শিক্ষা-শিক্ষাব্যবস্থা-শিক্ষা সঙ্কটের স্বরূপ সন্ধানে

130

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম পুরোধা কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের বিখ্যাত ‘উটপাখি’ কবিতার প্রাসঙ্গিকতায় নিবন্ধের সারবত্তা সবিনয়ে উপস্থাপন করতে চাই। বর্তমান বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনায় বিরাজমান সঙ্কট উন্নত বা উন্নয়নশীল বিশ্বের তুলনায় অনেকটা ব্যতিক্রম। প্রাগ্রসর সমাজে শিক্ষা উন্নয়নে কার্যকর উপাদান সমূহের অন্যতম হচ্ছে মানবপুঁজির যথোপযুক্ত ব্যবহার এবং সমৃদ্ধ মানবসম্পদ উৎপাদন প্রকরণ। সাম্প্রতিককালে বিশেষজ্ঞদের মতানুসারে পুঁজির প্রকারভেদে প্রকৃতি-অর্থ-সমাজ ইত্যাদির তুলনায় মানবপুঁজির গুরুত্ব অধিকতর বিবেচ্য। এটি সর্বজনবিদিত যে, আধুনিক সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং পাঠ্যক্রমের যুগোপযোগী বিন্যাস সর্বাধিক অপরিহার্য উপকরণ হিসেবে সমাদৃত হয়ে আসছে। যেকোন সমাজ ব্যবস্থার স্থিতিশীল অবস্থানকে চলমান এবং ক্রমান্বয়ে ইতিবাচক উন্নীত করার পিছনে শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন ও পরিমার্জন অনিবার্য ভূমিকা পালন করে আসছে। অন্ধত্ব-ধর্মান্ধতা-কুসংস্কার-অশুভ-অন্যায়-অনৈতিকতা ইত্যাদি নিধন করে ধার্মিকতা-অসাম্প্রদায়িকতা-সততা-সত্যবাদীতা এবং যুক্তিনির্ভর মনন-সৃজনে প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনায় ঋদ্ধ গুণগত শিক্ষা-জ্ঞান পুরোবিশ্বকে বর্তমান অবস্থানে প্রচীয়মান করেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যথোপযুক্ত ব্যবহার এবং তথ্য-প্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতি নতুন নতুন গবেষণার দ্বার উম্মোচনে সার্থক সহায়ক। এসব উৎকৃষ্ট জ্ঞান-গরীমার শক্তিময়তায় সমাজের অগ্রসরমানতা বহুলাংশে হয়েছে পরিপুষ্ট। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিত পর্যালোচনায় শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষ করে মাঠপর্যায়ে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় অদূরদর্শীতা, অযোগ্যতা, মেধা ও বিচক্ষণতার প্রচÐ শূন্যতা একদিকে যেমন দক্ষ-অভিজ্ঞ-প্রশিক্ষিত জনসম্পদ তৈরিতে নানা প্রতিকূলতা সৃষ্টি করছে, অন্যদিকে করোনামুক্ত ভবিষ্যত বাংলাদেশে সামগ্রীক আর্থ-সামাজিক পুনরুদ্ধারের চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবেলায় অবর্ণনীয় অনাকাক্সিক্ষত-অনভিপ্রেত পরিবেশ সৃষ্টির অবকাশ তৈরি করছে।
উল্লেখিত ‘উটপাখি’ কবিতার উদ্ধৃতি – ‘আমার কথা কি শুনতে পাও না তুমি ?/ কেন মুখ গুঁজে আছো তবে মিছে ছলে ?/ কোথায় লুকোবে ? ধু-ধু করে মরুভূমি;/ ক্ষ’য়ে-ক্ষ’য়ে ছায়া ম’রে গেছে পদতলে।/আজ দিগন্তে মরীচিকাও যে নেই ;/ নির্বাক, নীল, নির্মম মহাকাশ।/ নিষাদের মন মায়ামৃগে ম’জে নেই ;/তুমি বিনা তার সমূহ সর্বনাশ।/ কোথায় পালাবে ? ছুটবে বা আর কত ?/ উদাসীন বালি ঢাকবে না পদরেখা।/ প্রাক্পুরাণিক বাল্যবন্ধু যত বিগত সবাই, তুমি অসহায় একা \’ থেকেই নিঃসঙ্কোচে বলা যায়; শিক্ষা ব্যবস্থা ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার দৌর্বল্য প্রেক্ষিত নীল মহাকাশকে নির্মম-নির্বাক করার মতো মরুভূমিতুল্য সবুজবিহীন ধরিত্রীর সর্বনাশ ডেকে আনছে। দিনে দিনে যেন আমাদের পদরেখা কৃষ্টি-ঐতিহ্যের স্বারককে ধূসর ধোঁয়া ও ধূলির মোড়কে সামষ্টিক অসহায় ও একাকীত্বকে পুনঃমূল্যায়নের আহবান জানাচ্ছে।
সেজন্য আকাতরে কবি বলেছেন, ‘নব সংসার পাতি গে আবার, চলো/ যে-কোনো নিভৃত কন্টাকাবৃত বনে।/ মিলবে সেখানে অন্তত নোনা জলও,/ খসবে খেজুর মাটির আকর্ষণে \’। এর মধ্য দিয়ে যে বার্তাটুকু পৌঁছুনোর চেষ্টা করা হচ্ছে বলে মনে হয়; তা হলো জল ও মাটির উর্বর আকর্ষণ তৈরিতে নতুন উদ্দীপনার দীপ্যমান জাগরণ। একে অপরকে দোষারোপ না করে বা অঙ্গুলী প্রদর্শনে সবলতা-দুর্বলতার চিহ্নিতকরণ পরিহার করে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে সকলকেই চন্দ্রানন ব্রতী হতে হবে। আমাদের পূর্বপুরুষরা যে কৃষ্টি-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির অবগাহনে জ্ঞানাঞ্জন জীবন প্রবাহের প্রাণসঞ্চার করে তাঁদের দায়িত্ব পালন করেছেন; এখন সময়ের দাবি হচ্ছে এই দায়ভার পূরণে উত্তরসূরি আমরা যেন কোনভাবেই পিছিয়ে না থাকি। সমস্বরে কবির কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে উচ্চারণ করতে চাই – ‘আমি জানি এই ধ্বংসের দায়ভাগে/ আমরা দুজনে সমান অংশীদার;/ অপরে পাওনা আদায় করেছে আগে,/ আমাদের ’পরে দেনা শোধবার ভার।’
অতিসম্প্রতি স্বাস্থ্য-কৃষি-শিক্ষা-সামাজিক নিরাপত্তাসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ খাতের উন্নয়ন নিশ্চিতকল্পে ২০২০-২১ সালের বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বাজেট প্রস্তাবনা ও অনুমোদন নি:সন্দেহে দেশবাসীর মনোবলকে অধিকমাত্রায় দীপ্র করেছে। দ্রæততার সাথে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা, বিনিয়োগ কর্ম-কৌশল ও বাস্তবায়নের কর্মযজ্ঞ কল্পিত পরিকল্পনায় নয়, প্রায়োগিক ক্ষেত্রে দৃশ্যমান কার্যকর কর্মযজ্ঞই সকলের কাম্য। অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের গতি প্রবাহ বা জীবন ঝুঁকির অবমুক্তি ঘটাতে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সুরক্ষা সরঞ্জাম এবং প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ-বিতরণে দুর্বৃত্তায়ন নির্মূল করে স্বাস্থ্যখাতের দ্রæততম উন্নয়ন অপরিহার্য। ভয়কে জয় করে জনমনে সাহস সঞ্চয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে উৎসাহ-অনুপ্রেরণা-প্রণোদনার সমন্বিত উদ্যোগই কার্যকর অবলম্বন হিসেবে বিবেচিত।
স্বপ্রণোদিত সতর্কতা ও সচেতনতায় প্রত্যেক মানুষ ঋদ্ধ না হলে সরকার বা কোন প্রতিষ্ঠানের পক্ষেই এই করোনাযুদ্ধে জয়ী হওয়ার স্বপ্ন অযাচিত হবে। সে জন্যই বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক এই মহামারীর সংক্রমণ প্রতিরোধে আরোপিত নির্দেশনা ও স্বাস্থ্যবিধি যথাযথ প্রতিপালন অতীব জরুরী। হাসিমুখে সময় বেষ্টনীকে কেন্দ্র করে গৃহবন্দীর নিজের ও পরিবারের নিরাপদ অবস্থান সংক্রমণের মাত্রা ও পরিধিকে সীমিত ও সহনীয় পর্যায়ে রাখার দায়িত্ব প্রত্যেকের উপর বর্তায়। বিভিন্ন সম্প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত ‘আমরা ঘরে করোনা দূরে’ বার্তাকে কঠোর ধারণই হবে সংক্রমণ বিস্তার প্রতিরোধের পাঠ অনুশীলনের উৎকৃষ্ট পরিক্রমা। যেনতেনভাবে সকল স্তরের শিক্ষা কার্যক্রম উন্মুক্ত করে দিয়ে অব্যবহিত পরেই যেন তা আবার বন্ধ করতে না হয় তার নিগূঢ় পর্যালোচনা-বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
বিশ্বকবি রবীঠাকুরের ‘প্রার্থনা’ কবিতার পংক্তি – ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির, জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর/আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী/বসুধারে রাখে নাই খন্ড ক্ষুদ্র করি, যেথা বাক্য হৃদয়ের উৎসমুখ হতে উচ্ছ¡সিয়া উঠে, যেথা নির্বারিত ¯্রােতে দেশে দেশে দিশে দিশে কর্মধারা ধায়/অজ¯্র সহ¯্রবিধ চরিতার্থতায়’, সূত্রজ্ঞেয় শিক্ষা-জ্ঞানের প্রকৃতি ও পরিধি নির্ধারণ বর্তমান সময়ের জরুরী তাগিদ। সমসাময়িক পর্যালোচনায় দেখা যায় শিক্ষা নিয়ে কমবেশি আলোচনা-পর্যবেক্ষণ সচেতন মহলে অভিগামী হলেও জ্ঞানগত বিষয় নিয়ে উচ্ছোষণ কৃতাত্মা তৈরি অনেকটুকু পিছিয়ে আছে। কোন ধরনের নিবিড় কর্মপরিকল্পনায় উপযোগিতা যাচাই-বাচাই ব্যতিরেকে আমাদের মতো দরিদ্রপীড়িত দেশে গ্রাম্য জনপদে বসবাসকারী অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের অন-অফ-দূরদর্শন জ্ঞান বিতরণের প্রক্রিয়া ভবিষ্যতে প্রশ্নবিদ্ধ হবে কিনা তারও নৈর্ব্যত্তিক বস্তুনিষ্ঠ অনুক্রম নির্ণয়ের প্রয়োজনীয়তার দাবি রাখে।
আধুনিক জ্ঞান সভ্যতার কিংবদন্তি অবেক্ষক দর্শনশাস্ত্রের জনক মহাজ্ঞানী সক্রেটিসের মতানুসারে মূল্যবান পোষাক-পরিচ্ছদ বাইরের আবরণ মাত্র। মানুষের সত্যিকার সৌন্দর্য হচ্ছে হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত জ্ঞান। তিনি বলেছিলেন, ‘জ্ঞানই সর্বোত্তম গুন’, ‘জ্ঞানই শক্তি’। শিক্ষা ও জ্ঞানের নিগূঢ় বিভাজন গর্বিত উপলব্ধিতে আনা না হলে প্রত্যয় দু’টির ব্যাখ্যা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। প্রকৃত অর্থে জ্ঞান হলো শিক্ষার পরিশীলিত-পরিমার্জিত অনুধাবন। যে শিক্ষা অন্যের কষ্টে বা অন্য-হৃদয়ের রক্তক্ষরণ নিজের বিবেককে তাড়িত ও বোধকে বেদনাকাতর না করে, সে শিক্ষা কখনো জ্ঞানে রূপান্তরিত হয়না। সক্রেটিস মূলত: সত্যাশ্রয়ী জ্ঞানের প্রকৃত ধারক ছিলেন বলেই মিথ্যার কাছে আত্মসমর্পণ না করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা অধিকতর শ্রেয় মনে করেছেন। এই সত্য-প্রচার অপরাধেই তাঁকে হেমলক গাছের ভয়ানক বিষাক্ত রস-বিষ পানে আত্মাহুতি দিতে হয়েছিল।
আমাদের অনেকেরই হয়ত জানা যে, মহান জ্ঞানসাধক ডায়োজীনিস জ্ঞান অনুসন্ধানে জীবনে কখনো বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম করেননি। জ্ঞানের আরেক মহানসাধক এরিষ্টটল সম্পর্কে মহাবীর আলেকজান্ডার বলেছিলেন, ‘আমার জীবনের জন্য হয়ত আমি আমার জন্মদাতা পিতার কাছে ঋণী। কিন্তু আমাকে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য সত্যিকার মানুষ করে গড়ে তুলেছেন আমার শিক্ষাগুরু এরিষ্টটল’। ভারতের জাতীয় ভাবধারার কালোত্তীর্ণ প্রাণপুরুষ রাজা রামমোহন রায় বাল্যকাল থেকে শিক্ষা অর্জনকে জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন এবং গবেষণালব্দ সন্ধুক্ষণের মাধ্যমে হিন্দু ধর্মের প্রচলিত সাকার উপাসনা বা মূর্তিপূজাকে অস্বীকার করে বই রচনা করার জন্য পিতা কর্তৃক পরিবার পরিত্যক্ত হন।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের আদি জনক হিপোক্র্যাটিস এর অমর বাণী ছিল- ‘জীবন খুব সংক্ষিপ্ত, কিন্তু শিক্ষা দীর্ঘতর। সুদিন চলে যাচ্ছে। পরীক্ষা নিরীক্ষা করা বিপজ্জনক এবং বিচার বিবেচনা করাও খুব কঠিন কাজ। তবুও আমাদের তৈরি থাকতে হবে, সে শুধু আমাদের নিজের সুখের জন্য নয়। অপরের জন্যও।’ বিশ্বখ্যাত বরেণ্য জ্ঞানসাধকসহ প্রায় সকল মনীষীর জীবনপ্রবাহের পথ পরিক্রমায় শিক্ষাই ছিল অতীন্দ্রিয় পাথেয়। ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড’ এই প্রচলিত প্রবাদবাক্য শুধু বাচনিক প্রকরণে নয়, প্রয়োগিক বিবেচনায় সর্বকালেই সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ বাহন ছিল।
উন্নত বিশ্বে উন্নয়নের পিছনে প্রণিধানযোগ্য বিনিয়োগ হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষার আধুনিক ও যুগোপযোগী পাঠ্যক্রম, জ্ঞানসৃজনে সমৃদ্ধ গবেষণা, মেধাসম্পন্ন যোগ্যতর শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার যথার্থ নিরপেক্ষ মূল্যায়ন ব্যতীত গুনগত শিক্ষার বাস্তবায়ন সমধিক কল্পনাপ্রসূত। শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতিটি স্তর; প্রাথমিক-মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক-¯œাতক-¯œাতকোত্তরসহ অধিকতর উচ্চশিক্ষায় প্রতিভা-দীপ্ত ব্যক্তিদের প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের অনুশীলন-নির্ভর উৎকর্ষ ফলাফলই নির্ধারণ করতে পারে গুনগত শিক্ষার মানদÐ। আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক তথ্য-প্রযুক্তি-মনন-সৃজনশীল জ্ঞানের উন্মেষই ‘মানবপুঁজি’ বা সমৃদ্ধ মানবসম্পদ উৎপাদনে সুষ্ঠু ভূমিকা পালন করতে পারে। তথ্য প্রযুক্তির অপব্যবহার নয়; পরিপূর্ণ যথার্থ ব্যবহারের মাধ্যমেই শিক্ষার প্রচার ও প্রসার আগামী দিনের বাংলাদেশকে চতুর্থ শিল্পবিল্পবের যোগ্য সারথী করে তুলবে। অন্যথায় কুরুচি-কুপ্রণোদনা-কুমানুষিকতা-কুকর্ম সম্পাদনে কুৎসিত মনোবিকারের বিকাশ ঘটাবে- নিঃসন্দেহে তা বলা যায়।
আনুষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার সর্ব-অধিকাংশ ক্ষেত্রে ন্যূনতম প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণবিহীন বা ক্ষেত্রবিশেষে দ্বিতীয়-তৃতীয় শ্রেণিপ্রাপ্তদের শিক্ষা প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদ-পদায়নে গুনগত শিক্ষার প্রচার ও প্রসার সুদূরপরাহত বলেই অনুমেয়। মুখরোচক বিভিন্ন গুঞ্জনে প্রচারিত যে; দেশ বা প্রতিবেশী দেশসমূহ থেকে অর্জিত উচ্চশিক্ষা বা পিএইচ.ডি ডিগ্রীধারীদের কেউ কেউ অন্যদের দিয়ে অভিসন্দর্ভ লিখিয়ে নেওয়ার প্রবণতা গুনগতশিক্ষা বা গবেষণার ভাবমূর্তিকে প্রচন্ড প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। এধরনের উচ্চতর ডিগ্রী ব্যবহার করে বর্ণচোরা-অণুপ্রবেশকারী-দল ও নীতি বদলে পারদর্শী ব্যক্তিবর্গের কথিত রাজনৈতিক পরিচয়-তদবির-লবিং বা অনৈতিক পন্থায় নানাস্তরে নিয়োগ-পদ-পদায়ন কোনভাবেই জাতির অত্যুজ্জ্বল ভবিষ্যত রচনা করতে পারে না।
উচ্চশিক্ষায় শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ন্যূনতম শর্ত পূরণ না করা সত্তে¡ও নিয়োগ বাণিজ্য শুধু নিজস্ব বাহিনী সৃষ্টির নামান্তর মাত্র। এভাবে নিয়োগ-পদ-পদক অর্জন অশুভ শক্তিমত্তা দিয়ে চর দখলের মত ভূমিদস্যুদের বশংবদদেরই অধিকতর অপকর্মে জড়িয়ে ব্যক্তিস্বার্থ সিদ্ধির পথকেই প্রশস্ত করবে। গুনগত শিক্ষার প্রকৃতি ও পরিধির চলমান মিথস্ক্রিয়া অব্যাহতভাবে প্রণোদিত হলে কোন এক সময় জাতি-রাষ্ট্র হেত্বাভাস চরিত্রকে ধারণ করার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। অনুগ্রহ-কৃপা-বদান্যতা-অনুকম্পা-আবেগাশ্রিত অনুদান যথাযোগ্য স্থানে প্রযোজ্য না হলে দেশের শিক্ষা বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে অপরিমেয় ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী। এক্ষেত্রে শিক্ষা পরিবারের সর্বোচ্চ অভিভাবক মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী-উপমন্ত্রী-শিক্ষা প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তার একনিষ্ঠ ভূমিকা কষ্টসাধ্য হলেও বস্তুনিষ্ঠ যাচাই-বাছাইয়ের দীয়মানতা অতীব জরুরী হয়ে পড়েছে বলে মনে হয়।
মেধাবী শিক্ষার্থী ও রাষ্ট্রের জন্য মানবসম্পদ-সমৃদ্ধ উন্নততর পরিবেশ তৈরিতে উৎকৃষ্ট জ্ঞানসৃজন ও বিতরণে ব্যত্যয় ঘটলে জাতিকে ভবিষ্যতে কঠিন মূল্য দিতে হবে। নিচ্ছিদ্র অন্ধকার পথ নির্ণয় ও প্রদর্শনে অপকৌশল, ছলচাতুরী, প্রতারণা, জালিয়াতি, অনৈতিক অর্থ-বিনিময়ে অপসংস্কৃতি অনুকরণে নিয়োজিত ব্যক্তিদের শুধু স্বীয় বিবেকের আদালতে নয়, দেশবাসীর প্রচÐ ক্ষোভ-নিন্দা-ঘৃণা-আক্রোশের কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর প্রতিধ্বনি দ্রæত ঘনীভূত। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় বিগত কয়েক মাসে প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থীর নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার বিষয়টি উপস্থাপিত হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ভিত্তিক শিক্ষা বিশেষ করে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে বিবেচনায় নিয়েই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, মাধ্যামিক ও উচ্চশিক্ষা, কারিগরি-বৃত্তিমূলক ও মাদ্রাসা শিক্ষাখাতে বাজেট বরাদ্দের আকার যথাক্রমে ২৪,৯৪০ কোটি, ৩৩,১১৭ কোটি ও ৮,৩৪৪ কোটি টাকা। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সুনির্দ্দিষ্ট কোন কর্মকৌশল বা ধারণাপত্রের উপস্থাপন ছাড়া বাজেট বক্তব্য সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলেই বিভাবিত হয়।
যুগে যুগে ধার্মিকতা-মানবিকতা-অসাম্প্রদায়িকতা-মনুষ্যত্ব-সত্যবাদিতার জয়গানে শিক্ষা-জ্ঞান হয়েছে প্রাগ্রসর সভ্যতার চন্দ্রাতপ আরাধনা। বিজ্ঞান-সমাজবিজ্ঞান-ব্যবসায় প্রশাসন-তথ্য-প্রযুক্তি-কারিগরী শিক্ষায় উঁচুমানের গবেষণালব্ধ ফলাফল এবং এর দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সূচকে নৈর্ব্যত্তিক তাৎপর্য-বিচার ব্যতীত গুনগত শিক্ষার প্রতিশ্রæতি শুধু অসার প্রতিগ্রাহই হবে। করোনা ও এর অতিক্রান্তকালে দ্রæততার সাথে আধুনিক ও যুগোপযোগী পাঠ্যক্রম, সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা, রুচিশীল বিনোদন এবং মনন-সৃজনশীল কর্মযজ্ঞের পরিচর্যা-অনুশীলনে সকলকে মনোযোগী হতে হবে। অশিক্ষা-কুশিক্ষা-অর্ধশিক্ষা-ধর্মান্ধতা-অপসংস্কৃতির কুৎসিত বাতাবরণে লিঙ্গভেদে অপ্রাপ্তবয়স্ক সকল স্তরের মানুষের অসামাজিক কার্যক্রম-মাদকসেবন বা অপ্রকৃতিস্থ অপরাধ সংহার করার প্রায়োগিক কর্মকৌশল এবং পরিপত্র অত্যাজ্য।
মহান ¯্রষ্টার কাছে আকুল নিবেদন – বাংলাদেশসহ পুরোবিশ্ববাসীকে যেন এই মহামারী-মহাদুর্যোগ থেকে উদ্ধার করে মানবিকতা, মনুষ্যত্ব ও ধার্মিকতার যোগ্যতম মানবসন্তানদের বিশ্ব কল্যাণ ও মঙ্গল সাধনে নবতর জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা, তেজস্বী সাহস ও মনোবল প্রদান করেন। রবীঠাকুরের ‘ত্রাণ’ কবিতার পংক্তি দিয়েই ক্ষুদ্র নিবন্ধের ইতি টানতে চাই – ‘এ দুর্ভাগ্য দেশ হতে, হে মঙ্গলময়,/ দূর করে দাও তুমি সর্ব তুচ্ছ ভয় Ñ/ লোকভয়, রাজভয়, মৃত্যুভয় আর।/দীনপ্রাণ দুর্বলের এ পাষাণভার।’
লেখক: শিক্ষাবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়