শাহ আমানত বিমানবন্দর এক বছরে ৫ মণ স্বর্ণ জব্দ উদ্ধার ৩০ হাজার ইয়াবা

44

সাতকানিয়ার আহসানুল সগীর বিমানের একটি ফ্লাইটে দুবাই যাওয়ার জন্য শাহ আমানত বিমানবন্দরে যাচ্ছিলেন। মূল প্রবেশ গেট পার হওয়ার সময় নিরাপত্তাকর্মীদের সন্দেহ হয়। তাকে তল্লাশি করা হলে লাগেজের ভেতর আচারের প্যাকেটে মিলে ৮৮০ পিস ইয়াবা।
জিজ্ঞাসাবাদে তিনি স্বীকার করেন, এসব ইয়াবা দুবাই নিয়ে যাচ্ছিলেন। আগেও কয়েকবার নিয়ে গেছেন। এর আগে বিমানবন্দর এলাকায় পাঁচ হাজার ইয়াবাসহ আটক করা হয় শারজাহগামী এক যাত্রীকে। তার বাড়ি ফটিকছড়ি, নাম মা. সোহেল (৩০)। এয়ার এরাবিয়ার একটি ফ্লাইটে তার শারজাহ যাওয়ার কথা। টার্মিনালের বাইরে সন্দেহজনকভাবে ঘুরাঘুরি করার সময় তার হাতে থাকা ব্যাগ তল্লাশি করে মিলে এসব ইয়াবা।
বিমানবন্দরের অভ্যন্তরীণ টার্মিনালের বাইরে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করছিল নজরুল ও জুবায়ের। সন্দেহ হওয়ায় তাদের অনুসরণ করেন বিমানবন্দর আর্মড পুলিশের সদস্যরা। বিমানবন্দর চত্বরে কী করছে জিজ্ঞাসা করলে বিভ্রান্তিকর ও সন্দেহজনক কথাবার্তা বলে।
পরে তারা দু’জনই স্বীকার করে, তাদের পেটের ভিতরে ইয়াবা ট্যাবলেট আছে। প্রায় নয় হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট কালো টেপ দিয়ে প্যাঁচানো অবস্থায় গিলে পেটের ভিতরে করে নিয়ে যাচ্ছে আবুধাবিতে।
হাটহাজারী উপজেলার চিকনদন্ডি গ্রামের জহুর আলম স্ত্রীসহ যাচ্ছিলেন আমিরাতের শারজাহ। শুক্রবার সকালে শাহ আমানত আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরের প্রথম স্ক্যানিং মেশিন পার হয়ে যান। কোনো সমস্যা হয়নি। ইমিগ্রেশন শেষ করার পর দ্বিতীয় স্ক্যানিং মেশিন পার হতে গিয়েই বিপত্তি দেখা দেয়। তার ব্যাগে থাকা ৬০ হাজার দেরহাম ও ৩০০ ইউএস ডলার ধরা পড়ে যায়। তাকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। মুদ্রা পাচার আইনে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।
ক’দিন আগে বিমানবন্দর এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৩০টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করেছে কোস্ট গার্ড। কোনো একটি ফ্লাইটে নিয়ে আসা এসব স্বর্ণ বিমানবন্দর থেকে ব্যাগে করে নিয়ে যাচ্ছিলেন এক পাচারকারী। কোস্ট গার্ড সদস্যদের দেখে ব্যাগ ফেলে পালিয়ে যান তিনি। পরে ব্যাগ তল্লাশি করে ৩০টি স্বর্ণের বার পাওয়া যায়। এসব স্বর্ণ পরে কাস্টম হাউজে হস্তান্তর করা হয়েছে।
এভাবে শাহ আমানত বিমানবন্দর দিয়ে প্রতিনিয়ত পাচার হচ্ছে ইয়াবা ও বৈদেশিক মুদ্রা এবং আসছে সোনা। ক্ষেত্রবিশেষে গাঁজাও পাচার করা হচ্ছে। একারণে মধ্যপ্রাচ্যের আমিরাতের আবুধাবি, দুবাই, শারজাহ, ওমান ও সৌদি আরবের বিমানবন্দরে বাংলাদেশি যাত্রীদের আলাদাভাবে তল্লাশি করা হচ্ছে। এতে হেনস্থা হচ্ছেন সাধারণ যাত্রীরা।
মাদকের কারণে বিদেশে ক্ষুণ্ণ হচ্ছে দেশের সুনাম। আবুধাবি বিমানবন্দরে একজনকে ইয়াবাসহ আটক করে জেলে দিয়েছে সেদেশের পুলিশ। পাচারকালে শাহ আমানতে গত এক বছরে উদ্ধার করা হয়েছে ৩০ হাজার ইয়াবা। একই সময়ে আনার সময় স্বর্ণ জব্দ করা হয়েছে ৫ মণ। বাংলাদেশ ও মধ্যপ্রাচ্যের দু’টি সিন্ডিকেট মাদক ও সোনা চোরাচালানে জড়িত বলে জানা গেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সড়ক ও নৌপথের পাশাপাশি ইয়াবা পাচারে যুক্ত হয়েছে আকাশপথ। এক সময় ছিল এটি কল্পনা। বর্তমানে তা বাস্তব করেছে ইয়াবা সিন্ডিকেট। আগে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ইয়াবা ছড়িয়ে দিলেও এখন সীমানা ছাড়িয়ে পৌঁছে দিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে।
বিমানবন্দর সূত্রে জানা গেছে, এপ্রিল মাসে আবুধাবিগামী এক যাত্রীর জুতোর ভেতর থেকে ৫৪০পিস ইয়াবা ও ২০০ গ্রাম গাঁজা উদ্ধার করেছে কর্তৃপক্ষ। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের যাত্রীদের চূড়ান্ত তল্লাশির সময় স্ক্যানিং মেশিনে মাদকের বিষয়টি ধরা পড়ে। ওই যাত্রীর নাম মো. জমির।
জমির বিমানবন্দর কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন, অপরিচিত একজন মানুষ জুতোজোড়া পায়ে দিয়ে আবুধাবি নিয়ে যাওয়ার জন্য ৫০ হাজার টাকা দেবেন বললে তিনি রাজি হয়ে যান। লোভে পড়ে তিনি জুতোগুলো নিয়ে যাচ্ছেন। তবে জুতোর ভেতর কি আছে তা তিনি জানতেন না।
এর আগে বিমানবন্দরে তিন হাজার পিস ইয়াবাসহ মোহাম্মদ সাহেদ নামে এক যাত্রীকে আটক করে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বিভাগ। সাহেদ ওমানের রাজধানী মাসকাট যাচ্ছিলেন। আন্তর্জাতিক বহির্গমনে চেকিংয়ের সময় স্ক্যানিং মেশিনে ইয়াবাগুলো ধরা পড়ে।
এর ক’দিন আগে মোহাম্মদ রুবেল নামে এক যাত্রীর কাছ থেকে প্রায় ২৫ কেজি গাঁজা উদ্ধার করা হয়। তার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। রুবেল ছিলেন দুবাইয়ের যাত্রী। তিনি চট্টগ্রাম থেকে দুবাই হয়ে একই ফ্লাইটে ওমানের রাজধানী মাসকাট যাচ্ছিলেন। বিমানবন্দরে ঢোকার সময় নিজের লাগেজের পাশাপাশি আলাদাভাবে দুটি তোষক নিয়েছিলেন রুবেল। বিমানবন্দরের বোর্ডিং কাউন্টারে প্রবেশের সময় প্রথম স্ক্যানারে তোষকের ভেতরে সন্দেহজনক বস্তুর উপস্থিতি পান বেসামরিক বিমান পরিবহন বিভাগের নিরাপত্তাকর্মীরা। পরে খুলে দেখা যায়, ‘তোষকভর্তি গাঁজা’। একই সময়ে সুমি নামে এক নারী যাত্রীর কাছ থেকে ৩ হাজার ৪২৫ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়।
বিমানবন্দর সূত্রে জানা গেছে, যাত্রীদের লাগেজ তল্লাশির জন্য বিমানবন্দরগুলোতে স্থাপিত এক্সরে স্ক্যানিং মেশিন, ডুয়েল ভিউ স্ক্যানিং মেশিন ধাতব ও বিস্ফোরকদ্রব্য শনাক্ত করতে সক্ষম হলেও মাদকদ্রব্য বিশেষ করে ইয়াবার মতো মাদক শনাক্ত করতে সক্ষম নয়। এসব মেশিনের মাধ্যমে মদের বোতল, বিয়ারসহ সহজে দৃশ্যমান বড় আকৃতির প্যাকেটজাত মাদক শনাক্ত করা সম্ভব।
বিমানবন্দরে মাদক শনাক্তের এই দুর্বলতার সুযোগে আকাশপথ ব্যবহার করে ইয়াবা বহনকারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। যাত্রীরা জুতোর ভেতর, পায়ুপথে ও স্টমাকেসহ নিত্যনতুন কৌশলে ইয়াবা পাচার করছে।
জানা যায়, পাচারের ক্ষেত্রে বাহক হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে প্রবাসী শ্রমিকদের পাশাপাশি নারীদের। প্রবাসী শ্রমিকরা বাড়ি আসার পর মাদক কারবারিরা তাদের সাথে যোগাযোগ করে। তাদের অর্থের লোভ দেখিয়ে মাদক পাচারে উদ্বুদ্ধ করে। নারীদের মাধ্যমেও পাচার করা হয় ইয়াবা।
শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ম্যানেজার উইং কমান্ডার সরওয়ার-ই জাহান বলেন, মাদক পাচার নিয়ে আমাদের জিরো টলারেন্স। কোনোভাবেই যাতে কেউ মাদক পাচার করতে না পারে সেজন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। বিমানবন্দরের অত্যাধুনিক ‘ডাবল ভিউ স্ক্যানিং’ মেশিনের মাধ্যমে ইয়াবা শনাক্ত করা হয়। ইয়াবা পাচারের সুযোগ কম।
বিমানবন্দরের বেবিচকের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, বিমানবন্দর দিয়ে মাদক পাচার নিয়ে আমাদের অবস্থান খুবই কঠোর। সে ব্যাপারে কোনোধরনের ছাড় নেই। কড়া নজরদারিতে রাখা হয় যাত্রীদের। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজনকে আটকও করা হয়েছে।
এদিকে ইয়াবা পাচাররোধে মধ্যপ্রাচ্যের আমিরাত, ওমানের বিমানবন্দরগুলোতে নেয়া হয়েছে কঠোর ব্যবস্থা। মাদক নিয়ে তাদের অবস্থান খুবই কঠোর। বিমানবন্দরে বাংলাদেশি যাত্রীদের জন্য রয়েছে আলাদা চেকিং ব্যবস্থা। দুবাই, আবুধাবি বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন পার হওয়ার পর লাগেজ নিয়ে বের হওয়ার আগে আবারো তল্লাশির মুখোমুখি পড়তে হচ্ছে। সেখানে রয়েছে পুলিশ ও বিশেষজ্ঞরা। তারা বাংলাদেশি যাত্রীদের লাগেজ, ব্যাগ খুলে তল্লাশি চালান। কোনো প্রকার ওষুধ দেখলেই জেরার মুখোমুখি হতে হয়। ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া কোনোধরনের ওষুধ পার করতে দেয়া হয় না। ইয়াবার মত কোনো ট্যাবলেট পেলেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, এমনকি আটকও করা হয়। আবুধাবি বিমানবন্দরে এক যাত্রীর কাছ থেকে ইয়াবা পাওয়ার পর তাকে জেলে পাঠানো হয়।
আমিরাতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ডা. মোহাম্মদ ইমরান বলেন, কিছু মাদক ব্যবসায়ীর কারণে পুরো বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হচ্ছে। বাংলাদেশের বিমানবন্দরে কঠোর ব্যবস্থা নিলে এখানে মাদক আসতে পারে না। তিনি বলেন, আমিরাত সরকার মাদক নিয়ে জিরো টলারেন্স। কঠোর শাস্তির বিধান আছে।
আবুধাবি বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি ইফতেখার হোসেন বাবুল ও সাধারণ সম্পাদক নাছির তালুকদার বলেন, মাদক ব্যবসায়ীদের কারণে আমাদের দেশের সুনাম মারাত্মকভাবে নষ্ট হচ্ছে। কিছু প্রবাসী শ্রমিককে লোভ দেখিয়ে মাদক বহন করা হচ্ছে। এসব মাদক ব্যবসায়ীর কারণে প্রবাসীরা প্রতিনিয়ত হেয় হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থ্ ানেয়া দরকার। নইলে এক সময় আমরাও টিকে থাকতে পারব না এদেশে। আবুধাবি যুবলীগের সভাপতি জাকির হোসেন জসিমও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তাদের কারণে আমাদেরও টিকে থাকা মুস্কিল হয়ে পড়েছে। কোনোভাবেই যাতে আকাশপথে ইয়াবা আসতে না পারে সেজন্য কঠোর পদক্ষেপ নেয়া দরকার।
জানা যায়, মধ্যপ্রাচ্য ও বাংলাদেশের দু’টি চক্র মাদক পাচারে জড়িত। দেশের চক্রটি পাঠায় আর দেশের চক্রটি সেখানে গ্রহণ করে। বাংলাদেশে একটি ট্যাবলেট ২০০-৩০০ টাকায় বিকিকিনি হলেও মধ্যপ্রাচ্যে ১০০০-১৫০০ টাকা বিক্রি হয় ।
ইয়াবার পাশাপাশি পাচার হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রাও। বিশেষ করে মার্কিন ডলার, সৌদি রিয়াল, মালয়েশিান রিঙ্গিত পাচার হচ্ছে।
অপরদিকে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে প্রতিনিয়ত অবৈধভাবে আসছে সোনা। দুবাই, আবুধাবি, ওমান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর থেকে এসব সোনা আসছে।
জানা যায়, গত এক বছরে ৫ মণ সোনা জব্দ করা হয়েছে। বিমানের টয়লেটে মিলেছে ১২ কেজি সোনা। সম্প্রতি সোয়া ১১ কেজি স্বর্ণসহ মো. শাহজাহান নামের এক যাত্রীকে আটক করেছে বিমানবন্দর কাস্টমস।
জানা যায়, মধ্যপ্রাচ্যের দুবাইয়ে রয়েছে বড় সিন্ডিকেট। তারা সবাই বাংলাদেশি। সেখানে তারা সোনার বার কিনে বাহকদের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয়।
ওমানসহ অন্যান্য দেশেও তাদের সিন্ডিকেট রয়েছে। বাহকরা ঘন ঘন সেসব দেশে আসা-যাওয়া করে। আসার সময় নির্দিষ্ট পরিমাণ সোনার বার তাদের ধরিয়ে দেয়া হয়। প্রতিটি বারের বিনিময়ে দেয়া হয় ৫০০ টাকা করে। বছরে তিন বা চার বার তারা আসা-যাওয়া করে। এছাড়া প্রবাসীরা বাড়ি আসার সময়ও সোনার বার ধরিয়ে দেয়। টাকার লোভে তারা সেগুলো বহন করে নিয়ে আসে।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের উপ কমিশনার মো. নূর উদ্দিন মিলন জানান, সোনা চোরাচালান নিয়ে ছাড় দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। বিমানবন্দরে সব লাগেজ, ব্যাগ সু²ভাবে তল্লাশি করা হয়। প্রতিটি যাত্রীর উপরই নজরদারি রাখা হয়। সন্দেহজনক যাত্রীদের দেহ তল্লাশি করা হয়। তিনি বলেন, স্বর্ণ আনলেও সেটা ধরা পড়ে যায়।