শিশুদের জন্য পারিবারিক সহিংসতামুক্ত পরিবার চাই

45

রূপম চক্রবর্ত্তী

আমরা সবাই পরিবারে বাস করি। মা বাবা, স্বামী স্ত্রী এবং সন্তানদের নিয়ে একটি পরিবার। পরিবারে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য আমাদের শিশু। এই পরিবার হচ্ছে একজন শিশুর জন্য আদর্শ শিক্ষা নিকেতন। পারিবারিক শিক্ষা এবং পারিবারিক সহিংসতা একজন শিশুর উপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। একটি সমাজে যেমন ভাল মানুষ থাকে তেমন অনেক খারাপ মানুষও থাকে। ভাল আর খারাপ থেকে ভাল যা পাওয়া যায় তাই গ্রহণ করতে হয়। এই ভালো কিছু গ্রহণ করার মানসিকতা একজন শিশু তার পরিবার থেকে পেয়ে থাকে। অশিক্ষিত পরিবারের পাশাপাশি অনেক শিক্ষিত পরিবারে দেখা যায় শিশুদের সামনে স্বামী আর স্ত্রী মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ঝগড়া হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে হাতাহাতি হচ্ছে। যৌতুকের জন্য প্রতিনিয়ত অনেক মহিলা নির্যাতিত হচ্ছে নিজের ছেলে মেয়ের সামনে। একজন শিশু যখন ছোট বেলা থেকে তার পরিবারে এই রকম একটা পরিবেশ দেখে তখন তার মধ্যে একটা অনিশ্চয়তার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এমন কিছু পরিবারও দেখা যায় যেখানে একজন মা নির্যাতিত হওয়ার পাশাপাশি তার ছোট শিশুটিও বিভিন্নভাবে নিযার্তিত হয়। যার প্রেক্ষিতে শিশুটি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। যদি শিশুটি খারাপ কিছ গ্রহণ করতে করতে বড় হয় তাহলে দেখা যাবে ভবিষ্যতে সেও একই একটা পরিবেশ সৃষ্টি করবে। যে শিশু বড় হয়ে সমাজে ভালো কিছু উপহার দেওয়ার কথা ছিল সেই শিশুকে যখন বিপরীত অবস্থানে দেখা যায় তখন ব্যাপারটা হয় দুর্ভাগ্যজনক। বর্তমান সময়ে বেশির ভাগ পরিবারে দেখা যায় অনেক শিশুরা মোবাইলে আসক্ত। কিন্তু এখন অনেক শিশুকে দেখি যারা নিজের লেখাপড়ার চাইতেও ইন্টারনেট ব্যাবহার করে অপ্রয়োজনীয় সহিংস অনেক গেম ডাউনলোড করছে এবং সেই গেমগুলো খেলে খেলে নিজের জীবনে প্রয়োগ করার চেষ্টা করছে। গেম ছাড়াও অনেক কিছু দেখে নিজের মানসিকতা নষ্ট করছে। নিজের মানসিকতা নষ্ট হয়ে গেলে আজকের শিশুরা আগামীদিনে সমাজে বিবেকবুদ্ধিহীন একজন মানুষ হিসেবে বাস করবে। আজকে চারদিকের পরিবেশ যদি একটু ভালো করে দেখি তাহলে দেখব আমরা অনেক নীচে নেমে যাচ্ছি। বিবেক শূন্যতা মানুষের মানবিক চরিত্রকে কুলষিত করে। বিবেকহীন মানুষ সমাজে বিভিন্ন অনাচার সৃষ্টি করে। অনেক ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন অপরাধ কর্মে জড়িয়ে পড়ছে। গ্যাং কালচারের সাথে কম বয়সীরা জড়িয়ে পড়ছে। স্কুল লেভেলের একজন ছাত্র যখন নিজেকে জাহির করার জন্য দলবদ্ধভাবে তার সহপাঠীকে হত্যা করছে তখন আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। এখন প্রত্যেক পরিবারে প্রয়োজন অকৃত্রিম ভালবাসা আর মমতায় আমাদের শিশুদের সিক্ত করে ভালো আচরণ শেখানোর মাধ্যমে গড়ে তোলা। তাদেরকে বুঝাতে হবে আমাদের শ্রেষ্ঠ সম্পদ চরিত্র। নির্ভেজাল ভালবাসার রঙে আমরা আমাদের চরিত্রকে সাজিয়ে দিতে পারি। সেই ভালবাসা হবে আমার পরিবার পরিজনের প্রতি। আমার রক্তের মানুষগুলোর প্রতি। ভালবাসায় পূর্ণ হোক পরিবারের বাইরের মানুষগুলোর প্রতি যারা অসহায় জীবন যাপন করছেন। পরিবারের পাশাপাশি পরিশুদ্ধ ভালবাসা শিখা যায় এমন কিছু বিদ্যালয়, কলেজ আমাদের বেশি দরকার। যেখানে সর্ব ধর্ম, বর্ণ মানুষের ভালবাসার কথাগুলো উচ্চারিত হবে। যদি প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি ক্লাসে কয়েক মিনিট করে শুদ্ধ মানবতার উপর বক্তব্য রাখার ব্যবস্থা রাখা যায় তাহলে আমার মনে হয় আজকের শিশুরা আগামীতে সমাজ ও রাষ্ট্রে ভালো কিছু উপহার দেবে। ভবিষ্যতে কিছু ভাল মানুষের জন্ম হবে। যারা ভালবাসবে প্রিয় দেশকে। দেশের মানুষকে।
আমাদের পরিবারগুলোকে একটি আদর্শ পাঠশালা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। ছোটবেলা থেকে ছেলে মেয়েদের মহামানবের জীবনীগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারি। মাঝেমধ্যে ক্রাইম পেট্রোলের কাহিনীগুলো দেখি। ক্রাইম পেট্রোলের দৃশ্যগুলো যখন দেখি তখন আমি চিন্তা করি মানুষ দিন দিন কত অমানবিক হয়ে পড়ছে। মানুষ দিন দিন কত বিবেক শূন্যতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মানবিকতার বিপর্যয় হলে সমাজ সুন্দর হয়না। তাই আমি মনে করি প্রকৃত ধর্ম আচরণ মানুষের মানবিক চরিত্রকে সংশোধিত করার মাধ্যমে বিবেকবোধ জাগ্রত করে। ভাল গুণাবলী গ্রহনের মাধ্যমে আমাদের ধর্ম জাগ্রত হবে। আমাদের ভাবতে হবে আগামী প্রজন্মের জন্য আমরা কি রেখে যাচ্ছি। আমাদের চিন্তা চেতনার মধ্যে যদি অপরকে ভালবাসার মহাশক্তি জাগ্রত না করি তাহলে সমাজে ভাল মানসিকতার সন্তান জন্মগ্রহণ করবেনা। স¤প্রদায়গত বিরোধের মাধ্যমে একটি জাতি কখনো উন্নতি করতে পারেনা। পরম দয়ালের কাছে প্রার্থনা জানাই হিংসা বিদ্ধেষ ভুলে গিয়ে মানুষে মানুষে মহা প্রেমের এক সেতুবন্ধন রচিত হোক। যেখানে হিংসা থাকবেনা, বিদ্ধেষ থাকবেনা। মিলন আর প্রেমের মধুর বার্তা চারদিকে ছড়িয়ে যাবে। ধর্ষণ এবং ছাত্র বলাৎকার বর্তমান সভ্য সমাজ ব্যবস্থার এক কালো অধ্যায়। এই অধ্যায় থেকে নারী এবং শিশুরা মুক্তি লাভ করুক। শিশু এবং নারীর প্রতি সহিংস আচরন সুস্থ এবং বিবেকমান মানুষের মনকে সংকুচিত করে এবং ক্ষেত্র বিশেষে তাদের মনকে এত বেশি নাড়া দেয় যে শেষ পর্যন্ত তারা রাস্তায় নেমে পড়েন। মাঝে মাঝে খবরের কাগজে পাই কোনো কোনো বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রাবাসে লম্পট শিক্ষক দ্বারা ছোট ছোট শিশুরা বলাৎকারের সম্মুখীন হচ্ছে। যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশুকে মানবতার শিক্ষা দেবে, ভালো আচার-আচরণ শিখাবে সেখানে যদি শিশুরা ভালো কিছু না শিখে মন্দ কিছু শিখে তাহলে তার দায়বার সবাইকে একদিন ভোগ করতে হবে। আমি চাই যে কোনো পরিবার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিটি শিশু এবং ছাত্রছাত্রীদের নৈতিক শিক্ষা দিয়ে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তাদের শিক্ষক শিক্ষিকা চেষ্টা করবেন। প্রতিটি পরিবার খেয়াল রাখবেন একজন শিশু, ছাত্র বা ছাত্রীকে আগামী প্রজন্মের জন্য উপহার হিসেবে প্রদান যায়। তার জন্য পরিবারের মা বাবা এবং গুরুজন পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক শিক্ষিকাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। একটি পরিবারে মা বাবা তার সন্তানকে এমনভাবে শিক্ষা দেবেন যেন সে বড় হয়ে ধর্ষণের মত অপরাধ না করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে জুনিয়রদের নিপীড়ন না করে।
ছোট থেকে শিশুদের ভিত্তি মজবুত করতে না পারলে বড় হলে সে নড়বড়ে হয়ে উঠবে। মানুষকে শ্রদ্ধা করা, আরেকজনের ভালো মতামতকে গ্রহণ করার মানসিকতা সৃষ্টি করার শিক্ষা পরিবার থেকেই দিতে হবে। সবকিছুর পরিবর্তন হয়তো একদিনে সম্ভব নয়। ধারাবাহিক প্রচেষ্টার ফলে পরিবর্তন সম্ভব বলে আমি মনে করি। ছোট বেলা থেকে আমাদের প্রকৃত ধর্ম শিক্ষার প্রয়োজন। কারণ ধর্মীয় বিধিনিষেধ একজন সন্তানকে সমাজে আদর্শ সন্তান হিসেবে গড়ে তোলে। ধর্ম শিক্ষার পাশাপাশি আমাদের সন্তানদের মানবতার শিক্ষা দেব। শ্রদ্ধাশীল হওয়ার জন্য শিক্ষা দেব। নতুন সৃষ্টির আনন্দে আমাদের ছেলেমেয়েরা যাতে প্রেরণা পায় সেদিকে খেয়াল রাখব। সম্প্রীতি আর সহনশীল সহাবস্থানের মধ্যে আজকের শিশুরা বেড়ে উঠুক। কেননা তারাই আগামীর সমাজ এবং রাষ্ট্রকে সুন্দর ভাবে পরিচালিত করবে।
লেখক: ডেপুটি ম্যানেজার
অডিট, ডায়মন্ড সিমেন্ট লিমিটেড