শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবনতা রোধে করণীয়

13

নাসের রহমান

নিজেকে ভালবাসে না এমন লোক নেই। মানুষ নিজেকে ভালবাসে বলে অন্যকে ভালবাসতে পারে। এ ভালবাসা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, পথ চলায়, স্বপ্ন দেখায়। স্বপ্ন ছাড়া কোন মানুষ বাঁচতে পারে না। একজন কিশোর যে স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যায় একজন পরিনত বয়সের মানুষ একই রকম স্বপ্ন দেখে না, অন্যরকম স্বপ্ন নিয়ে পথ চলে। বয়স্করাও স্বপ্ন দেখতে ভালবাসে। বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে। কষ্টদায়ক হলেও বেঁচে থাকতে চায়। দীর্ঘ দিন অসুস্থ থাকলে কিংবা চরম অশান্তিতে পড়লেও বাঁচতে চায়। মুখে কখনো মৃত্যুর কথা বললেও মনে প্রাণে বেঁচে থাকতে চায়। সবাই জানে একদিন না একদিন মরতে হবে। মৃত্যুর স্বাদ সবাইকে গ্রহণ করতে হবে। তারপরও সহজে কেউ মরতে চায় না। আরো কিছু দিন বেঁচে থাকতে চায়। বছরের পর বছর বেঁচে থাকার আশা কেউ ছাড়তে চায় না। মানুষ প্রবল ¯্রােতে পড়েও কুলকিনারার আশা করে, আবার গভীর সমুদ্র তলিয়ে গিয়েও খড়কুটা ধরে বেঁচে থাকতে চায়। মরতে মরতেও বেঁচে থাকার আশা ছাড়তে পারে না। এটাই মানুষের ধর্ম, মানুষের স্বভাব।
এর ব্যতিক্রম যে একেবারে নেই তা নয়। আত্মহননের ঘটনা প্রায় সবদেশে ঘটে। কম বেশি সবখানে এ প্রবনতা দেখা যায়। মানুষ যখন আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, হতাশায় ডুবে যায় এবং ঘুরে দাঁড়ানোর কথা ভাবতে পারে না তখন এ পথটা বেছে নেয়। আসলে এটা কোন পথ নয়। যে পথ জীবনকে নি:শেষ করে দেয় তা কোন পথ হতে পারে না। পথ বা ওয়েতে কেউ থেমে থাকেনা, এগিয়েই চলে। যে কোন ধরনের মৃত্যুতে একজনের গতিপথ রুদ্ধ হয়ে যায়, চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সবকিছু শেষ হয়ে যায়। এটা এমন ভয়াবহ ব্যাপার যেখানে কোন আলো থাকে না, সবকিছু অন্ধকারে ডুবে যায়। আর কখনো আলোতে ফিরে আসতে পারে না। যে একবার প্রবেশ করে সে চিরতরে হারিয়ে যায়। কেউ ভেবে চিন্তে এখানে প্রবেশ করে না। আবেগ তাড়িত হয়ে নানা রকম দুঃখ বেদনা নিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে। এর পরে কি হয় সে নিজেও জানে না।
আত্মহনন কেন করে অনুসন্ধান করলে দেখা যায় নানা কারণে মানুষ আত্মহত্যা করে থাকে। এ নিয়ে বহু গবেষনা ও অনেক সমীক্ষা প্রকাশিত হয়েছে। আত্মহত্যার জন্য কোন লজিক না থাকলেও দর্শন শাস্ত্রে এ নিয়ে অনেক আলোচনা বা মতামত আছে। এসব কারো পড়া থাকলে সে কখনো এ পথে অগ্রসর হবে না। ধর্ম শাস্ত্রেও আত্মহত্যাকে মহাপাপ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। অর্থাৎ নিজেকে নিজে যে হত্যা করে সে পাপিষ্টদের অন্তর্ভুক্ত হবে। পরকালে তার স্থান হবে নরকে, পাপীদের সাথে। যদিওবা অনেকে অত্মহত্যার পথ বেছে নেয় জাগতিক দুঃখ দুর্দশা কিংবা অশান্তি থেকে মুক্তির জন্য। এটা তাদের সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। এজন্য যাদের ধর্মীয় জ্ঞান, শাস্ত্রীয় জ্ঞান বা জাগতিক ভাল মন্দ বিবেচনা করার ক্ষমতা রয়েছে তারা কখনো আত্মহননের পথ বেছে নিতে পারে নে। তবে অনেক সময় সার্বিক বিষয়ে ভারসাম্যহীনতা মানুষকে বিবেকহীন করে তোলে যা সিদ্ধান্তহীনতার দিকে ঠেলে দেয়। এতেও একজন মানুষ আত্মহত্যার সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে না।
পত্র-পত্রিকায় দেখা যায় ইদানীং অত্মহত্যার প্রবনতা অনেক বেড়ে গিয়েছে। বছরে প্রায় সাড়ে পাঁচশত শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। যারা বয়সে তরুণ, আগামী প্রজন্ম, দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিক। এসব শিক্ষার্থীর মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা বেশি (প্রায় ৬৪ শতাংশ) আবার স্কুলগামী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৪০ জন যা ৬৪ শতাংশ। স্কুলে যারা লেখাপড়া করে তাদের বয়স চৌদ্দ বা পনের। এ তরুণ বয়সের ছেলে মেয়েরা এরকম একটা বিভৎস পথ বেছে নিলো কেন? কলেজে যারা পড়ে তাদের বয়সইবা কত? ১০৬ জন কলেজ শিক্ষার্থী। আবার মাদ্রাসা ছাত্রও আছে ৫৪ জন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আছে অন্তত ৮৪ জন। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সমীক্ষা অনুযায়ী এ তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। এর বাইরেও আরো থাকতে পারে। আত্মহননের মত এরকম দু:সংবাদ যা সমাজে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে, অন্যদেরকে প্ররোচিত করতে পারে তার সবটুকু পত্র-পত্রিকায় প্রচারিত হয় না । আসলে প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে।
স্কুলগামী ছেলে মেয়েরা এখনো কোমলমতি শিশু। এসব শিশু কিশোদের আনন্দে মেতে থাকার কথা। আনন্দ উচ্ছ¡াসে হৈ চৈ করে সময় কাটানো তাদের স্বভাব। একটি কিশোরী মেয়ে কত প্রাণবন্ত থাকে, একটি কিশোর বালক কত দুরন্ত। কত রকম স্বপ্নের জাল বুনে তারা। পরিবারের অভাব অনটন কোন কিছুই তাদের মনকে ভারী করতে পারে না। বাধা বিপত্তি কোন কিছুই তাদের আটকাতে পারে না। তাদের মন রঙিন ঘুড়ির মতো কেবলই আকাশে উড়তে চায়। বোধ বুদ্ধি কোনটাই যাদের এখনো পরিপক্ব হয়নি। কোন কিছু বুঝে উঠার আগে তারা কেন এ পথে পা বাড়াবে? এ পথতো তারা একদিনে বেছে নেয় নি? তাদেরকে বুঝার মতো কেউ নেই।
শতাধিক কলেজ শিক্ষার্থী, তার সাথে যুক্ত হয়েছে পঞ্চাশের বেশি মাদ্রাসা শিক্ষার্থী, গড়ে উঠার আগে হারিয়ে গেলো। স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজের আঙ্গিনায় পা রাখলে ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে এক ধরনের পরিবর্তন আসে। নিজেরা ভাবে তারা এখন বড় হয়েছে, কলেজে পড়ে। অনেক কিছু বুঝতে পারে। নিজস্ব একটা স্বকীয়তা গড়ে উঠে, নিজের একটা জগতের কথা ভাবতে পারে। সহপাঠিদের নিয়ে আনন্দ উচ্ছ¡াসে স্বপ্নের পথে এগিয়ে চলে। তাদের এত দুঃখ বা অভিমান কিসের? যার জন্য সুন্দর এ পৃথিবীর মায়া ছেড়ে যাওয়ার আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেয়। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের কেন ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারলো না? ধর্মের আলো তাদের অন্তরে পৌঁছাতে পারলো না কেন? অন্তরকে বিকশিত করতে গিয়ে নিজেকে বিনাশ করলো কেন? এখনতো ইহকালও গেল, পরকালও হারালো। এ মৃত্যুযন্ত্রনার চেয়ে পরকালের আযাব বা শান্তি আরো কঠিন ও ভয়ংকর। সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরাও আত্মহত্যার পথে পাড়ি জমায়, ভাবতে অবাক লাগে । নিজেকে তৈরী করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের মধ্য দিয়ে সুন্দর একটি জীবনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন থেকে কেন দূরে সরে যায় তার হিসাব মিলানো যায় না।
শিশুরা পরিবারে বেড়ে উঠে। আদর যতœ স্নেহ ভালবাসা সবই পরিবার থেকে পায়। মান অভিমানও পরিবার থেকে শিখে। মা সেবা যতœ করে শিশুকে বড় করে তোলে। শিশুর লালন পালনের দায়িত্বও মার উপর থাকে। একজন শিশুর কাছে মা সবচেয়ে বেশি আপনজন। তারপর বাবা, ভাই-বোন ও পরিবারের অন্য সদস্যরা। যে কোন শিশুর উপর মার প্রভাবই বেশি পড়ে। মার সাথে তার বেশি সময় কাটে। পরিবারের অন্যান্যদের প্রভাবও পড়ে। বাবার প্রভাবও অনেক। পরিবারে একজন কাজের কেউ থাকলে তার প্রভাবও পড়ে থাকে। এভাবে আত্মীয় স্বজন যারা পরিবারে আসে তাদেরও। শিশুর মানস গঠনে স্কুল একটা বড় ভূমিকা পালন করে। এখানে সে অনেক কিছু শিখতে পারে। নিয়মকানুন শৃংখলা এসব কিছু সে স্কুল থেকে শিখে। সহপাঠিদের কাছ থেকে তার শেখার শেষ নেই। দেখে দেখে শিখে ফেলে। নিজের অজান্তে শিখে। মেলামেশা করতে গিয়ে ভাবের আদান প্রদান হয়। স্কুলের মাঠে ছুটাছুটি বা খেলাধুলার মধ্য দিয়ে শিশুর মনোজগত বিকশিত হতে থাকে। কিন্তু এখন সেই পরিবেশ নেই। অনেকগুলো বই দিয়ে শিক্ষার্থীর বোঝা ভারি করে দেয়। বাবা-মা আর শিক্ষকেরা সবাই চায় শিক্ষার্থীরা ভাল ফলাফল করুক। পড়ালেখার চেয়েও ভাল ফলাফলের দিকে মনোযোগ থাকে বেশি। এতেও একধরনের মানসিক চাপ তৈরী হয় শিক্ষার্থীদের উপর। পরিবেশের কাছ থেকেও ছেলে-মেয়েরা অনেক কিছু শিখে। প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকেও অনেক কিছু শেখার আছে। আশে পাশের গাছ পালা পশু পাখি ও অন্যসব প্রাণী থেকে শিশুরা নিজে নিজে শিখে নেয়। কেউ তাদের শেখাতে হয় না। আর সামাজিক পরিবেশের ভেতর দিয়ে শিশুরা বড় হতে থাকে। সামাজিক পরিবেশেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
যেসব শিশুরা ভাল সামাজিক পরিবেশ পায়না তাদের মধ্যে অনেক ধরনের অসঙ্গতি দেখা যায়। মন মানসিকতাও সেভাবে গড়ে উঠে। একটা সমাজে নানা ধরনের মানুষের বসবাস। ভাল মন্দ সব মিলে সমাজ। সমাজের সবকিছু যে ভাল তা নয়। এজন্য ছেলে মেয়েদের সমাজের খারাপ কিছু থেকে দূরে রাখতে হয়। এরকম কিছু ভেবে অনেক বাবা-মা ছেলে মেয়েদের সমাজে কারো সাথে মিশতে দেয় না। এতে করে সমাজের ভাল দিকগুলো তারা শিখতে পারে না। তাদের মাঝে এক ধরনের আলাদা থাকার মানসিকতা গড়ে উঠে। বড় হলে তারা কারো সাথে সহজে মিশতে পারে না।
বর্তমানে ছেলে মেয়েদের মাঝে সহনশীলতার খুব অভাব। বন্ধু বান্ধব বা সহপাঠিদের সাথেও তারা খুব ভাল করে মিশতে পারে না। অনেক সময় ছোট খাট বিষয় নিয়ে মনোমালিন্য হয়ে যায়। একজনের সাথে আরেকজন কথা বলে না। এমনও দেখা যায় পরিবারে ভাই বোনদের সাথেও মন খুলে কথা বলতে পারে না। ঝগড়া ঝাটিও হয়নি। তারপরও একজন আরেকজনকে সহ্য করতে পারে না। বাবা মা ভাই বোনের পারিবারিক বন্ধন আগের মত প্রাণবন্ত নেই। অনেক ক্ষেত্রে বাবা-মা দু’জনই চাকরীজীবি। ছেলে মেয়েদেরকে তারা আর সেভাবে দেখাশুনা করতে পারে না। কোন কোন ক্ষেত্রে মা-বাবার সম্পর্কটা খুব আন্তরিক নয়। কথা কাটাকাটি ঝগড়া ঝাটি লেগে থাকে। এসব নেতিবাচক দিকগুলো ছেলে মেয়েকে প্রভাবিত করে। মা-বাবার সাথে তাদেরও একধরনের দূরত্ব তৈরী হয়। সহনশীল না হয়ে তাদের মধ্যেও জেদি মনোভাব গড়ে উঠে। স্কুলগুলোতে শিক্ষার পরিবেশ ও ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক আগের মতো নেই। শিক্ষকের মূল কাজ শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের পাঠদান। সেটা ঠিকমত হয় না। শিক্ষার্থীরা কোচিং সেন্টারের দিকে ছুটতে হয়। স্কুল কলেজে ঠিকমত লেখাপড়া হলে ছাত্র-ছাত্রীরা কোচিং সেন্টারমুখি কেন হবে? কোচিং সেন্টার গুলোতে কারা পড়ায়? বেশিরভাগ পেশাগত শিক্ষক নয়। সেখানে লেখাপড়া ভাল হয়। তা না হলে স্কুল কলেজের ক্লাস বাদ দিয়ে টাকা খরচ করে কেউ কোচিং সেন্টারে যেতো না। এরকম আরো অনেক সমস্যা শিক্ষা ব্যবস্থাকে জর্জরিত করে রেখেছে।
শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার প্রনতা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে যাওয়ার কারন অনেক। এত সংখ্যক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করার অন্যতম কারণ তাদের মানসিক বিকাশ। তাদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার দিকে কারো নজর নেই। তথ্য প্রযুক্তির এ সময়ে মোবাইলের মাধ্যমে অতি সহজে তারা সর্বত্র বিচরণ করতে পারে। যা তাদেরকে নানাভাবে অস্থির করে তোলে। এ অস্থিরতা তাদের জন্য কাল হলে দাঁড়ায়। অনেক সময় বিষন্নতার দিকে ঠেলে দেয়। শিশুরা পরিবার, স্কুল ও সমাজের নানা অসংগতির শিকার হচ্ছে। তাদের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশ নানাভাবে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড, খেলাধুলা ও শরীর চর্চা নেই বললে চলে। এধরনের কর্মকান্ড সব স্কুলে আবার চালু করে সকল ছাত্র-ছাত্রীদের অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া প্রয়োজন। একই সাথে শান্তিপূর্ণ পারিবারিক বন্ধন, সুশৃঙ্খল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও নৈতিকতামূলক শিক্ষা এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ সামাজিক পরিবেশ শিশু কিশোরদের আত্মহননের প্রবনতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও বিশিষ্ট ব্যাংকার