শীতের সুখ শীতের অসুখ

179

ঋতু পরিক্রমায় শীতের মাস পৌষ ও মাঘ। কার্যত এর ব্যাপ্তিকাল আরও দীর্ঘ। নভেম্বর থেকে মধ্য ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শীতের মৌসুম। যদিও জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণে শীতের প্রকৃত রূপ প্রকৃতিতে যেভাবে প্রতিফলিত হওয়ার কথা তা সেভাবে প্রতিফলিত হয় না। গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠদের মতে শীতের জন্মমাস ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি। শীতের জন্মকথা নিয়ে বাংলাদেশের একজন ছড়াকারের একটি ছড়ার উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে।


তিনি লিখেছেন, ভাদ্র মাসে শীতের জন্ম/ আশ্বিন হলো শৈশব/ কার্তিকে দেয় কৈশোরে পা/ কাঁথা কম্বল কই সব/ অঘ্রাণে সে তাগড়া জোয়ান/বরুমতির বান/ পৌস মাসে গেছো ভূতের/ প্রাণ করে আনচান/ মধ্য মাঘে বাঘের সাথে/ শীতের কোলাকুলি/ ঝিম ধরা সে হিমের কথা/ কেমন করে ভুলি/ফাগুন এলে আগুন জ্বেলে শীতকে করে ধাওয়া/ এভাবে হয় শীতের আসা/ এবং চলে যাওয়া।
উপর্যুক্ত ছড়া এবং বয়োজ্যেষ্ঠদের ধারণা থেকে আমরা বুঝতে পারি শীতের শুরু ভাদ্র মাসে এবং শেষ ফাল্গুন মাসের প্রথম পক্ষে। যদিও বাস্তবে শীতের দাপট দেখা যায় বড়জোর দশ থেকে বিশ দিন। তবে শীতের আগমনী বার্তা শীতের মূল সময়ের অনেক আগেই শুরু হয়ে যায়। হেমন্তের শুরুতেই ধানক্ষেতে বা ঘাসের ওপর শিশির বিন্দুর দেখা মেলে। এ কারণে অনেক আগে শীতকালকে বলা হতো শিশির। তারও আগে পৌষ ও মাঘ মাসকে বলা হতো হিম ঋতু। শিশির পরবর্তীতে শীতকাল আর শিশির হেমন্তকাল হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
বাংলাদেশে শীতের সকালের দৃশ্য বড় রূপময়, তবে এ রূপময় দৃশ্য শহরে কদাচিৎ দেখা পাওয়া যায়। এ অপরূপ দৃশ্য দেখার ইচ্ছে যদি কারো হয় তাহলে আপনাকে একবার রবিঠাকুরের ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলোতে যেতে হবে। অথবা যেতে পারেন জীবনানন্দের ধানসিঁড়িটির তীরে। তাও যদি সময় করে উঠতে না পারেন অন্তত একবার যেতে পারেন আল মাহমুদের কর্ণফুলির কূলটায়। যত দূর চোখ যায় দেখতে পাবেন একটা বিশাল সাদা চাদর আর সেই চাদরের নিচে ঘুমিয়ে আছে আদিগন্ত জনপদ। সে বিশাল সাদা চাদর ভেদ করে এক সময় সূর্য উঁকি মারে। সেই উঁকি মারার মুহূর্তটা কী যে অপূর্ব তা মোটেই ভুলবার মতো নয়, ঠিক যেন তা— মগডালে কাঁচা রোদ করে ঝিকিমিকি। দূর্বাঘাসে, ফুলে ফলে রাতে জমে থাকা শিশির বিন্দুগুলো মিষ্টি রোদে স্বচ্ছ মুক্তোদানার মতো মনে হয়। এ কারণে শীত অন্য ঋতুর চেয়ে ভিন্নমাত্রা বহন করে, যা ঋতু বৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। শীত ঋতু তাই সুখ ও ভোগের ঋতু। বিচিত্র ফুল, ফল, রঙিন শাক সবজি, খেজুর রস, রকমারি পিঠাপুলি সরোপরি পরিযায়ী পাখির অবাধ স্বাধীনতার ঋতু শীত।
শীত ঋতু সুখ, ভোগ ও পরিযায়ী পাখির সৌন্দর্যের আধার হলেও এ ঋতুর অসুখ তথা দুর্ভোগের কিন্তু কমতি নেই। প্রকৃতির বুকে যতটা আর্দ্রতা থাকে তার সবটুকু চুষে নেয় শীত। ফলে আর্দ্রতা হারিয়ে প্রকৃতি হয়ে ওঠে রুক্ষ ও শুষ্ক। গাছের পাতা বিবর্ণ হয়ে ঝরে পড়ে। মাঠে-ঘাটে সবুজের হাতছানি চোখে পড়ে না। প্রকৃতি যেন হয়ে পড়ে প্রাণহীন। শুধু উদ্ভিদ জগতে নয়, জীব জগতেও শীতের রুক্ষতা ও শুষ্কতা আরও প্রকট রূপ ধারণ করে। মানব শরীরের ত্বক আর্দ্রতা হারিয়ে ফেলে। কারো ঠোঁট, কারো পায়ের তালু গ্রীষ্মের মাটি ফেটে চৌচির হওয়ার মতো হয়ে যায়। আর শীত যদি তীব্র আকার ধারণ করে তাহলে আর কারো রক্ষে নেই। শীতের তীব্রতা বাড়লে জনজীবন ব্যাহত হয়। তাপমাত্রা যত কমতে থাকে মানুষের দুর্ভোগও তত বাড়তে থাকে। প্রচন্ড ঠান্ডায় মানুষ অনেক সময় মৃত্যুমুখে পরিণত হয়। এ অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু ঝুঁকিতে থাকে শিশু ও অশীতিপর মানুষেরা।
বিশেষত শীতের শুরুতে কিংবা তীব্র শীতে জনজীবনে যে দুর্ভোগ নেমে আসতে পারে তার জন্যে আগেভাগে প্রস্তুতি থাকা দরকার। দাপুটে শীতে কাবু হয়ে মানুষ কাঁপতে থাকে ঠক ঠক করে। জনজীবন হয়ে পড়ে স্থবির। যাদের পাকা বাড়িঘর, গরম কাপড় চোপড় আর লেপ কাঁথা রয়েছে তাদের কোন কষ্ট হয় না। তাদের জন্য রাতের ঘুম হয় খুব আরামের, খুব আয়েশের। কিন্তু যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা তাদের দিনকাল হয়ে পড়ে কাহিল। দেশের উত্তরাঞ্চলে অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে শীতের তীব্রতা বেশি হয়ে থাকে। এসব এলাকায় গরম কাপড়ের অভাবে অশীতিপর মানুষের দুর্ভোগের মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। এ সময় ছোটদের অবস্থা হয় আরও করুণ।
পুরো শীতকাল জুড়ে ছোটদের পাশাপাশি বড়রা নানা রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তারমধ্যে রয়েছে সাধারণ সর্দিজ্বর, কাশি, ব্রংকাইটিস, টনসিলের প্রদাহ, নিউমোনিয়াসহ নানা রোগ। এমনকি সাধারণ সর্দিজ্বর থেকে তীব্র ব্রংকাইটিস, নিউমোনিয়া বা নাকের সংক্রমণেরও ঝুঁকি থাকে। সাধারণ সর্দি-জ্বরের পাশাপাশি ছোটরা রোটা ভাইরাসে এবং নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। শীতের সময় ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের একটা বড় অংশ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। রোটা ভাইরাস নামক এক ধরণের ভাইরাসের মাধ্যমে এই রোগ শিশুদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। শিশুর মা-বাবা এবং পরিবারের অন্য সদস্যরা একটু সচেতন হলেই আমাদের শিশুরা রক্ষা পেতে পারে এই রোটা ভাইরাসজনিত ডায়রিয়া থেকে। এই ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে পরিবারের সকলের সঠিকভাবে হাত ধোয়ার ওপর জোর দিতে হবে। পাশাপাশি শিশুর হাত যেন সব সময় পরিষ্কার থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ছোট শিশুরা প্রায় সময় নিজেদের হাত মুখে দিয়ে থাকে। তাই শিশুরা যাতে নোংরা হাত মুখে না দেয় তা সব সময় নিশ্চিত করতে হবে। এ ব্যাপারে মা-কে বিশেষভাবে শিশুর প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
শীতকালের আরেক রোগের নাম নিপাহ ভাইরাস। বাদুড় কাঁচা খেজুরের রস খাওয়ার সময় রসে এই ভাইরাস ছড়িয়ে থাকে। শীতের মৌসুমে কোনো ব্যক্তি যদি কাঁচা খেজুরের খেয়ে থাকে তখন এই রোগ মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়। স¤প্রতি সরকারের রোগতত্ত¡, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) মৌসুমী রোগ সম্পর্কে এক অবহিতকরণ সভার আয়োজন করে। সভায় প্রদত্ত বক্তব্য থেকে জানা যায়, এখন থেকে ১৮ বছর আগে (২০০১ সালে) বাংলাদেশে প্রথম নিপা ভাইরাস রোগ সনাক্ত হয়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত (২০১৯) ৩১৩ জন নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত করেছে আইইডিসিআর। এর মধ্যে মারা গেছে ২১৭ জন। শতকরা হিসেবে এই রোগে মৃত্যুর হার প্রায় ৭০ শতাংশ। (তথ্যসূত্র : প্রথম আলো তাং ১৯/১১/২০১৯)
উপর্যুক্ত তিনটি রোগই প্রতিরোধযোগ্য। শীতের মৌসুমে কিছু বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন বা সচেতন হলেই খুব সহজেই সাধারণ সর্দি-জ্বর, থেকে মুক্ত থাকা যায়। সাধারণ সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত হলে হাঁচি বা কাশি দেওয়ার সময় মুখে হাত বা রুমাল ব্যবহার করা উচিত। উন্মুক্তভাবে হাঁচি বা কাশি দেওয়া যাবে না। সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির সঙ্গে করমর্দন করা উচিত নয়। রোটা ভাইরাস প্রতিরোধে একমাত্র উপায় সঠিকভাবে হাত ধোয়া। ডায়েরিয়ায় আক্রান্ত শিশুর পরিচর্যার পর মা-কে বা শিশুর পরিচর্যাকারীকে সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিতে হবে। এতে কোনো রকম অবহেলা থাকলে সেই হাতের মাধ্যমে বাড়ির অন্য শিশুও আক্রান্ত হতে পারে। নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ও অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু প্রতিরোধে কোনোভাবেই কাঁচা খেজুরের রস, বাদুরের খাওয়া ফলমূল খাওয়া যাবে না। যে কোনো ধরনের ফলমূল খাওয়ার সময় ভালো করে ধুয়ে খেতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তুলতে প্রত্যেক শিক্ষিত মানুষকে ভূমিকা রাখতে হবে। গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষের জানা থাকার কথা নয় কাঁচা খেজুরের রস খেলে নিপাহ ভাইরাস হয় এবং এই রোগে মৃত্যুর সম্ভাবনা খুব বেশি। সুতরাং নিপাহ ভাইরাস থেকে বাঁচতে হলে কাঁচা খেজুরের রস এবং বাদুরের আংশিক খাওয়া ফলমূল খাওয়া থেকে যে কোনো বয়সের মানুষকে বিরত রাখতে হবে। একমাত্র সাধারণ মানুষের সচেতনতাই রোধ করতে পারে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু। আসুন আমরা নিজেরা সচেতন হই এবং অন্যকে সচেতন করে নাগরিক দায়িত্ব পালন করি।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও কলামিস্ট