শীতেও খেয়ালি প্রকৃতি

65

আকাশ তো একটাই। অথচ প্রকৃতির কেমন খেয়ালি আচরণ। দেশভেদে আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতিতে তো ভিন্নতা আছেই, এমনকি একইসময়ে দেশের অভ্যন্তরেই অঞ্চলভেদে প্রকৃতির ভিন্ন আচরণও যেন ধীরে ধীরে চিরপরিচিত রূপ লাভ করতে চলেছে। চলতি শীত মৌসুমেও প্রকৃতি খেয়ালি আচরণের পদচিহ্ন রেখে যাবে বলেই মনে করছেন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা। মনে করবেন নাইবা কেন? পৌষের শেষ পক্ষে এসে দেশের উত্তরারঞ্চলে তাপমাত্রার পারদ যখন ক্রমেই নিচের দিকে নেমে হাঁড়কাপানো শৈত্যপ্রবাহে জনজীবনকে বিপর্যস্ত করছে, ঠিক তখনই চট্টগ্রামসহ দেশের পূর্বাঞ্চলে প্রতিদিনই তাপমাত্রা উল্টো চড়ছে। তবে গ্রামাঞ্চলে হালকা শীতের সাথে কুয়াশার চাদর বাংলা বর্ষপঞ্জিকার হিসাব ধরে বলছে, ঋতু পরিক্রমায় এখন শীতকাল।
প্রকৃতিতে বিরাজমান এই খেয়ালিপনার মধ্যেই আবহাওয়া অধিদপ্তর তাদের দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসজনিত নিয়মিত বৈঠক সম্পন্ন করেছে। দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস দিতে আবহাওয়া অধিদপ্তরের গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি গত মঙ্গলবার বৈঠক শেষে আভাস দিয়েছে, কিছুদিন ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে বয়ে যাওয়া মৌসুমের প্রথম শৈত্যপ্রবাহের বিদায়ের পর চলতি জানুয়ারি মাসেই আরও অন্তত দুটি শৈত্যপ্রবাহ তীব্র রূপ নিতে পারে। গত ডিসেম্বরে যাত্রা শুরু করা পৌষ মাস বিদায় নেবে জানুয়ারির মাঝামাঝিতে। তারপর শুরু মাঘের। এসময় দেশে সর্বনি¤œ তাপমাত্রা চার ডিগ্রি পর্যন্ত নিচে নামার আভাস রয়েছে। তবে খনার বচন মেনে ‘মাঘের শীতের বাঘ পালাবে’ কিনা তা দেখতে হলে অপেক্ষা ছাড়া গত্যন্তর নেই। কেননা আবহাওয়াবিদরা এমন প্রশ্নের জবাব মুচকি হাসাতেই সীমাবদ্ধ রেখেছেন!
আবহাওয়ার সম্ভাব্য গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে জানুয়ারিতে সামগ্রিকভাবে দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা আছে জানিয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক সামছুদ্দিন আহমেদ বলেন, এ মাসে দেশে দু-তিনটি মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে, যার মধ্যে দুটি তীব্র শৈত্যপ্রবাহে রূপ নিতে পারে। এসময় দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্বাঞ্চল, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল, মধ্যাঞ্চলে ও নদ-নদী অববাহিকায় মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা এবং অন্যত্র হালকা থেকে মাঝারি কুয়াশা পড়তে পারে। ঘন কুয়াশা পরিস্থিতি কখনও কখনও দুপুর পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। সদ্য শেষ হওয়া ডিসেম্বর মাসে সারাদেশে স্বাভাবিকের চেয়ে ২১ দশমিক তিন শতাংশ বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম, বরিশাল ও রংপুর বিভাগে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাত হয়েছে, কিন্তু অন্যান্য বিভাগে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে।
অধিদপ্তরের রেকর্ডকৃত তথ্যানুযায়ী, চলতি শীত মৌসুমে দেশজুড়ে আবহাওয়া পরিস্থিতিতে নাটকীয়তা পরিলক্ষিত হয়েছে। সদ্য বিদায়ী ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের মাঝামাঝি থেকে দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকাজুড়ে মৌসুমের প্রথম শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। পঞ্চগড়, রংপুর ও রাজশাহীসহ কোথাও কোথাও তা তীব্র আকার ধারণ করে। পৌষের প্রথম পক্ষে শুরু হওয়া শৈত্যপ্রবাহ দ্বিতীয় পক্ষেও অব্যাহত রয়েছে। শৈত্যপ্রবাহকবলিত অঞ্চলের প্রভাবে পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতেও বেড়েছে শীতের তীব্রতা। গত বছরের শেষদিন মানে ৩১ ডিসেম্বর সকালে শৈত্যপ্রবাহকবলিত উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় সর্বনিম্ন পাঁচ দশমিক এক ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করে আবহাওয়া অধিদপ্তর। বিদায়ী বছরে সেটাই ছিল মৌসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। কিন্তু নতুন বছরের দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ গত দুই জানুয়ারি সেখানে মৌসুমের এখন পর্যন্ত সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। এদিন সকালে সেখানে তাপমাত্রা ছিল চার দশমিক নয় ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর গতকাল বৃহস্পতিবার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা তেঁতুলিয়ায় রেকর্ড করা হলেও সংখ্যায় তা ছিল পাঁচ দশমিক আট ডিগ্রি সেলসিয়াস।
অপরদিকে দেশের পূর্বাঞ্চলের আবহাওয়ায় বিরাজ করছে উল্টো পরিস্থিতি। চলতি শীত মৌসুমে পৌষের শুরু থেকে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হচ্ছে চট্টগ্রামেই। এ অঞ্চলের মধ্যে সন্দ্বীপ ও সীতকুন্ড বিদায়ী ডিসেম্বরের একেবারে শেষদিকে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা সিঙ্গেল ডিজিটে নেমে এলেও দু’দিন পর আবার তা লাফিয়ে দুই থেকে চার ডিগ্রি পর্যন্ত বেড়ে যায়। এরপর অবশ্য স্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে। গতকাল বৃহস্পতিবারও যথারীতি দেশের সর্বোচ্চ ২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে সীতাকুন্ড ও কক্সবাজারে। আর চট্টগ্রাম অঞ্চলে সর্বনিম্ন দশ দশমিক পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাও রেকর্ড করা হয়েছে ওই সীতাকুন্ডেই।
আবহাওয়াবিদদের ভাষ্য অনুযায়ী, দেশে শীতকালে সূর্য থাকে দক্ষিণ গোলার্ধে। ২২ ডিসেম্বর হচ্ছে সবচেয়ে ছোট দিন। এই সময় সূর্য সবচেয়ে দূরে থাকে। এ কারণে ডিসেম্বরে তাপমাত্রা কম থাকে। ২২ ডিসেম্বরের পর থেকে সূর্য ধীরে ধীরে উত্তর গোলার্ধের দিকে যেতে থাকে। বসন্ত বা ফেব্রুয়ারির প্রথম ও দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে তাপমাত্রা পুনরায় ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে। মার্চে গিয়ে তা অনেক বেড়ে যায়। আবহাওয়াবিশারদরা একে ‘জেট উইন’ বলে থাকেন। পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে ইউরোপে সূর্য অনেক দূরে থাকে। রাতের তাপমাত্রা অনেক কম থাকে। এ সময় প্রকৃতিতে একধরনের হিম শীতল বাতাস আসে, ওই বাতাস কাশ্মীর, দিল্লি, উত্তর প্রদেশ, বিহার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এই চ্যানেল দিয়েই শীতের ঠান্ডা হাওয়া দেশের উত্তরাঞ্চল অর্থাৎ চুয়াডাঙ্গা, রাজশাহী, রংপুর হয়ে ধীরে ধীরে দেশজুড়ে বিস্তৃতি লাভ করে।
উল্লেখ্য, আবহাওয়াবিদরা চার থেকে ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ, ছয় থেকে আট ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে মাঝারি এবং আট থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ হিসেবে গণ্য করেন।