শহীদ শেখ রাসেলের ৫৭তম জন্মদিনে হৃদয়ের ভালোবাসা

57

মো. আবদুর রহিম

শেখ রাসেল বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব এর কনিষ্ঠপুত্র। ১৮ অক্টোবর শহীদ শেখ রাসেলের জন্মদিন। ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর ধানমন্ডিস্থ বঙ্গবন্ধু ভবনে তাঁর জন্ম। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মানবতার শত্রæ ঘৃণ্য ঘাতকদের নির্মম বুলেটের হাত থেকে রক্ষা পাননি বঙ্গবন্ধু’র এ শিশুপুত্র শেখ রাসেল। ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের ৪র্থ শ্রেণির দূরন্তপ্রাণ এই শিশু তার পিতা বঙ্গবন্ধু’র রাষ্ট্র পরিচালনা ও রাজনৈতিক জীবনকে দেখতে শুরু করেছিলেন মাত্র। জাতির পিতা বাবার বুকের গভীরে মুখ রেখে সাহস আর বীরত্বের উষ্ণতা নেয়ার সময়ে নরঘাতকদের দল তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ছোট্ট রাসেলকে মা, বাবা, ভাই, ভাবী ও চাচা সকলের লাশের পাশ দিয়ে হাঁটিয়ে নেন ঘাতক দল। তখন সে বারবারই বলেছিল, ‘মায়ের কাছে যাবো।’ মায়ের কাছে নেওয়ার নাম করেই হত্যা করা হয় শিশু রাসলেকে। বাংলার প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা তাঁর লেখা ‘আমাদের ছোট্ট রাসেল সোনা’ শিরোনামে এক প্রবন্ধে তিনি লিখেন, ‘১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি আব্বা ফিরে এলেন বন্দীখানা থেকে মুক্তি পেয়ে। আমার দাদা রাসেলকে নিয়ে এয়ারপোর্টে গেলেন আব্বাকে আনতে। লাখো মানুষের ঢল নেমেছিল সেদিন, আব্বা প্রথম গেলেন তার প্রিয় মানুষের কাছে। এরপর এলেন বাড়িতে। আমরা সামনের বড় বাড়িটায় উঠলাম। ছোট্ট যে বাসাটায় বন্দী ছিলাম সে বাসাটা দেশ-বিদেশ থেকে সব সময় সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার আসত আর ছবি নিত। মাত্র দুটো কামরা ছিল। আব্বার থাকার মতো জায়গা ছিল না এবং কোনো ফার্নিচারও ছিল না। যা হোক, সবকিছু তড়িগড়ি করে জোগাড় করা হলো। রাসেলের সব থেকে আনন্দের দিন এলো সেদিন আব্বা ফিরে এলেন। এক মুহ‚র্ত যেন আব্বাকে কাছ ছাড়া করতে চাইত না। সবসময় আব্বার পাশে পাশে ঘুরে বেড়াত। ওর জন্য ইতোমধ্যে অনেক খেলনাও আনা হয়েছে। ছোট সাইকেলও এনেছে, কিন্তু কিছুক্ষণ পরপরই ও আব্বার কাছে চলে যেত। ফেব্রæয়ারি মাসে আমরা ৩২ নম্বর সড়কে আমাদের বাসায় ফিরে এলাম। বাসাটা মেরামত করা হয়েছে। রাসেলের মুখে হাসি সারাদিন খেলা নিয়ে ব্যস্ত। এর মাঝে গণভবনও মেরামত করা হয়েছে। পুরনো গণভবন বর্তমান সুগন্ধাকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার হতো। এবার গণভবন ও তার পাশেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কার্যক্রম শুরু করা হলো। গণভবন প্রধানমন্ত্রীর সরকার বাসস্থান আর এর পাশেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, ভেতর থেকে রাস্তা ছিল, হেঁটেই কার্যালয়ের যাওয়া যেত। আব্বা প্রতিদিন সকালে অফিসে আসতেন, দুপুরে গণভবনে বিশ্রাম নিতেন, এখানেই খাবার খেতেন। বিকেলে হাঁটতেন আর এখানেই অফিস করতেন। রাসেল প্রতিদিন বিকেলে গণভবনে আসত। তার সাইকেলটাও সাথে আনত। রাসেলের মাছ ধরার খুব শখ ছিল। কিন্তু মাছ ধরে আবার ছেড়ে দিত। মাছ ধরবে আর ছাড়বে এটাই তার খেলা ছিল। একবার আমরা সবাই মিলে উত্তরা গণভবন নাটোর যাই। সেখানেও সারাদিন মাছ ধরতেই ব্যস্ত থাকত। রাসেল ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি স্কুলে ভর্তি হয়। তবে স্কুলে যেতে মাঝে মধ্যেই আপত্তি জানত। তখন সে যাকে সাথে চাইবে তাকেই পাঠাতে হতো। বাসায় পড়ার জন্য টিচার ছিল। কিন্তু আমরা ছোটবেলা থেকে যে শিক্ষকের কাছে পড়েছি তার কাছে পড়বে না। তখনও স্কুলে ভর্তি হয়নি, এটা স্বাধীনতার আগের ঘটনা, তার পছন্দ ছিল ওমর আলীকে। বগুড়ায় বাড়ি। দি পিপল পত্রিকার অ্যাডে কণ্ঠ দিয়েছিল, টেলিভিশনের ইংরেজি খবর পড়ত। মাঝে মধ্যে আমাদের বাসায় আসত, তখন রাসেলের জন্য অনেক ‘কমিক’ বই নিয়ে আসত এবং পড়ে শোনাত। যা হোক, স্বাধীনতার পরে একজন ভদ্র মহিলা রাসেলের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলো। রাসেলকে পড়ানো খুব সহজ ছিল না। শিক্ষককে তার কথাই শুনতে হতো। প্রতিদিন শিক্ষয়িত্রীকে দুটো করে মিষ্টি খেতে হবে। আর এ মিষ্টি না খেলে সে পড়বে না। কাজেই শিক্ষিকাকে খেতেই হতো। তাছাড়া সব সময় তার লক্ষ্য থাকত শিক্ষিকার যেন কোনো অসুবিধা না হয়। মানুষকে আপ্যাায়ন করতে খুবই পছন্দ করত। … ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে কামাল ও জামালের বিয়ে হয়। হলুদ ও বিয়ের অনুষ্ঠানে আমরা অনেক মজা করি। বাইরে চাকচিক্য বেশি ছিল না কিন্তু ভেতরে আমরা আত্মীয়স্বজন মিলে খুব আনন্দ করি। বিশেষ করে হলুদের দিন সবাই খুব রং খেলে। রাসেল ওর সমবয়সীদের সাথে মিলে রং খেলে। বিয়ের সময় দুই ভাইয়ের পাশেই থাকে। দুই ভাইয়ের বিয়ে কাছাকাছি সময়ই হয়। কামালের ১৯৭৫ সালের ১৪ জুলাই আর জামালের ১৭ জুলাই বিয়ে হয়। সব সময় ভাবীদের পাশে ঘুরঘুর করত, কার কী লাগবে খুব খেয়াল রাখত। ৩০ জুলাই আমি জার্মানিতে স্বামীর কর্মস্থলে যাই। রাসেলের খুব মন খারাপ ছিল। কারণ জয়ের সাথে একসাথে খেলত। সব থেকে মজা করত যখন রাসেল জয়ের কাছ থেকে কোনো খেলনা নিতে চাইত তখন জয়কে চকলেট দিত। তবে চকলেট পেয়ে জয় হাতের খেলনা দিয়ে দিত, বিশেষ করে গাড়ি। রাসেল গাড়ি নিয়ে খেলত, জয়ের যেই চকলেট খাওয়া শেষ হয়ে যেত তখন বলত চকলেট শেষ, গাড়ি ফেরত দাও। তখন রাসেল আবার বলত, চকলেট ফেরত দাও, গাড়ি ফেরত দিব। এই নিয়ে মাঝে মধ্যে দু’জনের মধ্যে ঝগড়া লেগে যেত, কান্নাকাটি শুরু হতো। মা সব সময় আবার জয়ের পক্ষ নিতেন। রাসেল খুব মজাই পেত। পুতুলের খেলার জন্য একটা ছোট্ট খেলনা পুতুল ও প্রাম ছিল, ওই প্রাম থেকে খেলার পুতুল সরিয়ে পুতুলকে বসিয়ে ঠেলে নিয়ে বেড়াত। পুতুল এত ছোট ছিল যে, খেলার প্রামে ভালোই বসে থাকত। রাসেল খুব মজা করে জয়-পুতুলকে নিয়ে খেলত। আমি জার্মানি যাওয়ার সময় রেহানাকে আমার সাথে নিয়ে যাই। রাসেলকে সাথে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু ওর হঠাৎ জÐিস হয়, শরীর খারাপ হয়ে পড়ে। সে কারণে মা তাকে আর আমাদের সাথে যেতে দেননি। রাসেলকে যদি সেদিন আমাদের সাথে নিয়ে যেতে পারতাম তাহলে ওকে আর হারাতে হতো না।’
“সবচেয়ে যে শেষে এসেছিল, সেই গিয়েছে সবার আগে সরে
ছোট্ট যে জন ছিলরে সবচেয়ে সেই গিয়েছে সকল শূন্য করে।”
প্রতিদিনের মতো সেই কালরাতে ঘুমিয়ে ছিল ১০ বছরের ছোট্ট শিশু রাসেল। আকষ্মিক গুলির বীভৎসতায় তার ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভাঙা চোখ নিয়ে সে আতঙ্কিত হয়, চমকে ওঠে। অবস্থা বুঝে আদরের দুলাল রাসেলকে রক্ষায় কাজের লোকসহ পেছনের দরজা দিয়ে চলে যেতে বলেন বেগম মুজিব। গেট দিয়ে বাইরে যাওয়ার সময় ঘাতকরা তাকে আটক করে। এ সময় বাড়ির ভেতরে মুহুর্মুহু বুলেটের শব্দ আর বীভৎস আত্মচিৎকার শুনে অবুঝ শিশু রাসেল কান্নাজড়িত কণ্ঠে ঘাতকদের বলেছিল, ‘আমি মায়ের কাছে যাব।’ তার আকুতিতে পরাজিত ঘৃণ্য নরপিশাচদের এতটুকুও মন গলেনি। আগেই বঙ্গবন্ধু সহ পরিবারের সকল সদস্যকে পৈশাচিক কায়দায় হত্যা করেছে। সবশেষে মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ফুলের মতো সুন্দর ও অবুঝ শিশু শেখ রাসেলকেও গুলি করে হত্যা করে।
শহীদ শেখ রাসেল আজ বাংলাদেশের শিশু-কিশোর, তরুণ ও শুভবুদ্ধিবোধসম্পন্ন মানুষের কাছে পরম ভালোবাসার নাম। ৫৭তম জন্মদিনে অমর শিশু শেখ রাসেল সবার হৃদয়ের মণিকোটায় থাকবে অনন্তকাল। তাঁর শুভ জন্মদিনে আমাদের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা তাঁর স্মৃতির প্রতি, আর ধিক্কার ঘাতকদের।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চারনেতা স্মৃতি পরিষদ