসিনার গৃহীত পদক্ষেপের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সাময়িকী ফোর্বসে প্রকাশিত এক নিবন্ধে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই জাতির পিতার ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে উঠবে এই প্রত্যাশা। আজকের শুভদিনে প্রিয়নেত্রীর সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি।
লেখক : কলামিস্ট, রাজনীতিক
Email-advlipu@gmail.com