শিক্ষার্থী বনাম পরীক্ষার্থী

46

অধ্যাপক আয়েশা পারভীন চৌধুরী

আমাদের বর্তমান পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা ও সমালোচনা প্রায় সময় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়। এক এক সময় এক একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। বিভিন্ন মাধ্যমে কখনো কখনো শুনা যায়, তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত আবার কখনো কখনো কখনো শুনা যায় অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পরীক্ষা নেওয়া হবে না। যারা আমাদের দেশের শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছেন তারা প্রয়োজনীয়তা, বাস্তবতা ও প্রয়োগ পদ্ধতি নিয়ে অনেক ধরনের পরিবর্তন করেছেন ও এখনো করে চলছেন। ভবিষ্যতেও করবেন। কিন্তু বাস্তবে তাদের পরিবর্তনগুলো আদৌ কার্যকর হয় কিনা তা বিবেচনাধীন। আমাদের দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থী নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। তাই এই ধরণের পরিবর্তনগুলো বার বার শিক্ষা ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করে। একদিকে শিক্ষার্থী নতুন নিয়মে নিজেকে প্রস্তুত করতে হিমসিম খায় অন্যদিকে শিকক্ষরাও নতুন নতুন পদ্ধতিতে শিক্ষাদানে অভ্যস্ত না হওয়াতে পুরো শিক্ষাব্যবস্থা বাধা প্রাপ্ত হয়। সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত কোন পরীক্ষা না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে । প্রতিটি পরীক্ষা পদ্ধতির সাথে অভিভাবক, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকবৃন্দ জড়িত। ভাল রেজাল্টের আশায় শুধুমাত্র পুঁথিগত শিক্ষায় শিক্ষার্থীরা নিজেদেরকে তৈরী করতে থাকে। তাই খুটিনাটি অনেক তথ্য জানে না। জানতে চায় না। সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিম্ন আয়ের পরিবারের সন্তানদের অবৈতনিক শিক্ষার পাশাপাশি টিফিন ও উপবৃত্তি ইত্যাদি চালু করেছেন। তিনি কিছুটা আবেগ তারিত কন্ঠে আক্ষেপ করে বলেন, ‘শিশুদের পড়ার জন্য দরকার আন্তরিকতা, অতিরিক্ত চাপ দেবেন না’। তাহলেই দেখবেন তারা একটা আনন্দ শক্তি পাবে। তাদের শিক্ষার ভিতটা শক্তভাবে তৈরী হবে।
¯েœহ-মায়া-মমতায় ঘেরা পারিবারিক পরিবেশ শিশু শিক্ষার পথকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যায়। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য মাত্রা (এস. ডি. জি) অর্জনে অধিকার বঞ্চিতও পশ্চাদমুখী শিশু-কিশোরদের শিক্ষায় প্রবেশ-গম্যতা, শিক্ষা বিষয়ক সামগ্রী অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা, সর্বোপরি সকলের জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত কল্পে সরকারের পাশাপাশি সকল শ্রেণী পেশার মানুষকে এগিয়ে আনতে হবে। অবৈতনিক শিক্ষা চালু হলেও সামগ্রিক অর্থে শিক্ষার উন্নয়ন হচ্ছেনা।
বিশ^ব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত‘ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট ২০১৮ এরলার্নিং টুরিয়েলাইজ এডুকেশন প্রমিজ’ এ বেরিয়ে এসেছে প্রাক্ প্রাথমিক থেকে শুরু করে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ১১ বছরের স্কুল জীবনের মধ্যে সাড়ে চার (৪) বছর সময় নষ্ট হচ্ছে দুর্বল শিক্ষা পদ্ধতির কারণে। আমাদের দুর্বল শিক্ষা পদ্ধতির মধ্যে বড় ব্যাপার হচ্ছে শিক্ষার্থী, শিক্ষক-অভিভাবক, স্কুল পরিচালনা কমিটির মধ্যে সুসম্পর্ক ও সমন্বয়ের অভাব। কাঠামোগত দুর্বলতা অনেকাংশে দায়ি। স্কুল ঘর, শিক্ষকের সংখ্যা মানসম্মত বিষয় ভিত্তিক শিক্ষক, পড়াশোনার পরিবেশ, সুন্দর শ্রেণিকক্ষ, শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের সমস্যা, নিশ্চিত পারিবারিক পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়গুলোর উপর গুরুত্ব দিয়ে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে সাজাতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রকাশিত ‘ন্যাশনাল স্টুডেন্ট অ্যাসেসমেন্ট ২০১৫’ এ দেখা গেছে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পঁয়ত্রিশ (৩৫) শতাংশ বাংলায় এবং পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পঁচিশ (২৫) শতাংশ গণিতে কাঙ্খিত যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। ইংরেজি ও অংক বিষয়ের শিক্ষার্থীদেরকে শিক্ষার্থীর দুর্বলতা ও মানসিকতা বুঝে পাঠদান করাতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষক প্রশিক্ষণ বড় ব্যাপার। আমাদের দেশের অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী-শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার অভাবে তাদের মেধাকে কাজে লাগাতে পারছে না। বর্তমানে মাল্টি-মিডিয়ায় শিক্ষাদানের উপর জোড় দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে সহায়ক পরিবেশের অভাবে কম্পিউটারগুলো ল্যাবেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি পঞ্চম শ্রেণীর (৫ম) পরীক্ষা বাতিলের পর আবার অষ্টম শ্রেণীর (৮ম) পরীক্ষা বাতিলের বিষয় বিবেচনায় আনা হয়। অষ্টম শ্রেণীর পরীক্ষা বাতিল কতটুকু যৌক্তিক তা বিবেচ্য বিষয়। কারণ অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা অনেকটা মানসিকভাবে প্রস্তুত। এক ধরণের অনিশ্চিত ও তড়িৎ গতির সিদ্ধান্তগুলো শিক্ষা ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই ভেবে দেখতে হবে। বিভিন্ন বোর্ড পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায়, যারা পরীক্ষায় ভাল করছে তাদের অধিকাংশ মধ্যবিত্ত পরিবারে রসন্তান। শিক্ষিত অভিভাবকের পাশাপাশি গৃহ শিক্ষক ও কোচিং সেন্টারে গিয়ে এরা পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে। এখানে ‘অর্থ’ একটি বড় ব্যাপার। মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন শিক্ষার্থীর পিছনে অনেক টাকা বিনিয়োগ করাহয়। কিন্তু নিম্ন আয়ের অভিভাবকদের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। আর উচ্চবিত্ত পরিবার তাদের সন্তানদেরকে উচ্চ-শিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠাচ্ছে। মূলকথা, মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো তাদের নানান ঘাত-প্রতিঘাতেও সন্তানদেরকে শিক্ষিত করে তুলছে। আর সেই সন্তানরাই এক সময় সমাজ ও রাষ্ট্রের চালিকা শক্তিতে নিজেকে নিয়োজিত করছে। সেই যে পরীক্ষা থেকে পরীক্ষা যুদ্ধ শুরু হয় তার কোন শেষ নেই। এভাবে বর্তমানে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে শিক্ষার্থী বলবনা পরীক্ষার্থী বলব।
প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার বৃদ্ধি ও ঝড়ে পড়া রোধ করতে সারা বছর পুষ্টি সম্পন্ন খাবার দিতে সম্প্রতি জাতীয় স্কুল মিলনীতি ২০১৯’ এর খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়। সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের স্কুল ড্রেসের জন্যও ২০০০ টাকা প্রদানের ঘোষনা দিয়েছেন।
প্রতিদিন ক্লাস টেস্ট, সাপ্তাহিক পরীক্ষা, পাক্ষিক পরীক্ষা, মাসিক পরীক্ষা, সাময়িক পরীক্ষা ও বার্ষিক পরীক্ষার চাপে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার্থীতে পরিণত হয়েছে। পরিক্ষা নির্ভর শিক্ষা পদ্ধতির উপর বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা নির্ভরশীল। স্কুলের মান ও শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকায়ন যেন বিভিন্ন ধরণের পদ্ধতির উপর নির্ভরশীল। ভর্তি পরীক্ষার যুদ্ধ যেন জীবন যুদ্ধে পরিণত হয়। সেই যে পরীক্ষা থেকে পরীক্ষা যুদ্ধ শুরু হয় তার কোন শেষ নেই। এভাবে বর্তমানে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে শিক্ষার্থী বলব না পরীক্ষার্থী বলব। পরবর্তী মাধ্যমিকের পরে উচ্চ শিক্ষার আশায় বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারীং এবং অন্যান্য বিশ^বিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে ভর্তি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা-জীবনের উচ্চ ধাপ অতিক্রম করে। মূল্যায়নের জন্য অবশ্যই পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। তবে পরীক্ষা যেন শিক্ষার্থীর মেধা বিকাশের অন্তরায় না হয়। শুধুমাত্র পুঁথিগত পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্র্থীর মূল্যায়ন না করে বরং তাদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত প্রতিভা বিকাশেও কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।

লেখক: কলামিস্ট ও অধ্যাপক, ইংরেজী বিভাগ
ডা. ফজলুল-হাজেরা ডিগ্রী কলেজ, হালিশহর, চট্টগ্রাম।