শিক্ষকের আন্তরিকতাই সম্ভব মানসম্পন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা

194

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় “শিক্ষা হল তাই যা আমাদের কেবল তথ্য পরিবেশনই করে না বিশ্বসত্তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকে গড়ে তোলে।” সক্রেটিসের ভাষায় “শিক্ষা হল মিথ্যার অপনোদন ও সত্যের বিকাশ।” এরিস্টটল বলেন “সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরি করাই হল শিক্ষা”। সাধারণ অর্থে জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জনই শিক্ষা। ব্যাপক অর্থে পদ্ধতিগতভাবে জ্ঞানলাভের প্রক্রিয়াকেই শিক্ষা বলে। তবে শিক্ষা হল সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের অব্যাহত অনুশীলন। বাংলা শিক্ষা শব্দটি এসেছে ‘শাস’ ধাতু থেকে। যার অর্থ শাসন করা বা উপদেশ দান করা। অন্যদিকে শিক্ষার ইংরেজি প্রতিশব্দ এডুকেশন এসেছে ল্যাটিন শব্দ এডুকেয়ার বা এডুকাতুম থেকে। যার অর্থ বের করে আনা অর্থাৎ ভেতরের সম্ভাবনাকে বাইরে বের করে নিয়ে আসা বা বিকশিত করা। বলা হয়ে থাকে শিক্ষা জাতির মেরুদÐ আবার কেউবা বলে থাকেন সুশিক্ষাই জাতির মেরুদÐ। তবে কথা যাই হোক না কেন কোনো কিছুর মেরুদÐ শক্ত হওয়ার অর্থ তার গোটা কাঠামো শক্ত হওয়া। সুতরাং জাতির মেরুদÐ শক্ত হলেই বুঝতে হবে সে জাতির শিক্ষা ব্যবস্থা ভালো ও টেকসই। আমরা বিশ্বাস করি, যে শিক্ষার উন্নয়ন মানে দেশের উন্নয়ন। যে দেশের শিক্ষা ও শিক্ষা ব্যবস্থা যত উন্নত সে জাতিও তত উন্নত। শিক্ষা স¤প্রসারণের সাথে সাথে শিক্ষা ব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নয়ন সাধিত হলে দেশের সকল জাতি-গোষ্ঠী তথা সকল নাগরিক উন্নতির শীর্ষে অবস্থান করতে পারে। শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন নির্ভর করে শিক্ষা কার্যক্রম ও পাঠ্যক্রমের ধরন ও বাস্তবায়নের ক্রমধারানুযায়ি মূল্যায়নভিত্তিক সঠিক প্রতিফলনের উপর। আমরা জানি, এক দশক আগেও বাংলাদেশে স্কুলগামী ছাত্রছাত্রীর হার ছিল কম এবং মেয়েদের হার ছিল আরও কম। সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ, যেমন সময়মতো বিনামূল্যে বই বিতরণ, অবৈতনিক শিক্ষা, উপবৃত্তি বিতরণ প্রভৃতি কারণে স্কুলগামী ছেলেমেয়ের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি শিক্ষার হারও প্রতি বছর বেড়েই চলেছে। প্রশ্ন হচ্ছে- শিক্ষার হার বাড়লেই কি আদর্শবান জাতি হওয়া যায়? বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে আমাদের কমবেশি সবারই জানা আছে। এখানে অনেক দেশের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য বিদ্যমান। যেমন জাপানের কথাই বলা যেতে পারে। জাপানের প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার সঙ্গে আমাদের মৌলিক পার্থক্য হলো, আমরা শুরুতেই বাচ্চাদের ঘাড়ে এক বোঝা বইয়ের ব্যাগ চাপিয়ে ভালো রেজাল্টের জন্য শিক্ষক, অভিভাবক সবাই ছোটাছুটি করি। ফলে ভালো রেজাল্টধারী অনেক ছাত্রছাত্রী পাওয়া গেলেও আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় মানবিক গুণসম্পন্ন ভালো মানুষের বড়ই অভাব। প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার পেছনে যেসব কারণ দায়ী, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক শিক্ষার অভাব। প্রাথমিক স্তরের সিলেবাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সেখানে নৈতিক শিক্ষা বা নীতি কথার চেয়ে তাত্তি¡ক কথা অনেক বেশি, যা বাচ্চারা মুখস্থ করে পরীক্ষায় পাসের জন্য। আচরণগত শিক্ষা দেয়া হয় খুব কম। মানসম্মত শিক্ষকের অভাব : বলতে দ্বিধা নেই, যারা মানুষ গড়ার কারিগর, তাদের অনেকেই শিক্ষকতার মতো মহান পেশাকে নেহাতই আয়-রোজগারের একটি উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছেন বা নিচ্ছেন। এ অবস্থা থেকে বের হওয়া জরুরি। শিক্ষকের অপ্রতুলতা : বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় ছাত্রছাত্রী-শিক্ষকের যে অনুপাত, তা মানসম্মত শিক্ষার জন্য মোটেও উপযোগী নয়। এই অনুপাত ১:৫৩ থেকে কমিয়ে ১:২৫ তে আনা উচিত। শ্রেণিকক্ষের স্বল্পতা : আদর্শবান জাতি গঠনের লক্ষ্যে সুষ্ঠু মেধা বিকাশ উপযোগী যে ধরনের শ্রেণিকক্ষ দরকার, তা অনেক বিদ্যালয়েই অনুপস্থিত। এছাড়া অন্যতম একটি কারণ দারিদ্র্য। বাংলাদেশে এখনও অনেক পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। তারা তাদের সন্তানকে বিদ্যালয়ের চেয়ে জীবিকার কাজে নিয়োজিত করতেই বেশি পছন্দ করে। আবার বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির দুর্বলতা অন্যতম একটি কারণ। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, এসএমসির অনেক সদস্যই শিক্ষার গুরুত্ব বা গুণগতমান বৃদ্ধির বিষয়ে মোটেও সচেতন নন। সর্বশেষ বলা যেতে পারে, অভিভাবকদের অসচেতনতা। অভিভাবকদের অসচেতনতা প্রাথমিক শিক্ষার গুণগতমান বৃদ্ধির অন্তরায়। প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে যে বিষয়ে দ্রæত পদক্ষেপ নেয়া উচিত, তা হলো শুধু সিলেবাসভুক্ত পড়াশোনা না করিয়ে আদর্শভিত্তিক নীতিনৈতিকতাসম্পন্ন মানসিকতা তৈরির পদক্ষেপ নিতে হবে। ৫ বছর বয়সে স্কুলে গমন বাধ্যতামূলক করে ৬ বছর বয়স পর্যন্ত শুধু নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাবী, চরিত্রবান ও যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে হবে। শিক্ষকদের পৃথক বেতন কাঠামো করে তাদের মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে হবে। ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাত কমিয়ে আনতে হবে। শিক্ষার ব্যাপারে অভিভাবকদের আরও বেশি সচেতন করতে হবে। কাঠামোবদ্ধ প্রশ্ন তৈরি ও পাঠদানে শিক্ষকদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। সর্বোপরি সুষ্ঠু মেধা বিকাশে শিক্ষার পরিবেশ তৈরির জন্য যা যা প্রয়োজন, সরকারের পক্ষ থেকে প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য তা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের নিয়মিত শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতি ও পাঠ্যাভ্যাসে আগ্রহী করে তুলতে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আধুনিক জ্ঞান ও ধ্যানধারণা শিক্ষার্থীদের মাঝে বাড়িয়ে দিতে শিক্ষকদের এগিয়ে আসতে হবে। গতানুগতিক শিক্ষার পরিবর্তে ডিজিটাল বা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষা দিতে হবে। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর প্রতি লক্ষ রাখতে হবে। পাঠদানের আগে শিক্ষকদের যথেষ্ট প্রস্তুতি থাকা বাঞ্ছনীয়।
শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তি তথা প্রাথমিক শিক্ষাস্তর যদি ভবিষ্যত প্রজন্মের মনমগজে ও ধ্যানে জ্ঞানে আদর্শ, নীতি নৈতিকতা, সততা, আচরণগত অভ্যাস, দেশ প্রেম, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, জাতির প্রতি মমত্ববোধ তৈরি করতে না পারে তা হলে কখনোই আদর্শবান জাতি গঠন করা সম্ভব নয়। আর একজন শিক্ষার্থী ভবিষ্যতে কতটুকু ন্যায় নীতিবান, আদর্শবান, চরিত্রবান হবে কিংবা দেশ, জাতি, সমাজের প্রতি কতটুকু দায়িত্বশীল হবে কতটুকু দায়িত্ব পালন করবে এটি অনেকাংশেই নির্ভর করে তাঁর সুশিক্ষার উপর।
শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন, শিখন প্রক্রিয়ার উন্নয়ন, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং সমাজে বিদ্যমান বৈষম্য দূরীকরণের মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ বিনির্মাণে শিক্ষকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীকে পাঠ বুঝিয়ে দিলেই শিক্ষকের দায়িত্ব শেষ নয়, পাঠ্যবিষয়ের বাইরে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধের আলোকে শিক্ষার্থীর আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা শিক্ষকের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সমাজের প্রত্যাশা মোতাবেক একজন শিক্ষক হবেন জ্ঞান তাপস, মেধাবী, বুদ্ধিদীপ্ত, ব্যক্তিত্ববান, চৌকস, শ্রেণি কক্ষে আগ্রহী পাঠদানকারী ও জ্ঞান বিতরণে আন্তরিক। তিনি সুবিচারক, সুপরীক্ষক, শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রক, যুক্তিবাদী, গবেষক এবং উদ্ভাবকও। তিনি সঠিক পথের দিশারী, পথ প্রদর্শক। অবশ্যই সৎ ও ধার্মিক। শিক্ষক সহজ হবেন, সরল হবেন, নির্মল হবেন, হবেন অকুতোভয় সত্যবাদী। সপ্রতিভ ব্যক্তিত্ববান, সমাজ হিতৈষী, পরোপকারী এবং আধুনিকতামনস্ক বিচক্ষণ সমাজ সংস্কারক। পরিশেষে আমরা বলতে পারি, সুশিক্ষা গড়তে পারে একটি সুন্দর সমাজ, জাতি ও দেশ- যেখানে থাকবে না দুর্নীতি, থাকবে দেশপ্রেম। তবেই শিক্ষক হবে জাতির অলংকার। আর মানসম্মত শিক্ষাই হবে জাতির মেরুদÐ।