শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে টিউশন ফি আদায় ও বিভাগমুক্ত মাধ্যমিক নির্দেশনা কার্যকরে তদারকি প্রয়োজন

35

বৈশ্বিক করোনা ভাইরাস এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এ বছর শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার বৃদ্ধির আশঙ্কা করছেন শিক্ষা চিন্তকমহল। বিশেষকরে, করোনা ও প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণে কর্মহারা, বিদেশ ফেরত প্রবাসীরা আর যেতে না পারার খেসারত দিতে হবে দেশের লাখো শিক্ষার্থীদের। এর বাইরেও বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা মানসিক ও শারিরীকসহ নানারকম সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। আবার বেসরকারি (নন-এমপিও/এমপিও) ও প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহও আর্থিক দৈন্যতার শিকার হয়ে শিক্ষক-কর্মচারিদের নিয়মিত-বেতন-ভাতা ও প্রতিষ্ঠানের দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহ করতে হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থায় শিক্ষা ব্যবস্থায় এক ধরণের হতাশার সৃষ্টি হচ্ছে। দীর্ঘসময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ থাকা সত্তে¡ও কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃক বাড়তি ফি আদায় এবং কোনো কোনো শিক্ষকের কৌশলে অর্থ আদায়ের অভিযোগে অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। আর্থিক সংকটে পড়া অভিভাবকদের কাছ থেকে বিশেষ বিবেচনায় ফি কম নেয়ার দৃষ্টান্তও লক্ষ করা যায়নি। এমনকি দেশের বেশ কিছু বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সামরিক-বেসামরিক বেসরকারী নীতিমালায় পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও অতিরিক্ত টিউশন ফি আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এমন পরিস্থিতিতে বুধবার এ সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি)। এতে কয়েকটি খাতে ফি না নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে স্কুল-কলেজগুলোকে। এ নির্দেশনা সমকালীন পরিস্থিতিতে খুব বেশি প্রয়োজন ছিল। যদিও অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর্থিকভাবে সমস্যায় আছে, তবুও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণে এ সিদ্ধান্ত যথার্থ। মাওউশির এ সিদ্ধান্ত প্রতিপালনে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আন্তরিকভাবে সচেষ্ট থাকবে-এমনটি প্রত্যাশা আমাদের। মনে রাখতে হবে, মাউশির নির্দেশনা পালনে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ দায়িত্বশীলতার পরিচয় না দিলে অনেক শিক্ষার্থীর অপূরণীয় ক্ষতি হবে। অবশ্যই এ জন্য মাউশিকে তদারকি জোরদার করতে হবে।
বলা প্রয়েজন যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও এ সময়ে সংসদ টেলিভিশনে পাঠদানসহ, অনলাইনে অর্থাৎ বিকল্প পদ্ধতিতে পাঠদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু অনলাইন শিক্ষার সাথে যুক্ত হওয়ার জন্য মোবাইল বা লেফটপ এবং নেট ব্যবহারের জন্য যে আর্থিক সংগতি প্রয়োজন, তা না থাকায় বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী এসব কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেনি। হাতেগোনা কিছু প্রতিষ্ঠান অনলাইনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে মাত্র। বছরের শেষদিকে এসে বার্ষিক পরীক্ষা গ্রহণ করতে না পারায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ (নির্ধারিত বাড়ির কাজ) কার্যক্রমে যুক্ত করে সক্রিয় করেছে সরকার। মাউশির নির্দেশনায় বলা হয়েছে, পরিস্থিতি এমন হলেও শতভাগ প্রতিষ্ঠানই নিতে পারবে টিউশন ফি। তবে টিউশন ফি ছাড়া অন্য কোন ফি, এমনকি পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণদের কাজ থেকে ভর্তি বা পুনঃভর্তির টাকাও নেয়া যাবে না। কোনো অভিভাবক আর্থিক সংকটে পড়ে থাকলে তার সন্তানের বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনা করার কথাও বলা হয়েছে। এ নির্দেশনা পালনে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ গড়িমসি করলে তাদের নৈতিকতার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
প্রকৃতপক্ষে আমরা জানি, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সারা দেশের মানুষই করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা আশা করব, কোনো প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে বাড়তি ফি আদায় করে থাকলে তা ফেরত দেবে অথবা টিউশন ফির সঙ্গে সমন্বয় করবে, যেমনটি মাউশির নির্দেশনায় বলা হয়েছে। ২০২১ সালের শুরুতে বৈশ্বিক মহামারী পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে কিনা, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে ইতোমধ্যে প্রাপ্ত তথ্য থেকে অনুমান করা যায়, করোনা পরিস্থিতির দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়ে গেছে। এ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরও কয়েক মাস লাগবে। কাজেই আগামী শিক্ষাবর্ষের শুরুতে পাঠদানের পদ্ধতি কেমন হবে তা এখনই ভাবতে হবে। বিকল্প পদ্ধতির পাঠদান কার্যক্রমের সঙ্গে যাতে সর্বাধিকসংখ্যক শিক্ষার্থী যুক্ত থাকতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। মহামারীর কারণে ইতোমধ্যে উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে, যা দূর করতে সরকারকে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে।
একইসাথে শিক্ষামন্ত্রী গত বৃহস্পতিবার সংসদের মাদ্রাসা বোর্ড সংক্রান্ত একটি বিলের উপর আলোচনা করতে গিয়ে মাধ্যমিক স্তরে বিভিন্ন বিভাজিত বিভাগ অর্থাৎ মানবিক, বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখা বন্ধ করে দিয়ে সকল শিক্ষার্থীদের সার্বজনীন তথা একিভূত শিক্ষার সুযোগ দেয়ার যে ঘোষণা দিয়েছেন-তা যথার্থ ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত বলে আমরা মনে করি। এছাড়া ২০২২ সাল থেকে মাধ্যমিকের সকল পর্যায়ে কারিগরি শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার উদ্যোগও প্রশংসনীয়। আমরা মনে করি, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষার মানোন্নয়নেও যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিজেদের সুনাম ধরে রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে।