শুঁটকির গন্ধই ঘুম ভাঙায় তাদের

140

শুঁটকি, আমাদের চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষের জনপ্রিয় একটি খাবারের নাম। শুঁটকির কথা বললে জিভে জল আসে না এমন মানুষ খুব কমই খুঁজে পাওয়া যাবে। শুঁটকির বিভিন্ন রকম রেসিপি নিয়ে আছে নানা লোককথা। গ্রামের মহিলারা শুঁটকির ঝোল, শুঁটকির ভর্তা সহ নানা রকম লোভনীয় আইটেম তৈরি করে।
গভীর সমুদ্র থেকে নিয়ে আসা মাছ বেশিক্ষণ সংরক্ষণ করার সুযোগ থাকে না। তাই এসব মাছ লবণ দিয়ে রোদে শুকিয়ে প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি হয় শুঁটকি। রোদ্র ঝলমল আবহাওয়া শুঁটকি উৎপাদনে বেশ উপযোগী। তাই ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন বাকলিয়ার কর্ণফুলী পাড়ের শুঁটকি শ্রমিকেরা। আগামী নয় মাস তাদের কাছে শুঁটকি তৈরির ভরা মৌসুম।
বাকলিয়া শুঁটকি পল্লীতে গিয়ে দেখা যায়, প্রচন্ড রোদের মধ্যেও কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন শ্রমিকেরা। কেউ মাছ রোদে দিচ্ছেন, কেউ মাচাং তৈরি করছেন। কেউ কেউ ব্যস্ত তাদের জন্য থাকার ঘর তৈরিতে। সমুদ্র থেকে মাছ নিয়ে বোট (মাছ ধরার নৌকা) আসলে তাদের কর্মব্যস্ততা আরও বেড়ে যায়। এসব শ্রমিকের অধিকাংশ বাঁশখালী, মহেশখালী ও পেকুয়াসহ দক্ষিণ চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজারের বিভিন্ন উপজেলা থেকে এসে এখানে অস্থায়ী বসতি স্থাপন করেছেন। প্রতিদিন এখানে কাজ করছেন হাজার দেড়েক শ্রমিক। এদের অধিকাংশই নারী।
কয়েক বছর ধরে শুঁটকি তৈরির কাজ করছেন রুমি আক্তার। বাড়ি বাঁশখালীর ছনুয়া এলাকায়। স্বামী খুব একটা খোঁজ-খবর নেন না। তাই দুই সন্তানের ভরণপোষণ যোগাতে শুঁটকি তৈরির কাজ করেন। এখানে কাজ করে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হচ্ছেন বলে জনান তিনি। বিভিন্ন প্রজাতির শুঁটকি এখানে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এর মধ্যে ছুরি, ফাইস্যা, লইট্যা, লাক্কা, চিংড়ি, রূপচাঁদা, হাঙ্গর ও পদুমনি (চাকমাদের কাছে জনপ্রিয় এক ধরনের মাছ) অন্যতম । তবে বাজারে ছুরি ও লইট্যা শুঁটকির বেশ কদর। প্রতি কেজি ছুরি মানভেদে ৪৫০ টাকা এবং ফাইস্যা প্রতি কেজি ৩৫০ টাকায় বিক্রি হয়। প্রতি মৌসুমে এখানে প্রায় ২০ হাজার মেট্রিক টনের অধিক শুঁটকি উৎপাদিত হয়। উৎপাদিত এসব শুঁটকি সরবরাহ করা হয় দেশের বিভিন্ন পাইকারি বাজারে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি হচ্ছে বিভিন্ন দেশে।
পাঁচ বছর ধরে শুঁটকি পল্লীতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে আসছেন জাকের হোসেন। তিনি বলেন,‘সাম্প্রতিক সময়ে পদুমনি (চাকমাদের কাছে জনপ্রিয় এক ধরনের মাছ) মাছের চাহিদা বেশি। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের কাছে এ মাছ বেশ জনপ্রিয়। প্রতিকেজি এক হাজার থেকে ১২শ টাকায় বিক্রি হয়। রূপচান্দা ও লাক্কা মাছ বিদেশে রপ্তানি করা হয়। তবে বর্তমানে এ ধরনের মাছ খুব একটা পাওয়া যায় না।’
পার্শবর্তী দেশ ভারত থেকে শুঁটকি আমদানি, লবণের দাম বৃদ্ধি, আড়তদারের অতিরিক্ত কমিশন, সিন্ডিকেট বাণিজ্য সহ বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত এই ব্যবসা হুমকির মুখে বলে জানান শুঁটকি কিল্লার (শুঁটকি তৈরির কারখানা) মালিক মোদাচ্ছের আলী।
তিনি বলেন, ‘ভারত থেকে আমদানি করা শুঁটকি কারণে আমাদের তৈরি শুঁটকির চাহিদা দিন দিন কমে যাচ্ছে। সিন্ডিকেট দাম নিয়ন্ত্রণ করার ফলে আমরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।
বর্তমানে শুঁটকির উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেলেও সে অনুপাতে দাম পাচ্ছে না। বাপ-দাদার ঐতিহ্য ধরে রাখতে লোকসান দিয়েও ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। যদি ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত এবং ভারত থেকে শুঁটকি আমদানি বন্ধ করা না হয় তাহলে অচিরেই এই ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।