শিক্ষা আইন প্রেক্ষিত মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ

98

আলোচিত, সমালোচিত কোচিং ব্যবসা, শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানো এবং নোট ও গাইড বই নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নিচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষা আইনকে ভিত্তি হিসেবে ধরে। এছাড়া সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে নিয়ন্ত্রণ আরোপ এবং অপ্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান বন্ধ বা অন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একীভূত করা হবে। সরকারের অনুমোদন ছাড়া কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান টিউশনসহ অন্য কোনো ফি আরোপ করতে পারবে না। নকলে সহায়তা বা প্রশ্নফাঁসে সহায়তা করলে পেতে হবে কঠোর শাস্তি। শিক্ষার্থীকে শারীরিক নির্যাতন করলে বেতন বন্ধ বা চাকরি যাবে শিক্ষকের। এমন সব বিধান রেখে দীর্ঘ ৬ বছর পরিশ্রম করে আইনপ্রণেতারা শিক্ষা আইনের খসড়া প্রস্তুত করেছেন, যা সংসদের চলতি অধিবেশনে (দশম জাতীয় সংসদের ১৭তম অধিবেশন) উত্থাপন করা হতে পারে।
শিক্ষা আইনের কাজ কী? আমরা কেন শিক্ষা আইনের দিকে তাকিয়ে আছি অধীর আগ্রহে? মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণে শিক্ষা আইন কী ভূমিকা রাখবে? চলমান পরিস্থিতিতে শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান বৈষম্য এবং নীতিবিরোধী কার্যক্রম; যেমন কোচিং, টিউশনি এবং অবকাঠামোগত শর্ত পূরণ না করাসহ প্রশ্নফাঁস রোধকল্পে ও শ্রেণিকক্ষে মানসম্মত পাঠদান নিশ্চিতকরণে একটি কার্যকর শিক্ষা আইন অপরিহার্য। আমরা দীর্ঘদিন ধরে একটা বলিষ্ঠ শিক্ষা আইনের জন্য অপেক্ষা করছি, যা বিদ্যমান শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। অবশেষে দীর্ঘ অপেক্ষার পর ওই কাঙ্খিত শিক্ষা আইন আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে। তবে সে শিক্ষা আইনে কী আছে, যা মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে?
শিক্ষা আইন আগাগোড়া শিক্ষা ব্যবস্থাকে সুচারুরূপে পরিচালনার বিধান। শিক্ষাসংক্রান্ত যাবতীয় বিধান এবং শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের মৌলিক দিকনির্দেশনা ও বাধ্যবাধকতাই শিক্ষা আইন। শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনাকারী এবং শিক্ষা গ্রহণকারী প্রত্যেকেই আইনের বিধান মানতে বাধ্য। কিন্তু আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রের বাস্তবচিত্র কী বলে? গেল সপ্তাহে শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান অনেক অসংগতি তুলে ধরে শিক্ষা সচিব বলেন, ‘শিক্ষা আইনের অভাবে আমরা অনেক কিছু করতে পারি না।’ (১৩.৯.১৭ আলোকিত বাংলাদেশ)।
আলোচিত, সমালোচিত কোচিং ব্যবসা, শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানো এবং নোট ও গাইড বই নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নিচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষা আইনকে ভিত্তি হিসেবে ধরে। এছাড়া সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে নিয়ন্ত্রণ আরোপ এবং অপ্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান বন্ধ বা অন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একীভূত করা হবে। সরকারের অনুমোদন ছাড়া কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান টিউশনসহ অন্য কোনো ফি আরোপ করতে পারবে না। নকলে সহায়তা বা প্রশ্নফাঁসে সহায়তা করলে পেতে হবে কঠোর শাস্তি। শিক্ষার্থীকে শারীরিক নির্যাতন করলে বেতন বন্ধ বা চাকরি যাবে শিক্ষকের। এমন সব বিধান রেখে দীর্ঘ ৬ বছর পরিশ্রম করে আইনপ্রণেতারা শিক্ষা আইনের খসড়া প্রস্তুত করেছেন, যা সংসদের চলতি অধিবেশনে (দশম জাতীয় সংসদের ১৭তম অধিবেশন) উত্থাপন করা হতে পারে।
গত বছর ডিসেম্বরে শিক্ষা আইনের খসড়া আরেকবার মন্ত্রিসভায় উপস্থাপনের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছিল। তখন কোচিং, প্রাইভেট ও নোট বই, গাইড বইকে বৈধতা দেয়ার মতো বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে- এমন আপত্তি উঠলে সেটি ফেরত আনে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মতামত নেয়। প্রস্তাবিত আইনে একটি তফসিলসহ ৫১টি ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে ১৩ পৃষ্ঠার এ আইনে শিক্ষার কয়টি স্তর ও কোন স্তরের মেয়াদ কত বছর তা উল্লেখ নেই। গণমাধ্যমে (৬/৯/১৭ যুগান্তর) প্রকাশিত এমন খবরে আমরা বিস্মিত হয়েছি। গত ডিসেম্বরের খসড়ায় প্রাক-প্রাথমিক (শিশু শিক্ষা) ২ বছর মেয়াদি, ৪ থেকে ৬ বছর বয়স পর্যন্ত উল্লেখ ছিল। বর্তমান জাতীয় শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক শিক্ষা প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণী। মাধ্যমিক শিক্ষা হবে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত। এরপর উচ্চশিক্ষার স্তর।
আগের খসড়া শিক্ষা আইনে কোচিং-প্রাইভেটকে ‘ছায়া শিক্ষা’ নামে উল্লেখ করা হয়েছিল, যা নিয়ে সাধারণের মনে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থার শ্রেণিকক্ষের পাঠদান পদ্ধতির মান নিয়ে অনেক প্রশ্নের উদ্রেক হয়। প্রথম প্রশ্ন- শ্রেণিকক্ষে শ্রেণিশিক্ষক কি যথাযথ পাঠদানে অপারগ? অথবা পাঠ পরিকল্পনা, পাঠবিন্যাস বা নির্ধারিত সিলেবাস যথাযথ নয়? উপযুক্ত শিক্ষকদের দ্বারা পরিচালিত শিক্ষা ব্যবস্থার উপযুক্ত হিসেবে স্বীকৃতি নয় বা যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগকৃত নয়, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয়- এমন শিক্ষকদের দ্বারা ‘ছায়া শিক্ষা’ নামক শিক্ষার প্রশ্নইবা কেমন করে উত্থাপিত হয়, তা বোধগম্য ছিল না।
এমন প্রশ্নও বাতাসে ভেসে বেড়িয়েছে- আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দায়িত্বরত শিক্ষকরা কি প্রয়োজনীয় যোগ্যতাসম্পন্ন নন? প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নন? পাঠদানে যথেষ্ট আন্তরিক নন? নতুন খসড়ার ২৪নং ধারার ১নং উপধারায় বলা হয়েছে- এ আইন জারির পর সব ধরনের কোচিং নিষিদ্ধ হবে। যে কোনো ধরনের কোচিং সেন্টার পরিচালনা, কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা শাস্তিযোগ্য হবে। ২নং উপধারায় বলা হয়েছে- শিক্ষক কোনো শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না। ৩ নম্বরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের লিখিত সম্মতি নিয়ে অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করার সুযোগ রাখা হয়েছে। তবে উল্লেখ করা আছে, সরকারের অনুমোদন ছাড়া কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান টিউশনসহ অন্যান্য ফি আরোপ করতে পারবে না।
১ নম্বর উপধারা লঙ্ঘনে অনধিক ২ লাখ টাকা অর্থদÐ বা ৬ মাসের কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে। ২ নম্বর উপধারা লঙ্ঘন করলে সরকারি শিক্ষকদের বিরুদ্ধে চাকরিবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। বেসরকারি শিক্ষকদের ক্ষেত্রে নিবন্ধন ও এমপিও বাতিল এবং চাকরিচ্যুত করা হবে। আমরা ধরে নিতে পারি, এ আইনের মাধ্যমে শিক্ষাক্ষেত্রে একটা শুদ্ধি অভিযান পরিচালিত হওয়ার বাধ্যবাধকতা এসে যাচ্ছে। তবে প্রশ্ন থেকে যায়- যথাযথ কর্তৃপক্ষ কি সেই শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করতে সক্ষম হবে?
কোনো ধরনের নোট বা গাইড বই মুদ্রণ, বাঁধাই, প্রকাশ ও বাজারজাত করা দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হবে। বর্তমানেও নোট ও গাইড বই প্রকাশ, প্রচার ও বেচাবিক্রির কোথাও কোনো অনুমোদন নেই, আইনগত স্বীকৃতি নেই; কিন্তু নোট ও গাইড বইয়ে বাজার সয়লাব। আইনের বাধ্যবাধকতা পরিস্থিতি কতটুকু বদলাতে পারবে, আমরা সেটা দেখার অপেক্ষায় আছি। নোট বই, গাইড বই ক্রয় বা পাঠে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা শিক্ষক শিক্ষার্থীদের বাধ্য করলে বা উৎসাহ দিলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক বা প্রতিষ্ঠানপ্রধান বা ব্যবস্থাপনা কমিটির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ বিধান লঙ্ঘনে অনধিক ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা ১ বছর কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে।
শিক্ষা আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনো এলাকায় কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার প্রয়োজনীয়তা নেই বলে সরকারের কাছে প্রতীয়মান হলে তা পাশের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একীভূত, অন্যত্র স্থাপন বা বিলুপ্ত করতে পারবে। এর আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করে কয়েক বছর পরিচালনার পর সক্ষমতা প্রমাণিত হলে সরকারের স্বীকৃতি মিলত। কিন্তু প্রস্তাবিত আইনে সরকারের পূর্ব অনুমোদন ছাড়া দেশি-বিদেশি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা যাবে না।
এছাড়াও নিবন্ধিত সংস্থা, ট্রাস্ট পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আর্থিক বিষয় পৃথক ব্যাংক হিসাবে চলবে। কোনো অবস্থায়ই এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের অর্থ ট্রাস্ট বা সংস্থার হিসাবে যাবে না। এতে স্থানান্তরিত অর্থ উদ্ধার এবং বিধান লঙ্ঘনের জন্য দায়ীদের অনধিক ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা ১ বছর কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে। কিন্তু বর্তমানে ফাউন্ডেশনের অধীনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের আধিক্য দেখা যায়। অবকাঠামোগত বিষয়টাকে আমলে না নিয়েও এসব প্রতিষ্ঠান দাপটের সঙ্গে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এ ধরনের বিষয় আইনে স্পষ্ট করা হয়নি।
পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনে পরীক্ষার্থীকে সহায়তা করা বা প্রশ্নফাঁসের সংশ্লিষ্টতা দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হবে। এ বিধান লঙ্ঘনে অনধিক ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা ৬ মাসের কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে। প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা বাধ্যতামূলক এবং এটা শিশুর অধিকার। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুরা মাতৃভাষায় পড়ালেখা করবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে নিজ নিজ ধর্ম, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাঙালি সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নিজ নিজ সংস্কৃতির বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
মাধ্যমিক শিক্ষার স্তর সরকার নির্ধারণ করবে। এ স্তরে সাধারণ, মাদরাসা এবং কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ধারা থাকবে। সব ধারায় বাংলা, ইংরেজি, বাংলাদেশ স্টাডিজ, গণিত ও আইসিটি বাধ্যতামূলক। বাংলা মাধ্যম ও ইংরেজি ভার্সনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের টিউশনসহ অন্যান্য ফি সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বোর্ড অনুমোদন দেবে। এছাড়া কোনো ফি নেয়া যাবে না। ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ফি সরকার প্রণীত আইন বা বিধি দ্বারা নির্ধারিত হবে। এ বিধান লঙ্ঘন করলে প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন বা পাঠদানের অনুমতি বাতিল হবে। দায়ীদের অনধিক ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা ১ বছর কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে।
উচ্চশিক্ষা স্তরের সব ধরনের প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের বেতন ও ফি সরকার বা সরকারের নির্ধারিত কর্তৃপক্ষের থেকে অনুমোদন করে নির্ধারণ করতে হবে। সব শিক্ষার্থী অভিন্ন গ্রেডিং ব্যবস্থায় মূল্যায়িত হবে। শিক্ষক, কর্মচারী ও কর্মকর্তার নিয়োগবিধি থাকবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিজস্ব সব আয় অনুদান প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে জমা হবে। সরকার নির্ধারিত আর্থিক নীতিমালা অনুযায়ী ব্যয় করতে হবে। এ বিধান লঙ্ঘনে অনধিক ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা এক বছর কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডেে দণ্ডিত করা যাবে।
বিদেশি কারিকুলামের আওতায় পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠ্যক্রমে সাধারণ ধারার সমপর্যায়ের বাংলা, বাংলাদেশের অভ্যুদয়, বাংলাদেশ স্টাডিজ ও সরকার নির্ধারিত বিষয়গুলো বাধ্যতামূলকভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তা না হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন বাতিল হবে। এ বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক ২ লাখ টাকা অর্থদÐ বা ৬ মাসের কারাদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড ভোগ করতে হবে। আগের খসড়া থেকে এতে অর্থদণ্ড ১ লাখ টাকা কমানো হয়েছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীকে কোনো ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা যাবে না। করা হলে শিক্ষকের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ অভিযোগ প্রমাণিত হলে এমপিও বাতিল ও চাকরিচ্যুত করা যাবে। সরকার কওমি মাদরাসার মানোন্নয়নে প্রয়োজনীয় নীতিমালা বা বিধিমালা তৈরি করবে বলে খসড়ায় উল্লেখ আছে। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি।
শিক্ষা আইন এখনও জনসমক্ষে আসেনি; কিন্তু সংবাদ মাধ্যমের কল্যাণে শিক্ষা আইন সম্পর্কে কিছু কিছু জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমরা জানতে পেরেছি। যেমন- নোট ও গাইড বই নিষিদ্ধ হবে, অপ্রয়োজনীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হবে, প্রশ্নফাঁস রোধ হবে। আমাদের প্রশ্ন- উপরি-উক্ত বিষয়গুলো সত্যি সত্যি বাস্তবায়িত হবে তো? কারণ আইন বাস্তবায়নের দাযিত্ব যাদের ওপর ন্যস্ত, তারা কতটুকু দক্ষতার সঙ্গে ক্ষেত্রবিশেষে আইন প্রয়োগ করতে পারে, সেটাই দেখার বিষয়। আইন শুধু নথিবদ্ধ থাকলে আইনের সুফল পাওয়া যায় না, বাংলাদেশে যেমনটা বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে ঘটছে।
শিক্ষা বিষয়ে আমাদের চাওয়া একটাই। সেটা হচ্ছে মানসম্মত শিক্ষা। শিক্ষা আইন বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে আমরা তা পাব তো, সেটাই আমাদের জিজ্ঞাসা। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন- শিক্ষা আইনের খসড়া আইনে পরিণত হওয়ার পর যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হবে কিনা? নিদেনপক্ষে শ্রেণিকক্ষে মানসম্পন্ন পাঠদান নিশ্চিত করা যাবে কিনা? এরই মধ্যে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের মাধ্যমে সৃজনশীল পড়ালেখা করানোর উদ্যোগ নেয় সরকার; কিন্তু শিক্ষকদের আগ্রহের অভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে ডিজিটাল পদ্ধতির এ পাঠদান কার্যক্রম। এ প্রসঙ্গে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. শামসুল হুদা বলেন, ‘ডিজিটাল পদ্ধতিতে পাঠদানের এ ধারণা আমাদের দেশে নতুন। শিক্ষকদের অনেকেই নানা কারণে এর সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেনি। তবে আমরা মনিটরিং চালিয়ে যাচ্ছি। কিছু সমস্যা আছে, আমরা তা চিহ্নিত করেছি। এর মধ্যে দ্রুত সমাধানযোগ্য সমস্যা অল্প কিছুদিনের মধ্যে সমাধান করা হবে। অবকাঠামোগত সমস্যা ২০১৮ সালের মধ্যে সমাধানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।’ (১২.০৯.১৭ যুগান্তর)। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মনিটরিংয়ে বেরিয়ে আসা উল্লেখযোগ্য সমস্যাগুলো হচ্ছে কনটেন্ট তৈরিতে শিক্ষকদের অনাগ্রহ, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরে শিক্ষকদের পাঠদানে আগ্রহের ঘাটতি, আইসিটি সামগ্রী পরিচালনায় অদক্ষতা। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান বলেছে, ল্যাপটপ ও মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের সংখ্যা অপ্রতুল। আইসিটি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক অপ্রতুল। উপজেলা পর্যায়ে ইন্টারনেট সমস্যা- বিশেষ করে ধীরগতি, লোডশেডিং, ভৌত অবকাঠামোগত ও ক্লাসরুম সংকটের কথাও বলেছে কিছু প্রতিষ্ঠান। আবার অনেকে বলেছে, কনটেন্ট তৈরি ও মাল্টিমিডিয়ার ওপর দেয়া প্রশিক্ষণের মেয়াদ পর্যাপ্ত ছিল না। সুতরাং কর্মসূচি ঘোষণা বা আইন প্রণয়ন করলেই কার্যক্রম মানসম্পন্ন হয় না, কর্মসূচি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হয়।
শিক্ষার মান নিশ্চিতকরণ প্রসঙ্গে সাংবাদিক সোহরাব হাসান শিক্ষাবিদ ও লেখক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের জবানিতে লিখেছেন, তাদের বিভাগে যেসব ছাত্রছাত্রী ভর্তি হয়, তাদের ৮০ শতাংশ ন্যূনতম ইংরেজি জানে না। এর কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, মাধ্যমিক ও উচ্চমধ্যমিক পর্যায়ে সৃজনশীল প্রশ্ন এবং পাঠপদ্ধতির নামে যা হচ্ছে, তা প্রহসন ছাড়া কিছু নয়। যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আমিরুল আলম খানের জবানিতে বলেন, ‘এ শিক্ষা শিক্ষাও নয়, সৃজনশীলও নয়।’ (১৬.৯.১৭ প্রথম আলো)। আমাদের আশঙ্কা, এক শিক্ষা আইন দিয়ে কি আমরা শিক্ষাজগতে মানসম্মত শিক্ষার হাওয়া বইয়ে দিতে পারব? অথবা আমাদের কাক্সিক্ষত শিক্ষা আইন কি শিক্ষার এ দুর্গতি ঠেকাতে পারবে? মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণে শিক্ষা আইনের পথচলা সুগম হোক। (লেখাটি সংগৃহীত)