শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে অবৈধ বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে

42

চট্টগ্রামের সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। গতকাল চট্টগ্রাম কলেজ অডিটোরিয়ামে ‘শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে করণীয়’-শীর্ষক মতবিনিময় সভায় তিনি এ আশ্বাস দেন। সভায় বিশেষ অতিথি ছিলেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল।
সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মকর্তারা মতবিনিময়ে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিতে বিভিন্ন সংকটের কথা তুলে ধরেন। এসব সংকটের মধ্যে রয়েছে বিজ্ঞানাগারের অপর্যাপ্ত ধারণক্ষমতা, লাইব্রেরিয়ানের পদ শূন্য, শিক্ষার্থীর অনুপাতে আইসিটি শিক্ষকের সংকট, ২০১৮ জনবল কাঠামো অনুযায়ী শিক্ষক নিয়োগ, আলিম ও ফাযিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষের বেতনের সমতা দূর করা, কারিগরি শিক্ষকের সংকট, অনার্স বিষয় খোলার ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের রাশ টেনে ধরা, মানসম্মত পরিদর্শন নিশ্চিতকরণ, উপজেলা ও জেলা শিক্ষা অফিসারের পদোন্নতির ব্যবস্থা, উপজেলা ও গ্রাম পর্যায়ের শিক্ষক সমস্যার সমাধান, খেলার উপযোগী অবকাঠামো তৈরি করা, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসকে শক্তিশালী করা, জেলা পর্যায়ে বিকেএসপির প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কোচ নিয়োগ করা, শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়নে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ও বিভিন্ন জেলা শহরে উন্নয়ন ফিতে বৈষম্য দূরীকরণ। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ের উদ্যোগে সভায় নগরের ১৮৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান, আশপাশের ৫টি উপজেলার ১৫০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান, চট্টগ্রাম শিক্ষা অঞ্চলের ৭ জেলার শিক্ষা কর্মকর্তা, ৬৭ উপজেলার শিক্ষা কর্মকর্তা এবং চট্টগ্রাম কলেজের প্রায় দেড়শ শিক্ষকসহ ৫৪৪ জন শিক্ষক-কর্মকর্তা অংশ নেন।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম ফারুকের সভাপতিত্বে সভায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব সোহরাব হোসাইন, করিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আলমগীর বক্তব্য রাখেন। এছাড়া চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর শাহেদা ইসলাম, মাউশির চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক প্রদীপ চক্রবর্তী ও চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যক্ষ আবুল হাসান শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন।
মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথি শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, আমি শিক্ষক পরিবারের সন্তান। আমার মা দীর্ঘ চার দশক শিক্ষকতা করেছেন। এ কারণে শিক্ষকদের প্রতি আমার অন্যরকম আবেগ কাজ করে। আপনাদের সাথে আমাদের শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিতকরণে করণীয় বিষয়ে কথা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে শিক্ষার সঠিক পরিবেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে হলে প্রথমত আমাদের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। যেটা শুধুমাত্র শিক্ষকরাই করতে পারেন। অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও গত এক দশকে আমাদের অনেক বড় বড় অর্জন রয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্র নিয়ে চিন্তার কোনো শেষ নেই। শেখ হাসিনার সরকার প্রথমেই নিশ্চিত করেছে সব শিশুদের শিক্ষামুখীকরণ। সেটা পেরেছি বলেই সারাবিশ্বে বাংলাদেশ প্রশংসিত হয়েছে।।
প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, গত বছর কোনো প্রশ্নপত্র ফাঁস ছাড়া সারাদেশে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এবারও প্রশ্নপত্র ফাঁস ও অসাধু পন্থা অবলম্বন ছাড়া পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। তার জন্য শিক্ষক-কর্মকর্তাদের আন্তরিক সহযোগিতার আহŸান জানান শিক্ষামন্ত্রী। তিনি আরও বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে কোন কোন পক্ষ জড়িত সে বিষয়ে ভাবতে গেলে একটু লজ্জাই পেতে হয়। পরীক্ষার আগের দিন পরীক্ষার্থীদের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা, অভিভাবকদেরও তাই। সন্তানের কোনো সমস্যা আছে কি না, স্বাস্থ্য ঠিক আছে কি না- এসব বিষয়ে চিন্তিত থাকার কথা অভিভাবকের। কিন্তু আমরা দেখছি, শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার আগের দিন খুঁজছে কোথাও প্রশ্ন পাওয়া যাচ্ছে কি না? এমনকি অভিভাবকরা টাকা-পয়সা নিয়ে এদিক ওদিক ছুটাছুটিও করেন। আবার কিছু শিক্ষক থাকেন প্রশ্ন ফাঁস করার জন্য। এর চেয়ে লজ্জাজনক, দুঃখজনক তো আর কিছু হতে পারে না। সুতারাং প্রশ্নপ্রত্র ফাঁস বন্ধ করার জন্য আমাদের সকলের কাজ করতে হবে। পরীক্ষার্থী, অভিভাবক-শিক্ষক সকলকেই আন্তরিক ও সততার সাথে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে।
তিনি বলেন, আপনাদের কাছ থেকে অনেক মতামত এসেছে, সংকটের কথা এসেছে। আমরা সবগুলো বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করবো। শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে যা যা করণীয় সব করার চেষ্টা করবো। তবে আপনাদেরও কিছু দিতে হবে। শিক্ষা নিয়ে যেখানে বাণিজ্য আছে, অনৈতিকতা আছে সেগুলো বন্ধ হতে হবে। বিশেষ করে যেখানে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের বাধ্য করে প্রাইভেট পড়তে। কখনো কখনো শিক্ষার্থীদের ফেল করিয়ে দেন, এটা নতুন কিছু নয়। এ ধরনের অনৈতিক বিষয় অবশ্যই বন্ধ হতে হবে। সরকারের যত নীতিমালা আছে সেগুলো অবশ্যই মেনে চলতে হবে। কেননা নীতিমালা না মেনে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করা সম্ভব না।
সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্যে শিক্ষা প্রশাসনে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার কথা জানালেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। তিনি বলেন, শিক্ষা প্রশাসনে দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। সরকার সব সময় দুর্নীতির বিষয়ে জিরো টলারেন্স। শিক্ষা প্রশাসনে কোনো ধরনের দুর্নীতি সহ্য করা হবে না। আমাদের কাছে অভিযোগ আসছে, শ্রেণিকক্ষে পাঠদান না করিয়ে শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে আলাদাভাবে অর্থের বিনিময়ে পাঠদানে বাধ্য করা হয়। এটা সম্পূর্ণ অনৈতিক এবং অপরাধ। এছাড়াও যেসব বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকার নির্ধারিত নিয়ম না মেনে অতিক্তি ফি আদায় করছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোচিং বাণিজ্য রোধে যতটুকু কঠোর হওয়া দরকার ততটুকু হবো। অনিয়ম, দুর্নীতি ও অনৈতিক কাজ করে কেউ ছাড় পাবেন না। এমনকি আমরাও নয়। জাতির জনকের কন্যা আমাদেরও ছাড় দিবেন না। সুতরাং যেদেশে মন্ত্রীর ছাড় নেই সে দেশে শিক্ষা কর্মকর্তাদেরও কোনো ছাড় নেই।