শিক্ষাক্ষেত্রে কোচিংনির্ভরতা কেন এ পর্যায়ে পৌঁছেছে?

64

সরকারি কর্মকর্তা একজন অভিভাবক নাম প্রকাশ করতে চাইলেন না। তার এক মেয়ে সপ্তম শ্রেণিতে এবং এক ছেলে উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র। দুজনেই ঢাকার নামকরা দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। দুই জনই কোচিং সেন্টারে যায়।
তিনি বলেন, যেহেতু আমরা দুজনেই কর্মজীবী, সেজন্য আমরা বাচ্চাদের বাসায় সময় দিতে পারি না। যদি সময় দিতে পারতাম তাহলে তাদের কোচিং সেন্টারে যাবার প্রয়োজন হতো না।
দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় কোচিং নির্ভরতা দৌরাত্যে র পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে অনেকে মনে করেন। প্রশ্ন উঠছে, শিক্ষার্থীরা কি বাধ্য হয়েই কোচিং সেন্টারে যাচ্ছে? দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় কী এমন ঘটেছে যে অধিকাংশ শিক্ষার্থী কোচিং ছাড়া ভাবতেই পারছেন না?
দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ক্যাম্পেইন ফর পপুলার এডুকেশন বা ক্যাম্পে। প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ কর্মকর্তা রাশেদা কে. চৌধুরী বলেন, কোচিং এর চাহিদা তৈরি হয়েছে, সেটির বড় কারণ হচ্ছে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এখন অনেকটাই পরীক্ষা এবং নম্বর কেন্দ্রিক হয়ে গেছে। ফলে এর পেছনে ছুটছে সবাই।
তিনি বলেন, উচ্চতর পর্যায়ে যাবার আগে একজন শিক্ষার্থীকে চারটি পাবলিক পরীক্ষা দিতে হয়। এটা পৃথিবীর কোন দেশেই নেই। আমাদের গবেষণা বলছে, প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা দেবার আগে ৮৬ শতাংশ শিশু শিক্ষার্থীরা কোচিং এ যাচ্ছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিমালায় বলা হয়েছে, কোন শিক্ষক তার নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে কোচিং করাতে পারবেন না। কিন্তু প্রতিষ্ঠান প্রধানের অনুমতি নিয়ে অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে পড়াতে পারবে। কিন্তু এ সংখ্য দৈনিক ১০ জনের বেশি হতে পারবে না।
নীতিমালায় আরো বলা আছে, অভিভাবকদের আগ্রহের প্রেক্ষিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করতে পারবেন। এক্ষেত্রে প্রতি বিষয়ে মেট্রোপলিটন এলাকায় মাসিক সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা এবং জেলা শহরে ২০০ টাকা রশিদের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ফি আদায় করা যাবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠাগুলোতে শিক্ষকের চেয়ে শিক্ষার্থীর অনুপাত বেশি। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে একজন শিক্ষকের বিপরীতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৬০ থেকে ৭০জন। এমন অবস্থায় শ্রেণিকক্ষে পাঠদান দিয়ে কুলিয়ে ওঠা তাদের পক্ষে সম্ভব নয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
কোচিং সেন্টারগুলো অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের নম্বর পাওয়ার কলা-কৌশল শিখিয়ে দেয় বলে উল্লেখ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইন্সটিটিউটের শিক্ষক মজিবুর রহমান। দেশে স্কুল এবং কলেজ পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থায় শ্রেণি কক্ষের বাইরে শিক্ষার্থীরা নানাভাবে শিক্ষকদের সহায়তা নিয়ে থাকে।
এগুলোর মধ্যে রয়েছে গৃহশিক্ষক রাখা, নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কাছে দলবদ্ধভাবে পড়া এবং ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠা বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে গিয়ে পড়া। এসব কোচিং সেন্টারের সাথে অনেক ক্ষেত্রেই স্কুলের শিক্ষকদের কোন সম্পর্ক নেই।
ঢাকার ফার্মগেট এলাকায় কনফার্ম নামে একটি কোচিং সেন্টারে কথা হয় প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার মুস্তাফা পাটোয়ারীর সাথে। এ কোচিং সেন্টারটিতে তৃতীয় শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় আড়াইশ শিক্ষার্থীকে কোচিং করানো হয়। এখন যেহেতু এসএসসি পরীক্ষা চলছে সেজন্য অন্য সব কোচিং সেন্টারের মতো এটিও সরকারি নির্দেশে বন্ধ রয়েছে। এখানে যারা শিক্ষক হিসেবে রয়েছেন তাদের বেশিরভাগই বয়সে তরুণ এবং বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র।
পাটোয়ারী বলেন, কোন কোচিং সেন্টার জোর করে কিংবা প্রতারণা করে শিক্ষার্থীদের টানতে পারে না। তারা উপকৃত হচ্ছে বলে এসব কোচিং সেন্টারে আসছে। কেউ যদি ভালো পড়ায় মানুষ তাকে খুঁজে বের করবে। যে কোন লোক বললেই তার কাছে কেউ পড়তে যাবে না।
তিনি বলেন, বাসায় শিক্ষক রেখে পড়ানো বেশ ব্যয়বহুল। ফলে সবাই সে ব্যয় বহন করতে পারে না। গৃহশিক্ষক রেখে একটি বিষয় পড়াতে যে টাকা খরচ হয়, সেটি দিয়ে কোচিং সেন্টারে সবগুলো বিষয় পড়া যায়।
শিক্ষা গবেষকরা বলছেন, ছাত্র-ছাত্রীদের কোচিংমুখী হবার ক্ষেত্রে অভিভাবকদের মানসিকতাও কম দায়ী নয়। বিশেষ করে যারা প্রাথমিক পর্যায়ে পড়াশুনো করছে তাদেরও কোচিং সেন্টারের দিকে ঠেলে দেবার পেছনে অভিভাবকদের প্রতিযোগিতাকেই দায়ী করেন তারা।
অভিভাবকরাই বা কেন ছুটছেন? দেশের স্কুল কলেজের পাঠ্যক্রমে এমন কোন পরিবর্তন কি এসেছে, যার কারণে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের কোচিং করাতে বাধ্য হচ্ছেন?
এ প্রশ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইন্সটিটিউটের শিক্ষক মজিবুর রহমান বলেন, আগের চেয়ে পাঠ্যক্রম আরো সহজ হয়েছে। একজন শিক্ষার্থী যাতে বিষয়গুলো পড়ে বুঝতে পারে, সেভাবেই তৈরি করা হয়েছে পাঠ্যক্রম। বিষয়গুলো এমন জটিল না যে কেউ পড়িয়ে না দিলে তারা শিখবে না, বিষয়টা এমন না।
অভিভাবকরা বলেছেন, কখনো কখনো কোচিংয়ে যাবার প্রয়োজন যেমন তৈরি হয়, আবার অনেক সময় অভিভাবকরা অবচেতন মনে এক ধরণের প্রতিযোগিতায়ও লিপ্ত হচ্ছেন।
এক অভিভাবক সে কথাই বললেন। ‘অভিভাবকরা হুজুগের বশে আছেন। অনেক বোঝেন না যে ভর্তি করতেই হবে নাকি না করলেও চলবে। বিষয়গুলো প্রতিযোগিতামূলক হয়ে গেছে।’
শিক্ষার্থীরা বলছেন, অনেকের মাঝেই এমন এক ধারণা তৈরি হয়েছে যে কোচিং-এ না গেলে হয়তো সে পিছিয়ে যাচ্ছে।
কখনো-কখনো শিক্ষকরা কোচিং এ যেতে বাধ্য করেন, এ কথা যেমন সত্য তেমনি অনেক সময় শিক্ষার্থীরা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে কোচিং এ যায়।
উচ্চ মাধ্যমিকের এক ছাত্র বলেন, তিনি সবসময় কোচিং এর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না। তবে তার অনেক সহপাঠী মনে করেন, কোচিং করা বাধ্যতামূলক।
দেশে শিক্ষা ব্যবস্থায় কোচিং এর উপর যে নির্ভরশীলতা বেড়েছে সেটি কমিয়ে আনা যায় কিভাবে? এমন প্রশ্নে রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, পাবলিক পরীক্ষার সংখ্যা যত কমিয়ে আনা যাবে, কোচিং এর ব্যাপকতাও খানিকটা কমবে। ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে বলা আছে যে, অষ্টম শ্রেণির আগে কোন পাবলিক পরীক্ষা থাকবে না। এছাড়া অষ্টম ও দ্বাদশ শ্রেণির আগে কোন পাবলিক পরীক্ষা থাকার প্রয়োজন নেই বলে শিক্ষানীতিতে বলা আছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, কোচিং নির্ভরতা কিংবা কোচিং বাণিজ্য যেভাবে গড়ে উঠেছে-এজন্য কোন একটি কারণ দায়ী নয়। তবে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো-শ্রেণিকক্ষে যদি শিক্ষার্থীদের চাহিদা পূরণ সম্ভব না হয়, তাহলে নানা কৌশলে কোচিং বাণিজ্য টিকে থাকবে।