শাপলাবিল-লালাখালের অপূর্ব শৈলীরূপ

153

সিলেট অঞ্চল বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পে অন্যতম প্রধান স্থান। এখানের বেশিরভাগ দৃষ্টিনন্দন এলাকা হাওর পরিবেষ্টিত। রাষ্ট্রীয়ভাবে আরো সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করলে সিলেট হয়ে উঠতে পারে দেশের অন্যতম প্রধান দর্শনীয় স্থান তাতে কোন সন্দেহ নেই। এ অঞ্চলের বেশিরভাগ স্থান দূর্গম এলাকায় হওয়ায় অধিকাংশ স্থানে আমার যাওয়া হয়নি। তবে যে সব স্থানে গিয়েছি তাতে আর বুঝতে বাকী রইলো না যে, সিলেট সম্পর্কে ধারণা নিতে। আমার এবারের গন্তব্য ছিল জৈন্তাপুরের ডিবির হাওর যেখানে হাজার হাজার লাল শাপলা দেখে মুগ্ধতায় পূর্ণ হলাম। এরপর লালাখাল জিরো পয়েন্ট, সারিঘাট, সারি ব্রিজ দেখতে দেখতে পুনরায় ফিরে এলাম জৈন্তাপুর বাস স্ট্যান্ডে। স্ট্যান্ডের পাশে রয়েছে ধ্বংসপ্রাপ্ত রাজবাড়ি। সেটিও ঘুরে ফিরে দেখলাম। রাজবাড়িতে এখন আছে শুধুমাত্র বিশাল চওড়ার দেয়ালখানি, আর প্রধান ফটকের ভাঙাচোরা কিছু স্মৃতি চিহ্ন। বড় বড় এই দেয়ালগুলোতে কোথাও লোহা লক্করের ছিটেফোঁটাও দেখা মিলেনি। রাজবাড়িটা দেখে মনেহল সরকারের প্রত্নতত্ব বিভাগের গাফিলতি রয়েছে। অন্তত একদশক আগেও যদি এটির যথাযথ সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হতো, তাহলে এই অঞ্চলের রাজা এবং রাজবাড়ি সম্পর্কে আরো বেশি ধারণা পাওয়া যেতো। এছাড়া যেটি করার কথা সেটির দিকেও ছিল প্রত্নতত্ব বিভাগ সম্পূর্ণ উদাসিন। একটু সদিচ্ছা থাকলে রাজবাড়ির গোড়াপত্তনের ইতিহাসটি তুলে ধরতে পারতো, এই সহজ কাজটিও তারা করেনি। আর আমার মতো যারা খুঁটিনাটি বিষয়-আষয় জানার বা লিখার চর্চায় যুক্ত তারাতো একটু বাড়তি হতাশায় ভোগে যেটি আমার মধ্যেও কমতি ছিল না। আশাকরি কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে আরো বেশি যত্নবান হবেন।
ইতিহাসের পাতায় উল্লেখ আছে ১৫০০-১৬০০ সালের দিকে বাংলাদেশের সিলেটের কিছু অংশ এবং ওপারে ভারতের আসাম-শিলং জুড়ে একসময় খাসিয়া সম্প্রদায়ের বেশ শক্ত অবস্থান ছিল। খাসিয়া রাজারা এই পুরো এলাকা শাসন করতো। প্রাচীন জৈন্তা রাজ্যের রাজধানী ছিল খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়ের নরতিয়াং নামক স্থানে। ১৬৮০ সালে রাজা লক্ষী নারায়ণ জৈন্তাপুর উপজেলার নিজপাট ইউনিয়নে এ রাজ্যের রাজধানী স্থাপন করেন। পরে খাসিয়ার নর্থিং পুঞ্জিতে রাজধানী স্থাপন করেন।
বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকা সিলেট জেলার জৈন্তাপুর উপজেলা। সিলেট শহর থেকে আমাদের প্রথম গন্তব্য জৈন্তাপুরের লাল শাপলা দেখা। এই লাল শাপলা দেখতে প্রতিদিন প্রচুর দর্শনার্থী সেখানে ভীড় করেন। আমাদের ভ্রমন দলটি ছিল আটজনের। ইঞ্জিনিয়ার সাজু, তাঁর মা, তাঁর সহধর্মিনী প্রিয়াংকা ও শ্যালিকা রুমকি। ইতিমধ্যে আরো কয়েকবার তাদের যাওয়া হয়। আমরা যেহেতেু দুরের মানুষ আমাদের আগ্রহের মাত্রাটি ছিল একটু বেশিই। আমি এবং আমার পরিবারের চার জনের এই প্রথম লাল শাপলার দেশে যাওয়া। সাজু, প্রিয়াংকা ও রুমকীর কাছ থেকে আগে থেকেই শুনেছি লাল শাপলার গল্প। এছাড়া ইল্কেট্রন্কি মিডিয়ার সুবাদেও কয়েকটি টিভি চ্যানেলে লাল শাপলার কথা জানতে পারি।
সিলেট শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দুরে জৈন্তাপুর উপজেলা। বাসে প্রায় দেড় ঘন্টার রাস্তা জৈন্তাপুর বাস স্ট্যান্ড বা জৈন্তাপুর বাজার। সেখান থেকে মাত্র দুই আড়াই কিলোমিটারের রাস্তা লাল শাপলা এলাকা। এটির নাম ডিবির হাওর। ১নং নিজপাট ইউনিয়নে এর অবস্থান। এর সামান্য পূর্বপাশে পাহাড় বেস্টিত ভারতের মেঘালয় রাজ্য। উঁচু-উঁচু পাহাড়। যেন মনেহলো আকাশ ছুঁেয় আছে। পাহাড়ের খাদে পাকা, আধা পাকা শত শত বাড়ি। প্রচুর গাছগাছলিতে ভরপুর হওয়ার কারনে বাড়ি গুলো কোনটি পুরো,কোনটি একটু-আধটু করে দেখা মিলছে। এখানে রয়েছে ভারতের মুক্তাপুর বাজার। বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের নিরাপত্তা চৌকি দেখলাম। কিন্তু কোন সদস্যদের দেখা গেলনা এমনকি ভারতীয় বিএসএফ সৈন্যদেরও। বডার গার্ড সদস্যদের নিরাপত্তা চৌকিকে সামান্য পিছনে রেখে কয়েকটি ছবি নিলাম। সীমান্ত এলাকায় দাড়িয়ে অপরুপ দৃশ্য উপভোগ করলাম আর মনে মনে দুঃখবোধ জাগ্রত হলো এই একটি বাধার কারণে। স্থানীয়রা জানান, সীমান্তবর্তী এলাকার জনগনের মধ্যে রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। তাই তারা কোন রকম বিভাদে জড়ান না। ভারতের ওপারে রয়েছে মেঘালয় রাজ্য। স্থানীয়রা জানান, জৈন্তাপুর বাজারের পান-সুপারি, আপেল-কমলা প্রসাধনী সামগ্রী থেকে ভারতের নানাকিছু সহজে পাওয়া যায়। সামান্য সীমান্ত রেখার কারণে চেনা দেশ, চেনা মানুষ অচেনা হয়ে গেল। কি এক অদ্ভুত ব্যাপার।
হাজার হাজার লাল শাপলার সাথে বেশ ঘন্টা খানিক মিতালি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো আমার ভ্রমণ দল। নৌকা ভাড়া করে শাপলার অপরুপ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করলাম। দেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে ডিবির হাওরের লাল শাপলা ফোটার দৃশ্য অবলোকন করতে ভিড় জমান ভ্রমন পিয়াসী দর্শণার্থীরা। একদিকে শাপলা দেখার আনন্দ, অন্যদিকে ভারতের পাহাড়ের খাদে জনবসতি ও তাদের অবস্থানের দৃশ্যে বিমোহিত নাহয়ে পারলামনা।
ভোর সকালে সিলেটের উপশহর এলাকা থেকে বের হয়ে গাড়ী যোগে যখন যাচ্ছিলাম তখন কুয়শার চাদরে ঢাকা ছিল। ১০ গজের মধ্যেও কিছু দেখা যাচ্ছে না। প্রচুর ঠান্ডা হাওয়া। গাড়িতে উঠে বসলাম তখন প্রায় পৌনে ৭টা। ক্ষণিকের মধ্যে বরফ হয়ে যাচ্ছিলাম। দ্রুত গতিতে আমাদের গাড়ি চলছে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। যতই সামনের দিকে এগোচ্ছি মনে হচ্ছে ঠান্ডা ততো বেড়ে চলছে। প্রচন্ড কুয়শার কারণে আশপাশ দেখার কোন জো নেই। ঘন্টা দেড়েক গাড়ি চলার পর আমরা জৈন্তাপুর পৌঁছলাম। গাড়ি থেকে নেমে নাস্তার পর্ব শেষ করে শাপলা দেখার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। টমটম যোগে আধঘন্টাও লাগেনি শাপলার স্থানে পৌঁছতে। তারপর একটি নৌকা ভাড়া করে শাপলার রাজ্যে নেমে পরলাম। নৌকা ওয়ালা একপাক ঘুরিয়ে এনে কুলে তুলে দিল এজন্য তাকে দিতে হলো ৩০০ টাকা। ওখানের সীমান্ত এলাকায় ঘন্টা দেড়েক অপরুপ দৃশ্যের রঙে সময় কাটিয়ে আবার ফিরে এলাম বাস স্ট্যান্ডে। এজন্য টমটম ড্রাইবার জয়নালকে দিতে হলো ৩০০ টাকা।
এবার গেলাম সাইট্রাস গবেষণা কেন্দ্রে। বাস স্ট্যান্ড থেকে এর দুরুত্ব রিক্শায় ৫ মিনিটের রাস্তা। সেখানে নানা প্রজাতির বৃক্ষ এবং ফল ফলাদি দেখে সবাই উল্লাসে মেতে উঠলো। ১২২ একরের বিশাল এলাকাজুড়ে গবেষণা কেন্দ্রটি বিস্তৃত। গবেষণা কেন্দ্রটি সর্বশেষ গিয়ে পৌঁছেছে ভারতীয় সীমান্ত পর্যন্ত। একে একে কমলা, বাতাবি লেবু, কামরাঙা,জাম্বুরা,জলপাই ধরে জুলি,উৎস,শুভ্র ছবি উঠতে ভূল করলোনা। কত রকমের যে টক জাতীয় ফল ও ফুলের গাছ এই গবেষণা কেন্দ্রে আছে তা এক কথায় বিস্মযকর। এছাড়া শিম, বেগুন মরিচসহ তরকারি উৎপাদনও হচ্ছে বেশ স্বচ্ছন্দে। আমার কাছে স্থানটি বেশ উপভোগ্য ছিল সেই সাথে ছেলেদেরকেও বিভিন্ন প্রজাতির ফলের সাথে পরিচয় করে দিতে পেরে ধন্য মনেহলো।
এবার আমাদের যাত্রা লালাখাল স্পট। উপজেলা সদর থেকে ৭/৮কিলোমিটার দুরে লালাখাল। ভারতের চেরাপুঞ্জি থেকে নেমে আসা নীল জলরাশির ঝর্নাধারা অবিরাম গড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশের লালাখালের বুকে। খালের দুই দিকের উঁচু পাহাড় গুলো মনে হচ্ছে যেন নীল আকাশের সাথে মিশে আছে। প্রকৃতির এই অভাবনীয় নিপুন দৃশ্য যে কাউকে বারে বারে টেনে নিয়ে যাবে। সূর্য্যের লুকোচুড়ি, আলো-আঁধারি খেলা আর নীল জলের মোহনীয় রুপে যে কেউ হারিয়ে যাবেন এত কোন সন্দেহ নেই। এরকম একটি স্পট যেতে পেরে নিজেকে সার্থক মনেহল। বর্ষাকালে এই খাল পানিতে ভরপুর থাকে। তখন পর্যটকদের জন্য নাকি বিপদ জনক। শীতকালেই এই স্থানটি ভ্রমনের উপযুক্ত সময়। লালা খালের জিরো পয়েন্টে উৎস, শুভ্র, জুলি ও প্রিয়াংকা পানিতে নেমে আনন্দের মাত্রাটা আরো বাড়িয়ে দিলো। কোথাও হাটু, কোথাও কোমড় সম পানিতে নেমে পর্যটকদের উল্লাস বেশ ভালোই উপভোগ্য। আর এরি ফাঁকে রামাঞ্চকর মুহুর্তগুলোর সব দৃশ্য কৌশলে ক্যামেরায় বন্দি করে নিলেন আমাদের দলের রুমকি। রুমকিকে ধন্যবাদ দিতেই হয় তার এই যন্ত্র যদি সেদিন না থাকতো তাহলে আমরা অনেক কিছু থেকেই হারিয়ে যেতাম। আর রুমকি ও তার বোনের জামাইর খুনসুটি উপভোগ করতে করতে পুরো একটি দিন দারুনভাবে উপভোগ করলাম। লালাখাল থেকে যখন সদরে ফিরে আসি তখন ঘরির কাঁটায় ৪ টা। ক্ষিদে সবার পেট চোঁ চোঁ করছে। ঢুকলাম সকালে নাস্তা খাওয়া জৈন্তা রেস্টুরেন্টে। অর্ডার দিতেই গরম গরম ভাত তরকারি হাজির। সেখানকার ছোট মাছের তরকারি কিযে টেস্টি আমি না খেলেও অন্যদের খাওয়া দেখে বুঝতে বাকী রইলোনা। সেই সাথে নানা প্রকারের ভাজি ও ভর্তার ছিল অন্যরকম স্বাধ। খাবারের তৃপ্তিতে মুগ্ধ হয়ে টাকাটি পরিশোধ করলো আমার সহধর্মিনী জুলি বড়ুয়া। উপজেলা সদর থেকে লালাখাল টমটম গাড়িতে যাওয়া-আসার ভাড়া গুনতে হয় ৫০০ টাকার মত। নৌকা ভ্রমনের জন্য ঘন্টা হিসেবে দিতে হয় ৫০০/৬০০ টাকা।
ভ্রমণ দলের দলনেতা ইঞ্জিনিয়ার সাজু বড়ুয়া যেহেতু সিলেটে বেড়ে উঠেছে সেহেতু তিনি অনর্গল সিলেটি ভাষা বলতে পারেন। শিক্ষা জীবন-কর্ম জীবন দুটো’ই পার করে চলেছেন সিলেটে। এ কারণে আমাদের ঘুরতে তেমন বেগ পেতে হয়নি। আর পথ-ঘাট চিন্তে কোন ধরনের সমস্যা হয়নি। তবে এসব জায়গা ঘুরে একটি বিষয় জ্ঞাত হলাম যাতায়তের ক্ষেত্রে ঢাকা, চট্টগ্রাম কিংবা দেশের অন্যান্য স্থানে চালকরা যেভাবে গাড়ি ভাড়ার ক্ষেত্রে হেনস্থা করে সেটি কিন্তু সিলেটে চোখে পড়েনি। শুধুমাত্র ভাষাটিই হচ্ছে সিলেটের প্রধান সমস্যা। আর ভাষা জানলে তো কথাই নেই। অল্প ব্যয়ে আপনি পরিভ্রমণ করতে পারবেন।