শহুরে কর্পোরেট কালচারে গ্রামীণ ঐতিহ্য ম্লান

69

আজ বাঙালির প্রাণের উৎসব নববর্ষ। স্বাগত ১৪২৬। ধর্ম-বর্ণ ছাড়িয়ে সমতল ও পাহাড়ে যুগপদ উৎসবের নাম পহেলা বৈশাখ। আর এই আয়োজনে সবাই অংশ নেন প্রাণের টানে। থাকে না কোন বিশাল বাজেট? তারপরও এটি প্রাণপ্রাচুর্য আর বর্ণিল আয়োজনে সবচেয়ে বড় অসা¤প্রদায়িক ও সার্বজনীন উৎসব। বাংলা বর্ষবরণের এই উৎসব শহর থেকে গ্রামে সবখানেই নানা আয়োজনে বাঙালি জাতিয়তাবাদে বিশ্বাসী মানুষের প্রাণের টানে এক মহাউৎসবে পরিণত হয়। সময়ের সাথে ব্যপ্তি বেড়েছে এই উৎসবের, তবে শহুরে কর্পোরেট কালচারে ম্লান হয়েছে গ্রামীন ঐতিহ্য।
পুরনো জীর্ণতা মুছে নতুন উদ্যমে নিজেকে উজ্জ্বীবিত করতে নতুন বছরকে বরণ করতে মেতে উঠে বাঙালি। দিনব্যাপী শহরজুড়ে বিরাজ করে উৎসবমুখর পরিবেশ। তবে বর্ষবরণ এসেছে গ্রাম থেকে। যেখানে বাঙালির ঐতিহ্যের সবকটি শেকড়ের শেষ ঠিকানা। যেখানে বৈশাখ মানেই ছিল দেশজুড়ে গ্রামীণ মেলার হাট। এটি একটি সর্বজনীন লোকজ উৎসব। সংাস্কৃতিক ঐতিহ্যেগুলোর একটি। চৈত্রের শেষ দিনে কৃষকরা জমিদারদের কাছে খাজনা পরিশোধ করতেন।
এ উপলক্ষে তখন মেলা বসতো। বিবর্তনের ধারায় সেটাই হয়েছে বৈশাখী মেলা। এই মেলায় বিচিত্র পণ্যে সমাগম ঘটত। নানা রকম মিষ্টান্ন, ভেঁপু, বাঁশি, টেপা পুতুল, চুড়ি, ফিতা, লুঙ্গি, গামছা, শাড়ি, চরকি, বেলুন, কাগজের ফুলসহ স্থানীয় বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী হরেক রকম পণ্য। মুড়ি, মুড়কি কিংবা বাতাসা এই মেলার বড় অনুষঙ্গ। গৃহস্থালীর নিত্য ব্যবহারের জিনিস যেমর ওঠে, শিশু-কিশোরদের হরেক খেলনারও পসরা বসব বৈশাখী মেলায়। নতুন বছরে নতুন পোশাক ছাড়াও বাড়ি বাড়ি মিলত সবজি আর দানার মিশ্রিত খাবার ‘পাচন’। চৈত্রের শেষে ফসলি জমিগুলো হয়ে উঠত খেলার মাঠ। দিন শেষে রাতজুড়ে চলত গ্রামীণ ঐতিহ্যের সাথে গেঁথে থাকা হা-ডু-ডু, লাঠিখেলা, কাবাডি, দাড়িয়াবাঁধা, গোল্লাছুট, পলানটুকসহ হরেক খেলা। পাড়ায় পাড়ায় চলত সে প্রতিযোগিতা। উৎসবগুলোর সাথে জড়িয়ে আছে এই জনপদের প্রাচীন জীবনাচার, অর্থনৈতিক, আর্থিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। নাগরদোলা, বায়োস্কোপের আয়োজন থাকে। ব্যবসায়ীরা পুরনো হিসেব মিটিয়ে খুলত নতুন হালখাতা। এ উপলক্ষে চলত মিষ্টি আর বাতাসা মুখে বাঙালির শুভেচ্ছা বিনিময়।
বৈশাখ শুরু হওয়ার আগে থেকে চলত গ্রামজুড়ে মাইকিং। ‘গরুর লড়াই, বলীখেলার আবহ তৈরি হত বাঙালির হৃদয়জুড়ে। কবে পহেলা বৈশাখ আসবে? নতুন লুঙ্গী আর গামছা গায়ে মাঠের কোণায় দাঁড়িয়ে বলীর খসরত দেখে চোখ দুটো জুড়াবে। পাহাড়ের পাদদেশে খালি ফসলি জমিতে বসত ‘গরুর লড়াই ও বলীখেলা’। বিভিন্ন গ্রাম থেকে মানুষ ছুঁটে আসত বিনোদনের অন্যতম অনুষঙ্গ সে খেলা উপভোগ করতে।
বদলেছে মানুষের জীবনযাত্রা। এগিয়েছে দেশ বহুদূর। সময়ের এ মধ্যখানে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে প্রাণের উৎসব নববর্ষ উদযাপনেও। তবে ব্যাপ্তি বেড়েছে অনেকগুণ। গ্রাম-শহর ছাড়িয়ে নতুন বাংলা বর্ষ বরণ করা হয় পৃথিবীর অনেকের দেশের বুকে। যেখানে বাঙালি জাতীয়তাবাদী মানুষের বসবাস, সেখানেই রঙে রঙিন হয়ে বর্ষবরণ চলছে। এতে করে সারাবিশ্ব ছড়িয়ে যাচ্ছে প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর বাঙাল সংস্কৃতি। সময়ের বিবর্তনে বৈশাখী মেলাগুলোতে পরিবর্তন এসেছে। নগরের মেলায় হাতে তৈরি মাটির খেলনা বিরল। জায়গা করে নিয়েছে প্লাস্টিক কিংবা ধাতব পণ্য। ঐতিহ্যের চেয়ে বাণিজ্য মূখ্য যেন। আসছে বৈশাখে চট্টগ্রামের নানা জায়গায় জমবে মেলা। মেলার বিবর্তনকে স্বাভাবিক দেখেন বিশেষজ্ঞরা। তবে গ্রামীণ আবহে এই মেলাকে বাঁচিয়ে রাখার পরামর্শ তাদের। বাংলা ও বাঙালি কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের বৈশাখী মেলা বিশ্ব সংস্কৃতিতে নিজের অবস্থান তৈরি করবে এক সময়, এমন আকাক্সক্ষা সংশ্লিষ্টদের।
নববর্ষ উদযাপনে গ্রামীণ ঐতিহ্যকে ধরে রাখার আহবান জানিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সমাজবিজ্ঞানী ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, পহেলা বৈশাখ বাঙালি জাতিয়তাবাদের স্মারক। পাকিস্তান আমল থেকে বাঙালিপনার ধারক হিসেবে নববর্ষ পালিত হয়ে আসছে। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এই জাতিয়তাবাদ মনে দেশপ্রেমের জোয়ার এনেছিল। তারই ধারাবাহিকতায় বাঙালি নতুন বছরকে বরণ করে সর্বজনীন উৎসবে মেতে উঠে। কর্পোরেট হয়েছে সেটা সত্য, তবে এখনও ভিনদেশি সংস্কৃতিমুক্তভাবে উৎসবটি পালিত হচ্ছে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে নিজেদের ঐতিহ্যগত স্বকীয়রতা রক্ষার্থে গ্রামীণ ঐতিহ্যকে লালন করা প্রয়োজন।
পহেলা বৈশাখ যেভাবে বাঙালির প্রাণের উৎসব :ধারণা করা হয়, সম্রাট আকবরের আমলে বাংলা সন প্রবর্তন হলে চৈত্রের শেষ দিনে কৃষকরা জমিদারদের কাছে খাজনা পরিশোধ করতেন। এ উপলক্ষে তখন মেলা বসতো। বিবর্তনের ধারায় সেটাই হয়েছে বৈশাখী মেলা। বাংলা সন যখন থেকে শুরু হয়, তখন থেকেই হয়ত গ্রামে কোথাও কোথাও এটা উদযাপন হতো। তবে তখন উদযাপনের ধরন ভিন্ন ছিল। গ্রামে তখন ছেলে-মেয়েরা খেলনা কিনতো। জিলাপি বিক্রি হতো? মেলার সঙ্গে কিছু খেলাধূলাও ছিল। অনেক জায়গায় জুয়া খেলা হতো। ঢাকা শহরে প্রথম পহেলা বৈশাখ শুরু হয় ১৯৬৮ বা ১৯৭০ সাল থেকে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি প্রথম এটা উদযাপন করে? তখন ছয় দফার ধারাবাহিকতায় বাঙালি জাতীয়তাবাদ অত্যন্ত প্রবল ছিল? শিক্ষক সমিতির পাশাপাশি রাজধানীর ছায়ানটেও প্রায় একই সময়ে পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়? তখন মূল কথা হয়ে উঠেছিল, আমরা পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী নই, আমরা বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। এ কারণে পহেলা বৈশাখে আলোচনাসভা, কোথাও কোথাও গানের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। দেশ স্বাধীনের পর এটা ভিন্ন রূপ পায়। ছায়ানট রমনার বটম‚লে অনুষ্ঠান শুরু করে? একই সঙ্গে ইলিশ মাছের তরকারি দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়াসহ অনুষ্ঠানগুলো শুরু হয়ে যায়। রমনা বটমূল থেকেই মূলত কর্পোরেট বা বৈশাখ উদযাপনের ফরমাল কালচার। উৎসবটা তখন প্রদর্শনীয় মতো হয়ে গেল। ফলে দেশের রাজনীতিক অংশের একটি অংশ বলছে, পহেলা বৈশাখ যেভাবে উদযাপন হচ্ছে, সেটা ঠিক নয়? গ্রামাঞ্চলে যেভাবে হতো, সেভাবে হলেই ঠিক হতো বলে মনে করছেন ঐতিহ্য বিশ্লেষকরা।
১৯৮০-র দশকে যখন এরশাদবিরোধী আন্দোলন চলছিল, তখন পহেলা বৈশাখ বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতীক হিসেবে আওয়ামী লীগ এটাকে সামনে আনতে চাইছিল। তখন চারুকলা বিভাগ থেকে মুখোশ পরা, মঙ্গল শোভাযাত্রার অনুষ্ঠান শুরু হয়। যখন জিয়াউর রহমান বা তারপর এরশাদ ক্ষমতায় এলো, তখন পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানের উৎসাহ কমে গিয়েছিল। তখন আওয়ামী লীগ পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানকে খুবই গুরুত্বপ‚র্ণ হিসেবে নেয়। তারা তখন অনুষ্ঠান করতে থাকে। এরপর পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান নিয়ে একটা অংশ বলছে, এটা একামাত্র ধর্মনিরপেক্ষ অনুষ্ঠান। তবে এ প্রজন্মের কাছে ধর্ম-বর্ণ ছাড়িয়ে সার্বজনীন অনুষ্ঠান হিসেবে সমাদৃত।
এ বিষয়ে জুনিয়র চেম্বার চট্টগ্রাম কসমোপলিটানের সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী এসএম ইশতিয়াক উর রহমান পূর্বদেশকে বলেন, এখন সময় তথ্য প্রযুক্তির। বিশ্বায়নের এ সময়ে সহজে আদান প্রদান হচ্ছে তথ্য আর সংস্কৃতির। ফলে আমাদের মাঝে মিশে যাচ্ছে ভিনদেশি সংস্কৃতি। তাছাড়া এখন চাইলেও ঐতিহ্যের সে গ্রামীণ জীবনে ফিরে যাওয়া সম্ভব না। ফলে বর্তমানের সময়ে তাল মিলিয়ে ভিনদেশি সংস্কৃতি যাতে মিশে যেতে না পারে, তা নিশ্চিত করে আমাদেরকে বৈশাখ উদযাপন করতে হবে। আগের মত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংখ্য মেলা ছাড়িয়ে এখন বড় বড় মেলা হয়। তাছাড়া শহরজুড়ে থাকে কর্পোরেট আয়োজন। সে আয়োজনের সাথে মিতালী হয়ে উদযাপিত হয় আমাদের বৈশাখ।
পহেলা বৈশাখের সাথে ইলিশ-পান্তা ভাতের সম্পর্ক : বিশ্লেষকরা বলছেন, শহরের ভদ্রলোকেরা ৭২ সাল থেকে এটা আরম্ভ করেন? গ্রামাঞ্চলে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা মেলা করেছে? সেখানে পান্তা ভাত বা ইলিশ মাছ খাওয়ার বিলাসিতা ছিল না। পহেলা বৈশাখ ঘিরে মূলত বাড়িতে বাড়িতে পাচন বা গন্ড রান্না করা হত। কয়েক রকম সবজি আর দানার মিশ্রণে রান্না হত এ খাবার। স্বাধীনতা পরবর্তী খাবারের ফরমালিটি রক্ষা করতে গিয়ে হুট করেই পান্তা-ইলিশের আবির্ভাব।