শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাস্তানি চলবে না

47

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘মাস্তানিতে’ জড়িতদের ধরতে সারা দেশের সব কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তল্লাশির কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই অভিযানে কারও দলীয় পরিচয় দেখা হবে না বলেও হুঁশিয়ার করেছেন তিনি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একটি হলে ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মীর নির্যাতনে আবরার ফাহাদ নামে এক ছাত্রের মৃত্যুর প্রতিবাদে দেশব্যাপী আন্দোলনের মধ্যে একথা বলেছেন তিনি।
জাতিসংঘ ও ভারত সফর নিয়ে গতকাল বুধবার গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নোত্তরে শেখ হাসিনা বলেন, প্রত্যেকটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রতিটি হল; শুধু ঢাকা না, সারা বাংলাদেশে প্রত্যেকটা জায়গায় সার্চ করা হবে। সেই নির্দেশটাও আমি দিয়ে দেব।
উপস্থিত সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, এখানে আমি আপনাদের মাঝেই বলে দিচ্ছি, সেটা করব করব। আপনাদের সহযোগিতা চাই। আপনারা বের করে দেন যে, কোথায়, কারা এই ধরনের অনিয়ম, উছৃঙ্খলতা করছে। কোনও দল টল আমি বুঝি না। পরিষ্কার কথা, কোনও দল আমি বুঝি না। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতিটি ছাত্রের পেছনে সরকারি অর্থ খরচের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সামান্য টাকা ১০ টাকা, ২০ টাকা, ৩০ টাকায় সিট ভাড়ায় একেকজন রুমে থাকবে। আর তারপর সেখানে বসে এই ধরনের মাস্তানি করবে। আর সমস্ত খরচ বহন করতে হবে জনগণের পয়সা দিয়ে। এটা কখনও গ্রহণযোগ্য না।
গত রোববার গভীর রাতে বুয়েটের শেরে বাংলা হলের সিঁড়ি থেকে তড়িৎ কৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরারের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
ফেসবুকে মন্তব্যের সূত্র ধরে শিবির সন্দেহে আবরারকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে বুয়েট ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তাকে হলের একটি কক্ষে পিটিয়ে হত্যা করেছে বলে সংগঠনটির তদন্তেই উঠে এসেছে।
ওই ঘটনায় বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেলসহ ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। সংগঠন থেকেও তাদের বহিষ্কার করা হয়েছে। খবর বিডিনিউজ ও বাংলা ট্রিবিউনের
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে চাঁদা দাবির অভিযোগে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে শোভন-রাব্বানীকে সরিয়ে দেওয়ার পরেও বুয়েট ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের এ ঘটনা ঘটানোকে কীভাবে দেখছেন সেই প্রশ্ন করেছিলেন একজন সাংবাদিক।
জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, আমি আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাকে বলব। যখন এই ঘটনা একটা জায়গায় ঘটেছে এবং যখন দেখা গেছে এক রুম নিয়ে বসে জমিদারি চাল চালানো। তাহলে প্রত্যেকটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রতিটি হল সব জায়গায় সার্চ করা দরকার। কোথায় কী আছে না আছে খুঁজে বের করা এবং এই ধরনের মাস্তানি কারা করে বেড়ায়, কারা এই ধরনের ঘটনা ঘটায় সেটা দেখা।
যতরকম উচ্চ শাস্তি আছে, এদের হবে
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে যারা ‘পিটিয়ে পিটিয়ে অমানবিকভাবে’ হত্যা করেছে, তাদের কঠিনতম শাস্তি হবে।
তিনি বলেন, কেউ যদি কোনো অপরাধ করে, সে কোন দল, কী করে না করে, আমি কিন্তু সেটা দেখি না। আমার কাছে অপরাধী অপরাধীই। আমরা অপরাধী হিসেবেই দেখি।
দীর্ঘ সাড়ে ছয় ঘণ্টা আবরারের ওপর কীভাবে নির্যাতন চালানো হয়েছে, ছাত্রলীগ কর্মীরা মাতাল অবস্থায়ী কীভাবে ক্রিকেট খেলার স্টাম্প দিয়ে আবরারকে পিটিয়েছে, সেই বিবরণ ইতোমধ্যে সংবাদমাধ্যমে এসেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ নৃসংসতা কেন? এই জঘন্য কাজ কেন? এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। যতরকমের উচ্চ শাস্তি আছে সেটা দেওয়া হবে। কোনো সন্দেহ নেই। দল-টল বুঝি না। অপরাধের বিচার হবেই।
আওয়ামী লীগের কেউ এ ধরনের ঘটনা ঘটাবে, তা কখনোই মেনে নেবেন না মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, ঘটনা জানার পর তিনি সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রলীগকে ডেকে বলেছেন, জড়িতদের যেন বহিষ্কার করা হয়।
এখানে আমি বিবেচনা করব না কিসের ছাত্রলীগ। অপরাধী অপরাধীই। অন্যায় করেছে, সে অন্যায়কারী। তার বিচার হবে। কারও দাবি-টাবির অপেক্ষায় থাকি না। আগেই আমি নির্দেশ দিয়ে দিয়েছি। গ্রেপ্তার হয়েছে।
ওই ঘটনায় বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেলসহ ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ওই ১৩ জনসহ মোট ১৯ জনের নামে চকবাজার থানায় মামলা করেছেন আবরারের বাবা।
ঘটনার পর থেকেই খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তিসহ দশ দফা দাবিতে আন্দোলন করছে বুয়েট শিক্ষার্থীরা। তাদের আন্দোলনের মুখে শেরেবাংলা হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক জাফর ইকবাল খান ইতোমধ্যে পদত্যাগ করেছেন।
ফুটেজ সংগ্রহে বাধা দিল কারা?
সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বুয়েটে যে ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনা খুব সকাল বেলা জানার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছিলাম আলামত সংগ্রহ করার জন্য। সাথে সাথে এটাও বলেছিলাম যে সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করতে। তারা সেখানে পৌঁছে যায়। আলামত সংগ্রহ করে এবং সিসিটিভি ফুটেজগুলো দীর্ঘসময় ধরে সংগ্রহ করে।
যখন পুলিশ সিসি ক্যামেরা থেকে ফুটেজ হার্ডডিস্কে নিয়ে আসছে তখন তাদেরকে ঘেরাও করা হল। তাদেরকে ফুটেজ নিয়ে আসতে দেওয়া হবে না। আইজিপি যোগাযোগ করল, বলল, আমাদের লোকদের আটকে রেখে দিয়েছে। আলামত নিয়ে আসতে দিচ্ছে না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ফুটেজগুলো আনতে দেবে না কেন? তারা বলছে, ফুটেজগুলো পুলিশ নষ্ট করবে। পুলিশ গেছে আলামত সংগ্রহ করতে। ডেডবডির যাতে পোস্টমর্টেম হয়, সে ব্যবস্থা করা হল। ছাত্ররা নামার আগেই সাথে সাথে ব্যবস্থা নেওয়া কোন রুম, কোথায়, কারা ছিলো যেটাকে পারো সবকটাকে ধরে অ্যারেস্ট করো। যে কটাকে হাতে পেয়েছি সবগুলোকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখানে প্রশ্নটা আমার। পুলিশকে আসতে দেবে না, আলামত নিতে দেবে না। আমি আইজিকে বললাম, বলা যায় না এর মধ্যে কী যারা ঘটনা ঘটিয়েছে তারা আছে? ফুটেজ পেলে পরে তারা ধরা পড়ে যাবে এজন্য তারা পরবর্তীতে এই ফুটেজগুলো সংগ্রহ করে এবং একটা কপি কর্তৃপক্ষকে দিয়ে আসে। সেগুলো দেখে আইডেন্টিফাই করা দরকার ছিল, যেটা করা হচ্ছে এখন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কে ছাত্রলীগ, কে ছাত্রদল কে, কী করে আমি সেটা বিবেচনা করিনি। আমি বিবেচনা করেছি অন্যায়ভাবে একটা বাচ্চা ছেলে ২১ বছরের ছেলে পিটিয়ে পিটিয়ে কি অমানবিক!
পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দেখেছেন। বাইরে অত ইনজুরি নেই, সমস্ত ইনজুরি ভিতরে। যে জিনিসটা আমার মনে পড়ল ২০০১ সালে বহু নেতা-কর্মীকে এমনভাবে পিটানো হত, বাইরে থেকে ইনজুরি নেই, তারা মারা যেত।
শেখ হাসিনা বলেন, স্বাভাবিকভাবে এটা সন্দেহের বিষয়। এরা কারা? হ্যাঁ, ক্ষমতায় থাকলে অনেকে দল করতে আসে। কিছু লোকতো আছে পার্মানেন্ট গভর্মেন্ট পার্টি। এরকম কিছু থাকে। যারা এ ধরনের ঘটনা ঘটায় তারা আমার পার্টির এটাতো আমি কখনোই মেনে নেব না।
কারা পুলিশকে ফুটেজ নিতে বাধা দিয়েছে, তা খুঁজে দেখতে বলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ফুটেজ হাতে পাওয়ার পর বেছে বেছে বের করতে পুলিশের জন্য সুবিধা হয়েছে। এটা একটু খোঁজ করেন, কেন বাধা দেওয়া হল। তিনটে ঘণ্টা সময় কেন নষ্ট করল? আমি জানি না এর উত্তর আছে কিনা। আন্দোলনই বা কিসের জন্য? বিচার হবেই।
ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের বিপক্ষে শেখ হাসিনা
আবরার ফাহাদ হত্যাকান্ডের পর বুয়েট শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ থেকে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের যে দাবি উঠেছে, তা নাকচ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে তিনি বলেছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বুয়েট তাদের ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে পারে।
বুয়েটছাত্র আবরারকে তার হলে ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই হত্যার প্রতিবাদে উত্তাল বুয়েটে শিক্ষার্থীরা ১০ দফা দাবি তুলেছেন, যার একটি হল ছাত্র সংগঠনের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা।
এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, একটা ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি উঠাবে যে ছাত্র রাজনীতি ব্যান। আমি নিজেই যেহেতু ছাত্র রাজনীতি করে এসেছি। সেখানে আমি ছাত্র রাজনীতি ব্যান বলব কেন?
বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনের উজ্জ্বল ইতিহাস তুলে ধরে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, আসলে এই দেশের প্রতিটি সংগ্রামের অগ্রণী ভূমিকা কিন্তু ছাত্ররাই নিয়েছেন। আমি ছাত্র রাজনীতি করেই কিন্তু এখানে এসেছি। দেশের ভালো-মন্দের বিষয়টা ওই ছাত্রজীবন থেকে আছে বলেই আমরা দেশের জন্য কাজ করতে পারি। কিন্তু যারা উড়ে এসে বসে, তারা আসে ক্ষমতাটাকে উপভোগ করতে। তাদের কাছে তো দেশের ওই চিন্তা-ভাবনা থাকে না।
রাজনীতি একটা শিক্ষার ব্যাপার, প্রশিক্ষণের ব্যাপার, জানার ব্যাপার। সেটা ছাত্ররাজনীতি থেকেই কিন্তু ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে, বলেন তিনি।
বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতি কলুষিত করার জন্য সামরিক শাসকদের দায়ী করেন শেখ হাসিনা।
নষ্ট রাজনীতি যেটা, সেটা তো আইয়ুব খান শুরু করে দিয়েছিল, আবার জিয়াউর রহমান এসে শুরু করল একইভাবে এবং দুইজনের ক্ষমতা দখলের চরিত্র একই রকম। আমাদের দেশের অসুবিধাটা হল, বারবার মিলিটারি রুলাররা এসেছে। আর এসে এসে মানুষের চরিত্র হরণ করে গেছে।
একবারে ছাত্র রাজনীতি ব্যান করে দিতে হবে, এটা তো মিলিটারি ডিক্টেটরদের কথা। আসলে তারা এসে তো সবসময় পলিটিকস ব্যান স্টুডেন্ট পলিটিক্স ব্যান তারাই করে গেছে।
আবরার হত্যাকান্ডের সঙ্গে রাজনীতির কোনো যোগসূত্র নেই দাবি করে শেখ হাসিনা বলেন, এটাতো রাজনৈতিক হত্যাকান্ড না। ছাত্র রাজনীতিকে দোষারোপ করার কোনো মানে হয় না। এই যে ছেলেকে হত্যা করল, এর সাথে রাজনীতিটা কোথায়? এর পেছনের কারণটা কী, খুঁজে বের করতে হবে। এই যে একটা সন্ত্রাসী ঘটনা বা এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই তো সংগঠন করা নিষিদ্ধ আছে। বুয়েট যদি মনে করে, তাহলে তারা বন্ধ করে দিতে পারে। এখানে আমরা কোনো হস্তক্ষেপ করব না, বলেন সরকারপ্রধান।
এর আগে জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার শাসনামলে ছাত্রলীগ নেতাদের ‘রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের’ শিকার হওয়ার কথা তুলে ধরেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী।
স্বায়ত্তশাসিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরকারের অর্থ ব্যয়ের বিষয়টি দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনারা একবার হিসাব করে দেখেন একজন ছাত্রের পেছনে সরকার কত টাকা খরচ করে। একজন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা এক গ্রাজুয়েট তৈরি করতে সরকার কত টাকা খরচ করে?
স্বাধীনতা ভালো, তবে তাহা বালকের জন্য নহে। এটাও একটা কথা আছে। কারণ স্বাধীনতার যে মর্যাদা দিতে পারবে, তার জন্যই ভাল। সেটাও মাথায় রাখতে হবে, বলেন তিনি।
ভারতে এলপিজি যাবে, প্রাকৃতিক গ্যাস নয়
ভারতের কাছে গ্যাস বিক্রির চুক্তি নিয়ে সমালোচনার জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশ এলপিজি রপ্তানি করবে, প্রাকৃতিক গ্যাস নয়; এ নিয়ে ভুল বোঝাবুঝিরও কোনো অবকাশ নেই।
সংবাদ সম্মেলনে ভারতের সঙ্গে করা চুক্তি নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা বিদেশ থেকে এলপিজি এনে প্রক্রিয়াজাত করে ভারতে রপ্তানি করব। এতে করে আমাদের ভ্যালু এড হবে। সেই গ্যাস আমরা রপ্তানি করব। এটা প্রাকৃতিক গ্যাস নয়। বরং আমাদের রপ্তানির তালিকায় নতুন একটি পণ্য যুক্ত হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এলপিজি প্রাকৃতিক গ্যাস নয়, এটা বাংলাদেশে উৎপাদিত হয় না। বিদেশ থেকে কিনে আনা অপরিশোধিত পেট্রোলিয়াম শোধন করার সময় বাই প্রডাক্ট হিসেবে কিছুটা এলপিজি পাওয়া যায়। আবার গ্যাস উত্তোলনের সময় কিছুটা তেল পাওয়া যায়, যা থেকে অকটেন ও পেট্রোলের পাশাপাশি সামান্য এলপিজি পাওয়া যায়।

আমাদের দেশে আগে খুব অল্প পরিমাণ এলজিপি তৈরি হত। এখন সরকার এলপিজি আমদানি করে দেশে বোতলজাত করতে ব্যবসায়ীদের উৎসাহ দিচ্ছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে ২৬টি প্রতিষ্ঠান বিদেশ থেকে আমদানি করা এলপিজি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত আছে। ১৮টি কোম্পানি নিজস্ব প্ল্যান্ট থেকে এলপিজি প্রক্রিয়াজাত করার সঙ্গে যুক্ত আছে।
এসব তথ্য তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা ত্রিপুরায় যে গ্যাসটা দিচ্ছি এটা কিন্তু সেই এলপিজি, বটল গ্যাস। আমরা আমদানি করছি বাল্কে, আমরা বোতলজাত করে নিজেদের দেশে যেমন সরবরাহ করছি, সেই গ্যাসই আমরা কিছু ত্রিপুরায় দিচ্ছি। এটা হচ্ছে বাস্তবতা।
ভারত সফরের সময় গত ৫ অক্টোবর দুই দেশের মধ্যে সাতটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়, যার একটিতে ভারতের ত্রিপুরায় এলপিজি রপ্তানির কথা বলা হয়েছে।
নয়া দিল্লিতে ওই চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের পর জল্পনা শুরু হয় যে, বাংলাদেশের গ্যাস সঙ্কটের মধ্যে ভারতে কেন রপ্তানি করা হবে। ওই চুক্তিকে ‘দেশবিরোধী চুক্তি’ আখ্যায়িত করে তা বাতিলের দাবি জানায় বিএনপি।
এই প্রেক্ষাপটে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু মঙ্গলবার বিষয়টি স্পষ্ট করে বলেন, বাংলাদেশের কোনও গ্যাস ভারতে রপ্তানি হবে না। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা বিদেশ থেকে এলপিজি আমদানি করে তা ভারতে রপ্তানি করবে।
আর বুধবার গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দেশের স্বার্থ শেখ হাসিনা বিক্রি করে দেবে এটা কখনও হতে পারে না। বরং যে যে সমস্যাগুলো ছিল সেগুলো একে একে সমাধান করেছি।
তিনি বলেন, যারা এর বিরোধিতায় সোচ্চার মানে, বিএনপি, ২০০১ সালের কথা মনে করিয়ে দিতে চাই। আমেরিকা গ্যাস বিক্রির জন্য বলেছিল, আমি বলেছিলাম দেশের চাহিদা মিটিয়ে আমরা তারপর বিক্রি করব। যে কারণে ২০০১ সালে আমরা ক্ষমতায় আসতে পারিনি। আর যারা গ্যাস বিক্রি করে দিচ্ছে বলছে, তারাই গ্যাস দেবে বলে মুচলেকা দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল, সেটা বিএনপি-জামায়াত জোট।
পান করার পানি চাইলে তা না দিলে কেমন দেখায়
ভারতের সঙ্গে করা একটি সমঝোতা স্মারকের আওতায় ফেনী নদী থেকে ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি ত্রিপুরার একটি শহরে সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে, যা নিয়েও আপত্তি তুলেছে বিএনপি। এ বিষয়েও সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছিল।
উত্তর দিতে গিয়ে ফেনী নদীর গতিপথ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ নদীর উৎপত্তিস্থল বাংলাদেশের খাগড়াছড়ি। সেখান থেকে মাটিরাঙা হয়ে ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত হয়ে এগিয়েছে এ নদী। এর ৯৪ কিলোমিটার পড়েছে দুই দেশের সীমান্তে। বাংলাদেশের ভেতরে আছে শুধু ৪০ কিলোমিটার, যেটা ফেনীর সোনাগাজী হয়ে সাগরে চলে গেছে।
সীমান্তবর্তী হওয়ার কারণে দুই দেশই ওই নদীর পানি ব্যবহার করে। যে অংশ থেকে পানি নেওয়া হচ্ছে, তা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পড়ার কারণেই চুক্তি করতে হয়েছে। বড় অংশটাই হচ্ছে বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তে। সীমান্তবর্তী নদীতে দুই দেশেরই অধিকার থাকে।
একটি অঞ্চলের মানুষের খাবার পানির চাহিদা মেটাতেই ওই পানিটুকু দেওয়া হচ্ছে এবং এর পরিমাণ খুবই নগণ্য বলে মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ভারতের সাবরংয়ের মানুষের খাবার পানির খুব অভাব। তারা আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে পানি তোলে। সেখানে সামন্য পানি আমরা দেব। যে চুক্তিটা ভারতের সাথে হয়েছে সেটা তাদের খাবার পানির জন্য। পান করার জন্য কেউ পানি চাইলে তা না দিলে কেমন দেখায়।
১ দশমিক ৮২ কিউসিক পানি তারা নেবে। যে পানিটুকু তাদের দিচ্ছি সেটার পরিমাণ অত্যন্ত নগণ্য। এতবড় একটা নদী, এই নদীর যে পরিমাণ পানি আসে তা আমরাও ব্যবহার করি, তারও ব্যবহার করে। এত চিৎকার কিসের জন্য আমি ঠিক জানি না।
শেখ হাসিনা বলেন, কেউ যদি পানি পান করতে চায়, আমরা যদি সেই পানিটা না দেই সেটা কেমন দেখায়? আমাদের তো আরও সীমান্তবর্তী নদী আছে, সেটা তো আমাদের চিন্তা করতে হবে।
সাতটি আন্তঃসীমান্ত নদীতে যৌথভাবে ড্রেজিং করার পরিকল্পনার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, এসব নদীর নাব্যতা রক্ষা এবং অন্যান্য বিষয়ে নিয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনা চলছে।
ফেনী নদীর পানি প্রত্যাহারের চুক্তি নিয়ে বিএনপির সমালোচনার উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি নেতাদের কাছে আমার প্রশ্ন, জিয়াউর রহমান বা খালেদা জিয়া যখন ভারতে গিয়েছিল, তারা গঙ্গার পানি চুক্তি করতে পেরেছিল? খালেদা জিয়াকে চুক্তি সম্পর্কে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি বলেছিলেন, ‘ভুলেই গিয়েছিলাম’।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সফরে ভারতের সঙ্গে যেসব চুক্তি হয়েছে, তার সব জায়গায় বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করা হয়েছে।
আসামের নাগরিক পঞ্জি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আসামের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত শান্তই। কোনো অসুবিধা হয় নাই। প্রধানমন্ত্রী মোদীকে আমি যখন জানিয়েছি, তখন উনি বলেছেন, কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা না। যখন অসুবিধা হয়নি, তখন উদ্বিগ্ন হওয়ারও কিছু নেই।
ত্রিপুরাকে চট্টগ্রাম সমুদ্র ও বিমানবন্দর ব্যবহারের প্রস্তাব দিয়েছি
ভারতের ত্রিপুরাকে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তার কথা হয়েছে। ত্রিপুরাকে যোগাযোগ সুবিধার জন্য চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর এবং চট্টগ্রাম বিমানবন্দর ব্যবহারের প্রস্তাব দিয়েছি। তারা আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের জন্য চট্টগ্রাম বিমানবন্দর ব্যবহার করতে পারে। তারা বিমানবন্দর ব্যবহার করলে আমরা বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হবো বলেও মতামত ব্যক্ত করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যেটাই করছি তাতে দেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে। পানি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ত্রিপুরাবাসীকে ফেনী নদীর যে পানি দেওয়া হচ্ছে, তা হচ্ছে খাবার পানি। কেউ খাবার পানি চাইলে, তা যদি না দেই, সেটা কেমন হয়! প্রধানমন্ত্রী বলেন, ত্রিপুরা আমাদের ঐতিহাসিক বন্ধু। মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরার মানুষ আমাদের আগলে রেখেছে। মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছে। সেই ত্রিপুরায় সামান্য খাবার পানি দেওয়ার জন্য আপত্তি থাকতে পারে না।
তিস্তা ও এনআরসি নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তিস্তা নিয়ে আলোচনা অব্যাহত আছে। তিস্তা ছাড়াও আরও সাতটি নদী নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আসামের এনআরসি নিয়ে অসুবিধা হয়নি। এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।
ভারতে সফরে গিয়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকে তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তি ও এনআরসি নিয়ে কতটা আশ্বস্ত হলেন, সাংবাদিক মঞ্জুরুল ইসলামের এমন প্রশ্নের জবাবে এ উত্তর দেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী মোদির কাছে আমি আসামের এনআরসি বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ পর্যন্ত অসুবিধা হয়নি, আর হওয়ারও কথা নয়। তাহলে যেখানে অসুবিধাই হয়নি সেখানে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু দেখি না।
বিশ্ব অর্থনীতি ফোরামের ভারত অর্থনৈতিক সম্মেলনে যোগদান করতে ৩ থেকে ৬ অক্টোবর চারদিন দিল্লি সফর করেন প্রধানমন্ত্রী। সেখানে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন।
এর আগে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) ৭৪তম অধিবেশনে যোগদানের উদ্দেশে তিনি গত ২২ থেকে ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন