শিক্ষার্থীদের জন্য নববর্ষের শ্রেষ্ঠ উপহার বই উৎসব

403

ইংরেজি বছরের প্রথম দিন দেশজুড়ে ‘পাঠ্যপুস্তক উৎসব দিবস’ উদ্যাপন করছে সরকার। বছরের শুরুর দিনে প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের হাতে বিনা মূল্যের পাঠ্যবই তুলে দেওয়ার এই কর্মসূচির নাম দেওয়া হয়েছে বই উৎসব দিবস। এই দিবসটি ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের মাঝে বই উৎসব নামে দিন দিন ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করছে কেননা নতুন শ্রেণীতে নতুন বই পাওয়ার আনন্দই অন্যরকম। আর সে বই যদি বিনামূল্যে পাওয়া যায় তাহলে তো কথাই নেই। এর মধ্যে এক ধরনের সার্বজনীনতাও রয়েছে। কেননা দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের অনেকেরই নতুন বই কেনার সামর্থ্য থাকে না। তারা আগে পুরনো বই দিয়েই বছর পার করত। এখন সবার হাতেই নতুন বই। তাই উৎসবমুখর পরিবেশে সর্বস্তরের শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীরা বছরের প্রথমদিনে পাঠ্যপুস্তক উৎসবে শামিল হয়েছে। সরকারি উদ্যোগে নানা আয়োজনে জেলা-উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বছরে নতুন বই তুলে দেয়া হয়েছে। নতুন বই হাতে পেয়ে শিক্ষার্থীরা বাঁধভাঙা উচ্ছ¡াসে মেতে ওঠে। প্রতিটি স্কুলেই বিরাজ করে উৎসবের আমেজ। কোন কোন বিদ্যালয়ে ফুলের মোড়কে বইগুলো সাজিয়ে ছোট ছোট সোনামনিদের হাতে তুলে দেওয়া হয় নতুন বই। বই পেয়ে মহা খুশি বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা নতুন বই বুকে চেপে উচ্ছাসিত শিশুরা বাড়ি ফেরে। ২০১০ সাল থেকে বর্তমান সরকার বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করছে। বছরের প্রথম দিন দেশের কোটি কোটি শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে বই বিতরণ শেখ হাসিনা সরকারের বড় কৃতিত্ব। এই বই উৎসব বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রাথমিক গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি উদ্যোগ। এ উৎসব পালনে প্রতিবছর ১ জানুয়ারি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হয়। এটি পাঠ্যপুস্তক উৎসব বা পাঠ্যপুস্তক উৎসব দিবস নামেও পরিচিত। শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকের সংকট কমাতে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ সরকার বিনামূল্যে বই বিতরণের সিদ্ধান্ত নেয়। ওই বছর সরকার ২৯৬ কোটি ৭ লাখার টাকার পাঠ্যপুস্তক প্রদানের উদ্যোগ নেয় এবং ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি এটি প্রথম উদ্বোধন করেন। একদিনে বিশাল সংখ্যক বই সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম। মঙ্গলবার (৩১ ডিসেম্বর) গণভবনে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিয়ে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ কর্মসূচির উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এবারও ২০২০ শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ৪ কোটি ২৬ লাখ ১৯ হাজার ৮৬৫ জন শিক্ষার্থীর জন্য ৩৫ কোটি ৩১ লাখ ৪৪ হাজার ৫৫৪ টি বই ছাপানো হয়েছে। এরমধ্যে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য ১০ কোটি ৫৪ লাখ ২ হাজার ৩৭৫ ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য ২৪ কোটি ৭৭ লাখ ৪২ হাজার ১৭৯টি বই বিনা মূল্যে বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মাঝে ২৮,৭৩৫ টি আমার বই ও ২৮,৭৩৫টি অনুশীলন খাতা এবং ১ম শ্রেণির ৭৪,৮৪৭টি, ২য় শ্রেণির ৭৩,৬৩৫টি, ৩য় শ্রেণির ২৪,১৫১টি পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করার কথা রয়েছে। তাছাড়াও আপৎকালীন জরুরি প্রয়োজনে উপজেলা-থানা পর্যায়ে বাফার স্টকে ২ শতাংশ বই বরাদ্দ রাখা আছে এবং মাধ্যমিক স্তরে ও মাদ্রাসার দাখিল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ছাপানো হয়েছে ২৪ কোটি ৭৭ লাখ ৪২ হাজার ১৭৯টি বই। ইবতেদায়ি (মাদরাসার প্রাথমিক) স্তরের জন্য ছাপানো হয়েছে ২ কোটি ৩২ লাখ ৪৩ হাজার ৩৫টি বই। এসএসসি ভোকেশনালের জন্য ১৬ লাখ ৩ হাজার ৪১১টি বই। এসসি বিএম ভোকেশনালের জন্য ২৭ লাখ ৬ হাজার ২৮টি বই এবং দাখিল ভোকেশনালের জন্য ছাপানো হয়েছে এক লাখ ৬৭ হাজার ৯৬৫টি বই। বছরের প্রথম দিন নতুন বই হাতে পেয়ে নতুন স্বপ্নের হাতছানিতে এগিয়ে যায় আমাদের দেশে ছেলেমেয়েরা। এত শিশুর হাতে একসঙ্গে বই তুলে দেওয়া নিঃসন্দেহে এক মহাযজ্ঞ। সরকারের পক্ষ থেকে এটিকে ‘বই উৎসব’ বলা হয়। আর এই অভিধাকে অত্যুক্তি বলারও অবকাশ নেই। তবে সরকারি বিনামূল্যের এই বই ছাপা নিয়ে নানা সময়ের প্রশ্ন উঠেছে। বই বিতরণের সময় অতীতে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার বিষয়টিও আলোচিত হয়েছে। এবারও যথা সময়ে বই ছাপা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছিল, গণমাধ্যমে এসেছিল এমন খবর। এরপরও সংশ্লিষ্টদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় সব বাধা কাটিয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছে যাওয়া নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার কারণে এত বড় মহাযজ্ঞের সাফল্য যাতে কলঙ্কিত না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্টদের কর্তব্য হওয়ার আগে থেকেই কার্যকর উদ্যোগ নিশ্চিত করা এই কঠিন দায়িত্ব পালন। অস্বীকারের সুযোগ নেই যে, বছরের প্রথম দিন নতুন বইপ্রাপ্তির মধ্য দিয়ে দেশের ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের আনন্দের ঝিলিক চোখে পড়ে। নতুন বই হাতে পাওয়ার আনন্দই আলাদা। ২০১৭ সাল থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ব্রেইল বই, পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের জন্য তাদের নিজেদের ভাষায় লেখা প্রাক-প্রাথমিকের বই ও শিক্ষা উপকরণ এবং শিক্ষকদের শিক্ষক নির্দেশিকা বিতরণ শুরু হয়। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। মূলত প্রতি বছর বই বিতরণ ঘিরে যে উৎসব তা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক বাড়তি আনন্দ যোগ করে। তবে বিচ্ছিন্নভাবে বিনামূল্যের বই কালোবাজারে বিক্রির ঘটনা প্রতি বছরই সামনে আসে। আমরা মনে করি, এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নজরদারি বাড়াতে হবে। এটা সত্য, গত ১১ বছরে শিক্ষা ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সফলতা এসেছে আমাদের। দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে। শিক্ষা যে দারিদ্র্যমুক্তির একটি প্রধান দিক তাও প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেশে। দেশের শিক্ষা খাতে এটি সরকারের একটি অন্যতম সাফল্য। বিনামূল্যের বই বিতরণ শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধেও সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা, এই মহৎ উদ্যোগের পূর্ণাঙ্গ সফলতার জন্য শিক্ষা এবং শিক্ষা উপকরণের মানের দিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। দেশে শিক্ষা বিকাশে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। শিক্ষার্থীদের হাতে শিক্ষা উপকরণ পৌঁছে দেয়ার পাশাপাশি শিক্ষার মানোন্নয়নে গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষা হতে হবে যুগোপযোগী, আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত। এ ছাড়াও নৈতিকতাবোধসম্পন্ন শিক্ষার্থী তৈরির দিকেও সমান গুরুত্ব দেয়া সমীচীন। বিনামূল্যের বই বিশেষত গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র অভিভাবকদের জন্য এক বড় ধরনের স্বস্তি। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ সহায়তায় তাদের আর্থিক কষ্টের বোঝা অনেকটাই লাঘব হবে নিঃসন্দেহে। আমাদের বিশ্বাস, শুধু বিনামূল্যের বই নয়, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আরও অনেক কিছু করার আছে। শিক্ষার্থীদের ঝরেপড়াসহ প্রাথমিক শিক্ষার অন্য সমস্যাগুলোর যদি প্রতিকার করা যায়, তাহলে এ দেশের নতুন প্রজন্মের শিক্ষার ভিতটি শক্তভাবে গড়ে উঠতে পারবে, যা একটি জাতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শি নেতৃত্বের মাধ্যমে এই দেশের শিক্ষার মান আরো এগিয়ে যাবে আর বছর বছর নতুন বই পাওয়ার আনন্দে মাতোয়ারা হবেন ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা। এই ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের কাছে নববর্ষের শ্রেষ্ঠ উপহার হোক নতুন বই প্রাপ্তি ও বই উৎসব। এই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : প্রাবন্ধিক