শিশুকে সামাজিকীকরণে শিক্ষালয়ে শিক্ষার ভূমিকা

7282

মানুষ সামাজিক জীব। সমাজের সাথে শিশুকে সম্পৃক্ত করা শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য। সেই উদ্দেশ্যকে সফল করতে শিশুকে বিদ্যালয়ে প্রেরণ করতে হয়। বিদ্যালয়ে প্রেরণের মাধ্যমে শুরু হয় শিশুর প্রথম সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া। এই বিদ্যালয় থেকে শিশুর মধ্যে, ধীরে ধীরে গড়ে উঠে সামাজিক সম্পর্ক। আমরা জানি বিদ্যালয় হচ্ছে একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান।
এখানে অর্থাৎ বিদ্যালয় নামক সামাজিক প্রতিষ্ঠানে, সমাজের বিভিন্ন পেশার, শ্রেণির, ধর্মের, বর্ণের, দলের, মতের শিশু ভর্তি হয়। আর ভর্তি হয়ে একে অপরের সাথে কথাবার্তা, খেলাধুলা, চলাফেরা সর্বোপরি শিক্ষার্থীর শিখন ও শিক্ষকের শেখানোর মধ্যদিয়ে ধীরে ধীরে ঘটতে থাকে সামাজিক বিকাশ।
মানুষ সামাজিক জীব, যা শুরুতেই বলেছি। শিক্ষার অন্যতম বৈশিষ্ট্য বা উদ্দেশ্য হচ্ছে, শিশুদের সমাজের সাথে সম্পৃক্ত বা অভিযোজিত করা। কারণ শিশু সমাজের সাথে সম্পৃক্ত হতে না পারলে সে অসামাজিক কার্যকলাপের সাথে সংশ্লিষ্ট হবার সম্ভাবনা থাকবে। আর এতে করে চুরি, ডাকাতি, সন্ত্রাস, অন্যায়, অত্যাচার, অনিয়ম, অবিচার বৃদ্ধি পেয়ে সমাজ, তথা পুরো দেশ কলুষিত হবে। তাই আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে সামাজিক শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। আর এই শিক্ষার মাধ্যমেই একটি সফল সমাজ গঠন করা সম্ভব। কারণ আদর্শ শিক্ষা, মানে সুশিক্ষা গ্রহনের ফলে সমাজের মধ্যে বিদ্যমান কুসংস্কার, অন্ধ বিশ্বাস, ধর্মীয় গোঁড়ামি, মানসিক সংকীর্ণতা, সাম্প্রদায়িকতা, ধনী দরিদ্র ভোদাভেদ ইত্যাদি নিমূর্ল করা সম্ভব। একজন শিশু সামাজিক ভাবে বিকশিত হলে সে সমাজের দায়িত্বশীল সদস্য হিসাবে, তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সর্বদা সচেষ্ট ও সক্রিয় হবে।
এখানে বিদ্যালয় একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে, শিশুদের ব্যক্তিসত্তার সুষম বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, এবং রেখেই চলেছে। বিদ্যালয়ের উৎপত্তি মূলত শিশুর সার্বিক ও সামাজিক বিকাশ সাধনের উদ্দেশ্যে।
এখানে কেবল পুরানো তথ্য, উপাত্ত, অভীজ্ঞতা, মুখস্থ করে শেখানো নয়; বরং সুন্দর, সুশৃঙ্খল জাতিগঠন ও দেশের উন্নয়ন পরিচালনা করতে, সমাজ কর্তৃক এই বিদ্যালয় সৃষ্টি। সুনাগরিক গঠনের জন্যে সমাজের সকল সদস্যের মধ্যে পারস্পরিক ¯েœহ মমতা, আন্তরিকতা, সহানুভূতি, শ্রদ্ধাবোধ, দায়িত্ব কর্তব্যবোধ জাগ্রত করণের জন্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ধারণা আবিষ্কার। যেখানে হয়, বিভিন্ন জাতি ধর্ম বর্ণ দল মত নির্বিশেষে সবার মিলন কেন্দ্র। তাই প্রাথমিক স্তরে ১ম শ্রেণিতে ভর্তি হবার পর থেকে শিশুর সামাজিকীকরণ শুরু হয় এবং পরবর্তী স্তরে গিয়ে পর্যায়ক্রমে এই সামাজিকীকরণ আরো বিকশিত হয় এবং সৃদৃঢ় হয়।
আমরা বাস্তবক্ষেত্রে দেখি, আমাদের প্রতিক্লাসে প্রায় প্রতি শিশুর অভিভাবক, শিশুকে ‘গণিত’ ও ‘ইংরেজীর’ মত বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টি দিয়ে থাকে। একজন শিক্ষার্থী প্রাথমিক শিক্ষাস্তর শেষ করে যদি পরবর্তী মাধ্যমিক স্তরে যেতে ব্যর্থ হয়, তবে তার ঐ ইংরেজী বা গণিত বিষয় বাস্তব জীবনে আংশিক প্রতিফলিত হবে, কিন্তু ‘সমাজ’ বিষয়টি তার ব্যক্তি জীবনে, পারিবারিক জীবনে, সামাজিক জীবনে পূর্ণ প্রতিফলিত হবে। এখানে ‘সমাজ’ মানে বর্তমানে পরিবর্তিত নাম ‘বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়’ শিক্ষাক্রমটির কথা বলছিলাম।
বিভিন্ন শিক্ষাক্রমের বিষয়বস্তু শিশুদের জন্যে যতটুকু তাত্তি¡কভাবে কার্যকর, তার চেয়ে কয়েকগুন কার্যকর হয় শিশুর নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসা যাওয়া ও অবস্থানের মাধ্যমে। শিখন শুধু বই পড়ে, খাতায় লিখে শিক্ষা গ্রহণ হয়না। কেবল বই-খাতার মাধ্যমে যদি শিক্ষা অর্জিত হত, তাহলে কষ্ট করে বিদ্যালয়ে না এসে ঘরে বসে, প্রাইভেট টিউটর দিয়ে শিক্ষা অর্জন করা যেত।
প্রাচীনকালে মানুষ দলবদ্ধভাবে বসবাস করত। তারই ধারাবাহিকতায় গড়ে উঠেছে আজকের আধুনিক সমাজ। তাই সুন্দর সুশৃংখল রীতি নীতি নিয়ম কানুন অনুযায়ী পাশাপাশি বা কাছাকাছি বসবাস করতে হলে কিছু সামাজিক শিক্ষার প্রয়োজন। আমাদের শিক্ষায় নির্ধারিত শিক্ষাক্রমে সামাজিকরণের বিষয়বস্তু আছে। তা ঘরে বসে, জেনে পড়ে যতটুকু সমাজের তাত্তি¡ক জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব, তার চেয়ে বেশী বিদ্যালয়ে নিয়মিত আসা যাওয়া করে ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব। কারণ বিদ্যালয়ের ভিতর অবস্থান করে দলীয় কাজের মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহন, বিদ্যালয়ের বাইরে খেলাধুলা, সহপাঠ ক্রমিক কার্যক্রমে অংশ গ্রহন ইত্যাদির মাধ্যমে আরো বেশী প্রায়োগিক সামাজিক জ্ঞান অর্জিত হয়।
তাই শিশুকে বিদ্যালয়ে প্রেরণের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে সামাজিক বিকাশ ঘটে, যা বেশীর ভাগ সময় ঘটে থাকে নিজেদের অজান্তে। আর এখানেই সামাজিকীকরণে শিক্ষালয়ে শিক্ষার মূল ভূমিকা।