শিশুবান্ধব শিক্ষাব্যবস্থা

64

কিন্ডারগার্ডেন হল শিশুদের প্রাক বিদ্যালয়। ১৮৩৭ সালে ব্যাড বøাংকেন শিশুদের জন্য এ পদ্ধতি প্রবর্তন করেন। শিশুদের শারিরিক ও মানসিক বিকাশে শিক্ষার পরিবেশ ও পাঠ্য শিশুবান্ধব হওয়া উচিত। প্রথম স্থান অর্জনের লক্ষ্য কিংবা বইয়ের বোঝার চাপ নয়। শিশুদের জন্য প্রয়োজন গল্প, নাচ, গান ,ছবি আঁকা ,খেলাধুলা সহ আনন্দময় শিক্ষার পরিবেশ। অতিরিক্ত চাপের কারণে শিশুদের কাছে গৃহশিক্ষক ও স্কুল দুটোই বিরক্ত ও ভীতির। ঘরে আছে অভিবাবক, শিক্ষকের পড়ার চাপ ও অনুশাসন। ক্লাশে একাধিক বিষয়ের চাপ। স্কুল শেষে বাড়ি ফিরে একটু অবসর না নিতেই গৃহশিক্ষকের কাছে পড়া, হোমওয়ার্ক করা । রাতের ঘুম শেষে সকালে আবারো বইয়ের বোঝা পিঠে স্কুলে ছুটে চলা । রাতে ঘুমানোর সময় ছাড়া কোন অবসর নেই। গাদা গাদা বই আর পড়ালেখার চাপে শিশুরা অসহায়। সকালে ঘুম চোখে ব্যাগ কাঁধে স্কুলে যাওয়া শিশুর চেহারায় বিরক্তির চাপ দেখলে তা বুঝা যায়, কঁচি বয়সে কি কঠিন অনুশাসন ও ধকল সইতে হচ্ছে।
প্রাথমিক পর্যায়ে একাধিক বই শিশুদের শিক্ষা সম্পর্কে নৈতিবাচক ধারণা ও ভীতির জম্ম দেয়। ফলে শিশুরা স্কুল কিংবা গৃহশিক্ষকের কাছে পড়ার কথা শুনলে কান্না জুড়ে দেয়। জোর করে স্কুল ও গৃহশিক্ষকের কাছে পড়তে বসাতে হয়। বইয়ের বোঝা, অধিক ওজনের ব্যাগ, ক্লাশের পড়া, একাধিক গৃহশিক্ষকের কাছে পড়া, কোচিং, ভর্তি কোচিং, ভর্তিযুদ্ধ, হোমওয়ার্ক, ক্লাশ টেষ্ট , মডেল টেষ্ট নামক একাধিক চাপে পিষ্ঠ শিশুদের শৈশব, রঙিন স্বপ্ন। হাইকোর্টের নিদের্শনা মতে ব্যাগের ওজন শিশুর শরীরে ওজনের ১০% বেশী হওয়ার কথা নয়। অথচ শিশুদের অধিক ওজন বহনে বাধ্য করা হচ্ছে। শিশুরা যেন রেজাল্ট মেশিন। অভিবাবকদের চাওয়া আর স্কুলগুলোর ১০০% পাশের নিশ্চয়তা শিশুদের রোবটে পরিণত করেছে। শিশুদের এমন কঠোর শারিরিক ও মানসিক পরিশ্রমে অভিবাবক, শিক্ষকরা গর্ব করেন। কিন্তু এর ফলে শিশুর কি পরিমাণ শারিরিক ও মানসিক ক্ষতি হচ্ছে তা অনুধাবন করেননা।
অধিক চাপের কারণে শিশুদের মানিসক সমস্যা, নিঃসঙ্গ, অসহায়, হতাশ করে তুলে। এমনকি বিকারগ্রস্থ করে তুলে। শিশুদের প্রতিযোগিতা ও লক্ষ্য অর্জনে বৃত্তে আবদ্ধ নয় । পড়া ,বইয়ের বোঝা, অভিবাবক ,শিক্ষকের চাওয়া পুরণের মেশিন নয়। আমাদের দেশে বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থা শিশুর শারিরিক ও মানসিক ,সৃজনশীল বিকাশে যথেষ্ট সহায়ক নয়। শিক্ষকেরা শিশুদের পড়া আদায়ে ধমক, বেঞ্চে দাড় করিয়ে রাখা, কান মলা, তিরস্কার করেন। তাতে শিশুরা মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। একটি শিশুর স্বপ্নময় শৈশবের চাওয়া হতে পারে খেলনা নিয়ে খেলা, খেলাধুলা ,নাচ, গান, ছবি আঁকা, গল্প করা । অথচ এই কোমল সময়ে অভিবাবকেরা শিক্ষা ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নিজের চাওয়াকে শিশুর উপর চাপিয়ে দেন। বুঝতে চাননা সন্তান কি চায়। কোন বিষয়ে তার আগ্রহ। ভাল রেজাল্ট না হলে সামাজিক মর্যাদা ক্ষুন্ন হবে এমন ধারণা থেকে সবাইকে সরে আসতে হবে। শিশু বয়স হল কোমল, নরম ,আনন্দময় ও শারিরিক , মানসিক বিকাশের সময়। এ সময় যদি অভিবাবক, শিক্ষকেরা তাদের উপর কোন কিছু চাপিয়ে না দিয়ে বরং তাদের চাহিদা, স্বাধীনতা , আগ্রহকে সম্মান করেন। তাহলে শিশুদের মানসিক দৃঢ়তা প্রবল হয়ে ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হয়। কঁচি হৃদয়ে আত্মবিশ্বাস বেড়ে সৃষ্টিশীলতা ও মানসিক বিকাশ দ্রæত হয়। নৈতিকতা, মানবিকতা, সত্যবাদিতার অন্যান্য গুণ তাদের হৃদয়ে প্রষ্ফুটিত হয় । শিক্ষকের আচরন হবে বন্ধুসুলভ। তিনি জোর করে কিছু শিখাবেননা। শিশুদের মানসিক অবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে সহযোগিতা ও নিবিড় তত্ত্বাবধান করবেন।
শিক্ষকের মানসিকতা হবে শিশুবান্ধব। শিশুবান্ধব মানসিকতা ছাড়া শিশু পাঠদানে আসা উচিত নয়। কঁচি বয়সের কোমল সময়কে ধূসর করা নয় । শিশুদের জন্য চাই মুক্তমনের অবারিত উপভোগ্য ও আনন্দময় শিশুবান্ধব শিক্ষার পরিবেশ। শিশুদের জন্য ঘর ও ক্লাশরুম দুটোই উপভোগ্য করে তুলতে হবে। একটি শিশুর সামনে খেলনা, ছবি আঁকা, গান, বৈজ্ঞানিক, ইলেক্ট্রনিকস ডিভাইস, রবোটিক যন্ত্রপাতি সহ নানা ধরণের সরঞ্জামের সাথে বাস্তবে পরিচয় করিয়ে দেবেন।
শিশুদের চারপাশ, পরিবেশ, পশু ,পাখি, বস্তু,ব্যক্তি, পরিবার ,স্বজনদের সম্পর্কে জ্ঞান, নৈতিকতা,খেলাধুলা সহ নানা বিষয়ে ধারণা দেবেন। শিশুরা জিনিসগুলো সরাসরি দেখে সাম্যক জ্ঞান লাভ করবে। একজন শিক্ষকের কাছে শিশুরা কোন জিনিস সম্পর্কে ধারণা পেল বা ছবি দেখল । কিন্তু তা বাস্তবে দেখার সুযোগ হলনা। তাতে করে উক্ত বস্তু সম্পর্কে তার মনে দ্বন্ধ কাজ করে। তাই শিশুদের যে বস্তু সম্পর্কে বলা হবে, বস্তুটি বাস্তবে দেখিয়ে বলা হলে শিশুরা প্রকৃত জ্ঞান অর্জনে সক্ষম হন । শিশুদের আগ্রহকে প্রধান্য দেয়া শিক্ষায় তাদের অবচেতন মনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। ইতালিয় চিকিৎসক মারিয়া ত্যাকলা আর্তেমেজিয়া মন্টেসরি (১৮৭০-১৯৫২) নিজের মন্টেসরি পদ্ধতি নামে একটি পদ্ধতি প্রচলন করেন। এ পদ্ধতিতে একজন শিশুবান্ধব শিক্ষক কোন কিছু শেখাননা। তিনি সহযোগী ও তত্ত্বাবাধায়ক হিসেব শিশুদের সাথে কাজ করেন। শিশুদের আগ্রহকে সম্মান করে সংবেদনশীল আচরণে তাদের মাঝে দক্ষতা,সৃষ্টিশীলতা সৃষ্টিতে চেষ্টা করেন। কেননা শিশুরা এ বয়সে যে কোন বিষয় খুব তাড়াতাড়ি শিখে দক্ষ হয়ে উঠে। ক্লাশে শিশুদের জন্য শেখার সরঞ্জাগুলো সামনে রাখেন। শিশুরা সরঞ্জাম গুলোর সরাসরি ব্যবহারে বাস্তব জ্ঞান লাভ করে। কোন প্রকার শাসন বারণ নয়। খেলাধুলা, ছবি আকাঁ,গল্প, গান , নাচ সহ শিশুদের আগ্রহকে প্রধান্য দিয়ে শিক্ষা দান করেন। ফলে স্কুলের প্রতি শিশুদের ভয়ের পরিবর্তে উপভোগ্য ও আনন্দময় হয়ে উঠে। শিশুরা দক্ষতা ও সৃষ্টিশীতায় এগিয়ে যায়। পুঁিথগত বিদ্যার পরিবর্তে প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করে। বইয়ের বোঝা,ভীতিময় শিক্ষার পরিবর্তে আনন্দময় শিক্ষায় শিশুর প্রকৃত সত্ত্বাকে জাগিয়ে তোলে। শিশুদের জন্য আনন্দময় ও উপভোগ্য শিক্ষার বিকল্প নেই।