শামসুর রাহমান সর্বময় নাগরিক কবি

830

প্রতিটি শিল্পের আলাদা বৈচিত্র্য থাকে। প্রতিটি শিল্পীসত্তা ভিন্ন-ভিন্ন আঙ্গিকে নিজেকে উপস্থাপন করেন। কবিতাকে যখন একজন মানুষ ধারণ করেন তখন তিনি কতটুকু সুখ, দুঃখ, বেদনা, আশা, ভরসা ও দ্রোহের দাহ নিয়ে কোন্ সমুদ্রে সাঁতার বিস্তার করে একমাত্র সেই মানুষ ছাড়া আর কেউ বলতে পারে না। ঠিক সে সময় একজন মানুষ,সাধারণ থেকে অসাধারণ কবি হয়ে ওঠেন। মনোজগতে বিশাল একটু অনুভূতি দখল করে কোথায় হতে কোন সূদুরে পা বাড়ায় তার কোন হদিস থাকে না।কবিতা বহতা নদী। গ্রোত তার বহমান ছন্দ আর ভাব তার একান্ত নিজস্বতায় ঢেউয়ের সাথে সাথে ঢেউ খেলে। তাই কবির মন বহু ভূবনে পরিভ্রমণ করে। কবি মাত্রই ধ্যানী। ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় সত্তার অনুভবে জগতকে দেখেন।কবিতা একমাত্র অন্তরের উপলব্ধি। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন -অন্তর হতে আহরি বচন / আনন্দলোকে করি বিরচন /গীতরসাধারা করি সিঞ্চন / সংসার -ধূলিজালে। এমনভাবে অন্তর হতে আমি পেয়েছি এক অনন্য কবিতাজগত। যা পড়ে আমি ঋদ্ধ ও শুদ্ধ হই। যাকে পাঠ আত্মতৃপ্তির জন্য, আগামীতেও আমার অনুপ্রেরণার ফসল হয়ে থাকবেন তিনি কবি শামসুর রাহমান। অতি স¤প্রতি বাংলা সাহিত্যে এক আকাল পড়েছে। যেমন তরুণ লেখকদের পড়া ও জানার চেয়ে নিজেকে জাহির করতে খুব উদ্ধুদ্ধ। আজকের কাব্যভাবনা নিয়ে তরুণদের একধরনের উদাসীনতা আছে বলে মনে হচ্ছে। বিগত দশকের পর দশকে যারা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন তাদেরকে আমরা কতটুকু জানি বা পড়ি। অথচ আধুনিক হতে হতে এতটাই আধুনিক হলাম যে ঘরে – বসেই বিশ্বের সবকিছু হাতে পাওয়া যায়। ইমেল ও ইন্টারনেটে আমাদের সাহিত্যচর্চার দূরত্বটা একদম নেই বললেই চলে। তবুও আমাদের আগ্রহ কম।
বাংলা সাহিত্যের কবিতা পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে যেসব ভিন্ন-ভিন্ন চড়াই-উৎরাই ও ভাঙ্গনের খেলা চলছিল সেখান থেকে কবি শামসুর রাহমান কবিতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তাঁর নিজস্ব বলয়ে ।যখন তিনি সাহিত্য- চর্চায় ব্রত করেন, তখন তিনি ছিলেন একজন বাংলা সাহিত্যপ্রেমী উৎসাহ পাঠক। শুরু থেকে অন্তিমকাল পর্যন্ত আধুনিক অনুষঙ্গের – বিবর্তনের সচেতন উদ্দীপক ছিলেন। মূলত ত্রিশের দশকের আবেগ ও রোমান্টিক কাব্য যে রোষানলে পড়েছিল তার বিরুদ্ধে নতুন এক আশার শৈল্পিক সত্তা জাগিয়ে বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের সমান্তরালে দাঁড় করানোর প্রচেষ্টা শতভাগ সাফল্যমন্ডিত ও প্রশংসার উচ্চ আকাঙ্খার নাম। বাঙালি জাতির মুক্তিযুদ্ধ, সংগ্রাম, সামাজিক অবক্ষয়, বৃটিশ ও পশ্চিমা নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার এক অনন্য উদাহরণ কবি শামসুর রাহমান। দেশের বিপদকালে কলম ও মেধা দুটো সমানতালে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। তাই তাকে স্বাধীনতার কবি বলা হয়। তিনি অঙ্গীকারবদ্ধ একজন কবি। পৃথিবীর ইতিহাসে সাড়া জাগানো কাব্য জগত অর্থ্যাৎ ১৯৫৭ সালে ফ্রান্স কাব্য যেভাবে আধুনিকতার রূপ দিয়েছিলেন তা বিস্ময়কর। তারই ধারাবাহিকতায় ত্রিশ দশক রোমান্টিক কাব্যিকত্বতে নিবেদিত হয়ে বাংলা সাহিত্যকে বাংলা কবিতায় আধুনিকত্বে আবিষ্ট করেছেন। এখনো সেই অনুষঙ্গ, সেই রেষ ও সেই সুবাস এখনও আছে এবং থাকবে। তিনি বাংলা সাহিত্যে যা দিলেন তা যুগে যুগে বৃক্ষের মত ছায়া থাকবে। চিত্রকল্প, ছন্দ, তাল ,লয়,অভিব্যক্তি, উপমা ও বিষয় সবকিছু আধুনিক। সাহিত্যচর্চার উষাকালে বুদ্ধদেব বসু ও কবিতা পত্রিকা তখনকার সময়ে অনেকের কাছে লোভনীয় এক কাব্য – পত্রিকা। পঞ্চাশ দশকের কবিরা খুব লোভাতুর ভাবনায় উদগ্রীব হয়ে থাকতেন। বাংলা সাহিত্য সমালোচনা করলে বুঝা যায় যে – কবিতাপুরুষ বুদ্ধদেব বসু সম্পূর্ণ সাহিত্যে ভিন্ন মেরুর হয়ে বাংলা সাহিত্যকে তাঁর সোপানে আধুনিকতায় নিয়ে গেছেন। যেমন – বুদ্ধদেব বসু “কালের পুতুল” গ্রন্থ প্রতীয়মান। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের বাংলা সাহিত্যে নতুন বানান কৌশলে ত্রিশ দশককে অবমাননা না করেও তাকে অতিক্রম করা বড় দুরূহ ব্যাপার। কারণ আধুনিক বাংলা কবিতার গতানুগতিক ধারার বাইরে আরও একটি অধ্যায় নির্মাণে কালের কবিরা পিছিয়ে থাকতে রাজি নয়। সেটি পশ্চিমা কবিদের মধ্যে যেমন সত্যি তেমন পূর্ববঙ্গের কবিদের ক্ষেত্রেও সত্যি। ১৯৪৮ সালে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বাঙালি ছাত্ররা দারুণভাবে ক্ষুব্ধ হন। সে সময় অসাধারণ প্রতিবাদ ও চেতনা উদীপ্ত কবি শামসুর রাহমান তীব্রভাবে জ্বলে উঠেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে ছাত্রদের আত্মত্যাগ ও মর্মজ্বালার মধ্য দিয়ে অসা¤প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি ও দ্বিজাতিতত্তে¡র বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে বাঙালি জাতিসত্তার পরিচয় বহাল রাখে, সেক্ষেত্রে একজন তরুণ হিসেবে অসাধারণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তাই বাংলা কবিতার জন্য যেমনি আধুনিক সত্তা তেমনি বাংলা স্বাধীনতা জন্য অনন্য উদাহরণ।
তিনি একজন নাগরিক কবি। নগর জীবনে তিনি থাকতেন তা সে বিষয়ে নয়। তবে নগরের চালচিত্র, সভ্যতা, আধুনিকতা ও নাগরিক চেতনার বিষয়বস্তুকে তিনি যেভাবে তাঁর কবিতায় স্থান দিয়েছেন তাতেই পরিলক্ষ করা যায় যে তিনি একজন নাগরিক মূল্যবোধ সচেতন মানুষ ও কবি। কবি শামসুর রাহমান এক দেশ, রাষ্ট্র, নাগরিক সৌন্দর্য, দুঃখ, নিপীড়ন ও অসহায়ত্বের দৃঢ় উচ্চারণ। প্রবল প্রত্যয়ী ও দেশপ্রেমের আলাদা বৈশিষ্ট্য ধারণ করে নিজস্ব স্বকীয়তার বয়ানে সাহিত্য, শিল্প, ক্ষমতা ও সামাজিক প্রেক্ষাপটকে হাজির করেছেন তাঁর দুর্বোধ্য মূল্যায়নে। সামগ্রিক ও সামাজিক জীবনযাপনে উজ্জ্বল থেকে নিজেকে প্রমাণ করেছেন আলাদা কবিত্বের গুণাবলি দিয়ে গণতান্ত্রিক – সমাজতাত্তি¡ক মূল্যবোধের সুনিপুণ কাঠামো ও সৌন্দর্য অনিবার্য উপাদানে মিশিয়েছেন তাঁর কবিতার শরীরে ও আত্মায়। এ এক আশাবাদী ও সৌখিন মনোভাবের সরল মানুষের উদার চিন্তা।সাদামাঠা জীবন তবে তিনি মনোবলে আর্দশিক এক জীবন্ত সত্তা। রাজনৈতিক ধারাপাত বিবেচনা করলে তাঁকে বুঝা যায় যে – দেশের সংকটকালে অফুরন্ত অনুপ্রেরণা ও কবিতার সেøাগানে প্রতিবাদী মিছিল, যা সে সময়ে মানুষের জন্য অত্যন্ত সাহসী ও দীপ্ত চেতনা। ভাষা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের অসহযোগ বা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ – সব যুদ্ধে অসাধারণ কবিতা দিয়ে দেশের প্রতি ভক্তি দেখিয়েছেন। যেমন- তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা, স্বাধীনতা তুমি, বর্ণমালা, আসাদের শার্ট, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা, বর্ণমালা,র মতোন কবিতা লিখে বাংলাদেশের অবিস্মরণীয় কবি হয়ে ওঠেন। ১৯৬০ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ “প্রথম গান, দ্বিতীয় “মৃত্যু আগে” বের হয়। পঞ্চাশ দশকে তাঁর কবিতার অনেক সমালোচকেরা তাঁকে সম্ভাবনাময় কবি হিসেব চিহ্নিত করেছিলেন। তাঁর মধ্যে হায়াৎ মাহমুদ, হাসান হাফিজুর রহমান তাঁকে বেশ অভিবাদন জানিয়েছিলেন। তাঁদের মূল্যায়ন কাব্যগ্রন্থের মধ্যে” রূপালি স্নান,মনে মনে, আত্মজীবনী খসড়া, কাব্যতত্ত¡ এ একান্ত গোলাপের উক্তি এখনো উৎকৃষ্ট। বাংলাদেশের চিদাকাশে এ – কাব্যগ্রন্থ নিয়ে নতুন মাত্রা পেয়ে যান। তাঁর সতীর্থ সৈয়দ শামসুল হক এ প্রসঙ্গে বলেন “কবিতায় শামসুর রাহমান একজন শামসুর রাহমানই ; প্রথমদিকে তাঁর কবিতায় জীবনানন্দের কিছুটা আলো পড়লেও, কখনো তাঁর কবিতায় শেকড় হারায়নি। এই কবিতাগ্রন্থের “রূপালি স্নান” বা তাঁর শয্যার পাশে, ধরনের ও সময়ের কয়েকটি কবিতাবাদে – বুদ্ধ দেব বসু কবিতার প্রভাব প্রত্যক্ষ করি বটে; কিন্তু তিনি বাঁক ফেরেন ষাটের দশকের রাজনৈতিক – সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমেই। ষাটের দশকের সংগ্রামী ও দেশ চেতনার আশ্চর্য রূপকার হচ্ছে কবি শামসুর রাহমান। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও জীবনানন্দের পরে বাংলা সাহিত্যের আধুনিক অন্যতম প্রধান পুরুষ হলেন তিনি। তবে প্রথম কাব্যগ্রন্থ বের হওয়ার পর “নিরালোকের দিব্যরথ” (১৯৬৮) এ ব্যবধান আট বছর। ১৯৬৩ সালে দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ “রৌদ্র করোটি” এবং ১৯৬৭ সালে তৃতীয় প্রকাশিত হয়েছিল “বিধ্বস্ত নীলিমা”। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ও নিরালোকে দিব্যরথ ব্যবধানে তিঁনি অনুবাদ করেছিলেন রবার্ট ফ্রস্টের কবিতা। সদ্য প্রয়াত মুর্তজা বশীরের প্রচ্ছদে কবি শামসুর রাহমানের বই “নিজ বাসভূমে” বের হযেছিলো ১৯৭০ সালে। এই কাব্যগ্রন্থের মূল ভাষ্য ছিল এদেশের বিপন্ন মানুষ, তরুণ ও যুবাদের স্বপ্ন – আলোর দলিল। ১৯৬৯ সালে যুদ্ধের ময়দানে আসাদুজ্জামান ও কিশোর মতিউর রহমানকে পাকিস্তানিরা গুলি করে হত্যা করে। ঐ হত্যার কান্ড দেখে কবির ব্যথিত হযে “আসাদের শার্ট” লিখেন। এই কবিতা লেখার পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ২৭ মার্চ নয়াবাজারে অগ্নিসংযোগ করলে কবি বিচলিত শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যান। বেঁচে থাকার তাগিদে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে আশ্রয় পাতে। ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে বিজয় আসার পর ১৯৭২ – এ প্রকাশিত হলো বন্দী শিবির থেকে, ১৯৭৩ সালে – এ দুঃসময়ের মুখোমুখি, ১৯৭৪ – এ ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা, ১৯৬৯- এ গণ-অভ্যুন্থান ও ১৯৭৪- এ আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি। এই গ্রন্থগুলোতে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ের দিনলিপি ওঠে আসে।