শির নেহারি আমারি নত শির ঐ শিখর হিমাদ্রীর

1230

হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস ‘খাদক’, বিটিভিতে নাটক আকারেও চিত্রায়িত হয়েছিল। এক অধ্যাপক একটি গ্রামে যেতে চান অবকাশ যাপনে, ডিসি সাহেব উক্ত গ্রামের চেয়ারম্যান সাহেবকে বিষয়টি জানালেন ফোন করে। মাশাল্লাহ্ ফোন পেয়ে চেয়ারম্যান সাহেবের সে কি আয়োজন অধ্যাপক সাহেবের জন্যে, কি করবেন ভেবে দিশাহারা। বিভিন্ন আয়োজন বাদ্য-বাজনা, নাচ-গান সহ আরো কত কি, ইত্যাদির মধ্যে চেয়ারম্যান সাহেব অধ্যাপকের সম্মানে একটি বিশেষ আয়োজন রেখেছেন: এলাকার খাদক কর্তৃক ভোজন প্রদর্শন। শোনে অধ্যাপক সাহেব তো মহাবিরক্ত, এমনিতে এত আয়োজনে তিনি ভীষণ ক্লান্ত তার উপর এই কথা শুনে তিনি ভেবেই অজ্ঞান। একজন লোক এক মণ একটি গরু আস্ত খেয়ে ফেলবে এর মাঝে মাহাত্ম্য যে কি তা’ই তো বুঝতে পারছিনা। চেয়ারম্যান খাদককে দেখিয়ে; কি যে বলেন স্যার, গতবার সে ৩৫ কেজি মাংস একাই সাবাড় করে ফেলেছিল এবার খাবে এক মণ। কি পারবি না? খাদকের দিকে তাকিয়ে চেয়ারম্যান। এক গাল হেসে অধ্যাপককে খাদক; দোয়া রাইখেন স্যার, ইনশাল্লাহ্তালা পারব। অধ্যাপকের কেমন যেন অস্বস্তি লেগে উঠল। প্রতিযোগিতার দিন গরু জবাই ও রান্না শেষ এবার খাবার পালা, খাদক খেতে শুরু করল। পাশে তার ৮-১০ বছর বয়সী কন্যাটি বসা, ঢোল, বাদ্য-বাজনাও বাজা আরম্ভ হল, যেন এক মহোৎসব হৈ হৈ রব। অধ্যাপককে বড় এক সোফায় বসানো হয়েছে যেহেতু তাঁর সম্মানার্থে এই আয়োজন কিন্তু বড্ড পেরেশানি বোধ করছিলেন তিনি তথাপি দেখছেন। সম্ভবত কৌতূহল, ত্রিশ কেজি শেষ করেছে তারপর শুরু হল খাদকের মোড়ামুড়ি। কেয়ামত হয়ে যাচ্ছে বাকীটুকু শেষ করতে, কি কান্না খাদকের সাথে মেয়েটিও কাঁদছে, কিন্তু খেতে পারবেনা কথাটি একবারও বলছেনা। কেমন করে বলবে, এত প্রচার এত ঘোষণা, তার সম্মান ধুলায় মিশে যাবে না? ওদিকে অধ্যাপক তো পারছেন না সব আয়োজন ধুলায় মিশিয়ে দিতে, খাদকের কষ্ট তাঁর সহ্য হচ্ছেনা, হা হা হা হেসে চেয়াম্যান; অস্থির হবেন না স্যার সে পারবে। এবং সে পেরেছে সাথে সাথে বাজনা বেজে উঠল, মালা পরানো হলো আর পুরস্কৃত করা হলো। মুখে তার বিজয়ীর হাসি। অধ্যাপক এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে; মাথা না নোয়ানোর সংকল্প, নমস্কার তোমায় হে বিজয়ী বীর, দুবেলা পেট পুরে খেতে পাওনা তবু পরাজয় মানতে শিখনি।
বড় অর্থপূর্ণ এক শিক্ষা গল্পটিতে বিদ্যমান, প্রতিটি মানুষকে সংকল্পে অটুট থাকতে হবে আরাধ্য বিজয় ছিনিয়ে আনতে হবে সততা, অধ্যাবসায় আর কঠোর পরিশ্রমের বিনিময়ে। আসুন এবার আরেকটি গল্প শুনি ছোট বেলায় আমাদের ক্লাশের ‘দ্রæত পঠন’ বইয়ের গল্প এটি, শুনুন তাহলে: ‘পাশাপাশি দুটি গ্রাম, বড্ড বিবাদ তাদের মধ্যে কারা শ্রেষ্ঠ, এটি নিয়ে। বুঝার সুবিধার্থে গ্রাম দুটির নাম দিলাম এক্স ও ওয়াই, এ, বি দিলামনা কারণ পাছে আবার অনেকে আওয়ামী লীগ, বিএনপি বুঝে বসে থাকবে। এখন এক্স গ্রাম খেলা দিলে ওয়াই গ্রাম মেলা দেয়, আবার ওয়াই গ্রাম গান দিলে এক্স গ্রাম নাচ দেয়। এমনই তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতার রেষারেষি। উভয় গ্রাম হচ্ছে মূর্খের ঢেঁকি, কেউ পড়ালিখা জানেনা ফলে দুই গ্রাম দুজন মাস্টার রাখল, এক্স গ্রামের মাস্টার আই এ পাস এবং ওয়াই গ্রামের মাস্টার বিএ পাস। ফলে ওয়াই গ্রামের লোকেদের কি ফুটানি, তাদের গ্রাম এখন উপরে কারণ তাদের মাস্টার বেশি শিক্ষিত বিএ পাশ। এক্স গ্রাম কিন্তু এটি মানতে নারাজ, আই এ পাশ হলেও তাদের মাস্টার জানে বেশি, কারণ তিনি কথায় কথায় ইংরেজি ফুটান। শুরু হলো এটি নিয়ে নতুন বিতর্ক কে ইংরেজি বেশি জানে? শেষে সিদ্ধান্ত হলো দুজনের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে, একজন আরেকজনকে প্রশ্ন করবে, যে উত্তর দিতে পারবেনা সে পরাজিত। দিনক্ষণ ঠিক হলো, নির্দিষ্ট দিন উভয় পক্ষ নিজ নিজ প্রতিযোগীকে সঙ্গে করে বাদ্য-বাজনাসহ নির্ধারিত মাঠে হাজির হলো। মাঠে একটি মঞ্চও বানানো হলো তাতে মাস্টার মশাইদ্বয় উঠলেন, শুরু হলো প্রশ্নের পালা। প্রথম প্রশ্ন করলেন বিএ মাস্টার আই এ মাস্টারকে; অন দি অর্নস অফ এ ডাইলেমা অর্থ কি? আই এ মাস্টার: উচ্চঃস্বরে; উভয়সঙ্কটে। এবার আই এ মাস্টার; আই ডু নট নো, অর্থ কি? বিএ মাস্টার; আমি জানি না। এক্স গ্রামকে আর থামায় কে? বাদ্য-বাজনাসহ তাদের উল্লাসে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত, কি বিজয়োল্লাস, এ যেন পরম প্রত্যাশিত যুগোত্তীর্ণ বিজয়। বিএ মাস্টার এত চেঁচায় ঐ কথাটির অর্থই হচ্ছে আমি জানিনা। কে শোনে কার কথা, সে জানেনা জানেনা আর কথা নাই আই এ মাস্টার জিতে গেছে এক্স গ্রামের বিজয় হয়েছে, এখন খেলা খতম পয়সা হজম।
বলা হয় কিছু মানুষকে সব সময়ের জন্যে বোকা বানানো যায়, সব মানুষকে কিছু সময়ের জন্যে বোকা বানানো যায় কিন্তু সব মানুষকে সব সময়ের জন্যে বোকা বানানো যায় না। উপরের গল্পে ওয়াই গ্রাম পরাজিত হয়েছিল অর্থাৎ তারা কিছু সময়ের জন্যে বোকা বনে গিয়েছিল, পরে তারা নিশ্চয় আইএ মাস্টারের কারসাজি বুঝেছে। কারণ বিএ মাস্টার কখনো বসে থাকবেনা, কেউ তা পারেনা, সে এই প্রতারণার ভিত উন্মোচন করবেই। ফলে এক্স গ্রাম মিথ্যা বিজয় নিয়ে যে উল্লাস করেছে অতি শীঘ্রই তাতে হতে পারে তাদের খাল্লাশ তথা শেষ। তাছাড়া আই এ মাস্টার তো জানে কি বাটপারী সে করেছে, প্রতিটি মুহূর্তে নিশ্চয় তা তাকে কুড়ে খাচ্ছে। আচ্ছা বিজয়ই কি সব, জীবনের সব চাওয়া-পাওয়া কি কেবল বিজয়ের মধ্যে নিহিত, পরাজয়ে কি কোন পাওয়া নেই? তাহলে আসুন পরবর্তী গল্পটি শুনি: ‘ইডিপাস ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর দৈববাণী হলো এই ছেলে তার পিতাকে হত্যা করে মাতাকে বিয়ে করবে। আহা, কি মর্মান্তিক! ফলে হত্যা করার জন্যে তাকে জল্লাদের হাতে তুলে দেয়া হলো, কিন্তু মায়ায় পড়ে জল্লাদ তাকে হত্যা করতে পারলনা, শুধু পায়ের তালুটা ফুটো করে পাহাড়ে রেখে চলে গেল। এমন ফুটফুটে সুন্দর একটা শিশু পাহাড়ে পড়ে আছে দেখে এক রাখাল তাকে নিয়ে গেল এবং নিজগৃহে পালতে লাগলো। পায়ের তালু ছিদ্র বিধায় নাম দিল ইডিপাস অর্থ ছিদ্র পায়ের তালু। বড় হয়ে ইডিপাস যখন তাগড়া জোয়ান হল একদিন সে দৈববাণী শুনল; ইডিপাস তুমি তোমার বাবাকে হত্যা করে মাকে বিয়ে করবে। শোনে সে বড়ই মর্মাহত হল এবং দেশ ছেড়েই চলে গেল কারণ সে জানে এটিই তার দেশ ও রাখাল আর তার স্ত্রীই হচ্ছে তার বাবা-মা। কাজেই দেশ ত্যাগ করলেই বাবাকে হত্যা করে মাকে বিয়ে করার আর কোন সম্ভাবনা থাকে না অতএব সে পার্শ্ববর্তী দেশে চলে গেল। সেখানে সে যে পথ দিয়ে যাচ্ছিল সেই পথে রাজার শকট আসছিল, রাজার শকটের সামনে পড়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে রাজা ইডিপাসকে হত্যার আদেশ দিলেন। রাজার সৈন্যরা তাকে হত্যা করতে এলে সে তখন তাদের হত্যা করে বৃদ্ধ রাজাকেও হত্যা করল আর এভাবে ইডিপাস দৈববাণীর প্রথম অংশ পূর্ণ করল কারণ এ রাজাই ছিল তার পিতা।
ইতোমধ্যে সে রাজ্যে এক নতুন বালাই এসে উপস্থিত হলো, এক অদ্ভুত জীব, মাথা মানুষের দেহ সিংহের, স্ফিংসের আবির্ভাব হলো, সে অতি দ্রæত দৌড়াতে পারে। দৌড়ে সে কোন মানুষকে ধরে রিডল তথা হেঁয়ালি প্রশ্ন করে, উত্তর দিতে না পারলে তখন সে মানুষটিকে হত্যা করে। এই স্ফিংসের ভয়ে গোটা দেশ জবুথবু, তার হাত থেকে পরিত্রাণ লাভের একমাত্র উপায় তার রিডলের জবাব দেওয়া, তাহলে সে ধ্বংস হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ স্ফিংসের প্রশ্নের জবাব দিতে পারেনি তাই রাণী ঘোষণা করলেন যে স্ফিংসের রিডলের সঠিক উত্তর দিতে পারবে সে রাণীকে বিয়ে করতে পারবে আর রাজত্ব পাবে। ইডিপাস এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করল এবং স্ফিংসের মোকাবিলা করতে গেল, স্ফিংস তাকে জিজ্ঞেস করল; কোন প্রাণী পূর্বাহ্নে চার পায়ে, মধ্যাহ্নে দু’পায়ে এবং অপরাহ্নে তিন পায়ে হাঁটে? ইডিপাস উত্তর দিল; মানুষ, মানুষ তার শিশুকাল তথা পূর্বাহ্নে চার পায়ে হাঁটে, একটু বড় হতেই তথা মধ্যাহ্নে দু’পায়ে হাঁটে ও বৃদ্ধকাল তথা অপরাহ্নে সাহায্য হিসেবে হাতে একটি লাঠি নেয় যা তৃতীয় পায়ের কাজ করে। জবাব শুনে স্ফিংস রেগে বিকট এক চিৎকার দিয়ে বিস্ফোরিত হয়ে মৃত্যু বরণ করে। ফলে রাণীর ঘোষণা মোতাবেক সে রাণীকে বিয়ে করে ও রাজত্ব লাভ করে আর এর মধ্য দিয়ে দৈববাণীর দ্বিতীয় অংশটুকুও সে পূর্ণ করে। রাণীর গৃহে ইডিপাসের তিনটি কন্যা সন্তান হয় তারপর একদিন সে জানতে পারে নৃশংস সেই নির্মম সত্য কথাটি, এই রাণীই তার মা পুরা পৃথিবী অসাড় হয়ে এল। কানকে বধির করল, চোখকে করল অন্ধ তারপর তিন কন্যাকে নিয়ে ইডিপাস প্রবেশ করল এক গহীনজঙ্গলে। নিদারুণ অন্তরজ্বালায় দগ্ধ হয়ে রাণী আত্মহত্যা করে সকল অপমান, লাঞ্ছনা, মর্মবেদনা, যন্ত্রণা আর বিবেকের দংশন থেকে মুক্তি নিলেন।’ কপালের লিখন না যায় খন্ডন, কত কঠিন কষ্ট করেছে ইডিপাস ভাগ্যের হাত থেকে পালাতে কিন্তু পারল না। গল্পটির উপসংহার এখন টানবোনা আগে আরেকটি গল্প বলে নেই তারপর এ দুটি নিয়ে আগের দুটি সহ একত্রে বক্তব্য শেষ করবো। তাহলে পাঠক পরবর্তী গল্পটি শুরু করছি-
রুস্তম জগদ্বিখ্যাত বীর ইরানের সেনাপতি, তুরানের শাহাজাদীকে বিয়ে করেছেন। স্ত্রী সন্তানসম্ভাবা এমনাবস্থায় ইরান চলে আসতে হল, বিদায়ক্ষণে রুস্তম স্ত্রীকে একটি নিশান দিলেন। সন্তান যদি ছেলে হয় তবে নিশানটি তার ডান বাহুতে পরিয়ে দিতে বললেন। শীঘ্রই শাহাজাদীর এক পুত্র হল রুস্তমকে জানানো হল কন্যা হয়েছে, পুত্র হয়েছে শুনে পাছে রুস্তম নিজের কাছে নিয়ে যায় সে ভয়ে। সোহরাব বড় হল, তাগড়া-জোয়ান, সুঠাম দেহের অধিকারী ও পিতার ন্যায় বীর আর সাহসী হয়েছে। একদিন তুরানের সাথে ইরানের যুদ্ধ লাগল, তুরানের সেনানায়কের দায়িত্ব পড়ল সোহরাবের উপর। সুযোগ আসল সোহরাবের পিতার সহিত সাক্ষাতের, দারুণ খুশী সোহরাব, ভাগ্যক্রমে যুদ্ধক্ষেত্রে দুজনের তাঁবুও খাটানো হয়েছে কাছাকাছি। ময়দানে দুজনের দ্ব›দ্বযুদ্ধ হয় রুস্তম পরাজিত হল, কি এক অজানা কারণ, সোহরাব তাকে হত্যা করলনা। সোহরাব তাকে জিজ্ঞেস করেছিল সে রুস্তম কিনা রুস্তম পরিচয় গোপন করল অহংবোধের কারণে। বলল, সে রুস্তম নয়, রুস্তম মহাবীর সে তোমার মত পুঁচকে বালকের সাথে লড়ে না। পরাজিত হয়ে রুস্তমের প্রতিশোধস্পৃহা বাড়তে লাগল, বুকের ভেতর তার প্রতিশোধের আগুন দাউ দাউ জ্বলছে। এ ছেলে বেঁচে থাকলে তার মান-সম্মান সব ধুলোয় মিশে যাবে, মানুষ ভয় তো দূরে থাক করুণা করেই কিংবা ঘৃণাভরেই তাকে স্মরণ করবে না। হায় খোদা খ্যাতির মোহে অন্ধ রুস্তম কি ঘটাতে যাচ্ছে? সারা আকাশ, সমগ্র পৃথিবীময় যেন মাতম উঠেছে, রব উঠেছে জগৎময় হায় রুস্তম কি করছ তুমি কি করছ? অন্ধ, বধির রুস্তম অহংবোধে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য প্রতিহিংসার আগুনে দগ্ধ হয়ে প্রতিশোধ পরায়ণ রুস্তম শ্যেন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সোহরাবের দিকে। চোখ দিয়ে তার আগুন বেরুচ্ছে, যেন এক হিং¯্র কালনাগ বিষের ছোবল বসাবে সোহরাবের বুকে আজ। সোহরাব ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে তীব্রবেগে নিজ তাঁবুর দিকে, রুস্তম বসে আছে তার তাঁবুর বাহিরে। হঠাৎ দ্রæতবেগে ছুটেআসা অশ্বটি তীব্র এক হোঁচট খেল বড় এক পাথরের সাথে। অশ্বের পিঠ হতে সবেগে ছিটকে পড়ে মাটিতে সোহরাব কাতরাতে লাগল। এমন একটি সুযোগের অপেক্ষারত রুস্তম তৎক্ষণাৎ তার সদ্ব্যবহার করে বসল, বসিয়ে দিল হাতের সুতীক্ষè খঞ্জরখানি সজোরে সোহরাবের বুকে।
বক্ষঃ ভেদ করে খঞ্জর সোহরাবের কলিজার ভেতর দিয়ে দেহের অপর প্রান্ত ছেদ করল। ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসা সোহরাবের বুকের রক্তে রুস্তম রঞ্জিত হল। যন্ত্রণায় কাতর সোহরাব; পাষন্ড কাপুরুষ, তুমি আমায় হত্যা করলে, আমার বাবা রুস্তম জানলে তোমায় দ্বিখÐিত করবে। শুনে বিচলিত রুস্তম উদ্বিগ্ন কণ্ঠে; কি বললে তুমি, রুস্তমের তো কোন ছেলে নাই আছে শুধুমাত্র একটি কন্যা সন্তান। সোহরাব তখন সমস্ত কথা বলে তাকে হাতে বাঁধা নিশানটি তার দেখাল। বজ্রাহতের ন্যায় প্রচন্ড বেদনায় জর্জরিত রুস্তমের মাথায় যেন গোটা আকাশ ভেঙ্গে পড়ল, তার সারা জগৎ আঁধারে নিমজ্জিত হলো। বাকরুদ্ধ রুস্তম পুত্রশোকে পাথর হয়ে গেল, প্রতিবন্ধীর ন্যায় ফ্যালফ্যাল চোখে পুত্রের নিস্তেজ দেহটির পানে তাকিয়ে আছে।
শির নেহারি আমারি নত শির ঐ শিখর হিমাদ্রীর মাথা তুলে দেখ আমার অবনত মস্তকও হিমালয়ের চূড়াসম। বিশ্বে একমাত্র পুত্রের হাতে পরাজয় পিতার জন্যে মহাগৌরবের কারণ সব বাবা-মা’ই চায় সন্তান তার চেয়ে অনেক বড় হোক। সোহরাবের কাছে পরাজয় রুস্তমকে করত মহিমান্বিত, তার নত শির হিমাদ্রীর শিখর ছাড়িয়ে আকাশ ছুঁতে পারত। তেমনি ইডিপাসের পরাজয় তাকে করত চির উন্নত শির। আই এ মাস্টারের বিজয় তাকে বানাল বাটপার দুদিনেই তার শির ধুলোয় গড়াবে। কেবল খাদকই প্রকৃত বীর তাকে নমস্কার। ইডিপাস কলঙ্কিত অবশ্য সে পুড়া কপাল, হতভাগা, কিন্তু রুস্তম চরম ধিকৃত ক্ষমার অযোগ্য। প্রতারণা করে বিজয় অর্জন চরম ঘৃণ্য, সৎ থেকে পরাজয়ও পরম সম্মানের। নীরবতাও অনেক সময় হতে পারে প্রচন্ড শক্তিশালী প্রতিবাদ, যেমন করে নত শির হতে পারে শিখর হিমাদ্রীর। জনবিমুখতায় গর্জে উঠে প্রলয় হুঙ্কার।
লেখক : কলামিস্ট