শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

44

আগামীকাল ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। আমাদের জাতীয় জীবনে অন্যতম শোকাবহ ও বেদনাদায়ক দিন। এ দিন পাকিস্তানি হায়েনা ও এ দেশীয় দোসররা মিলে জাতির মেধাবী সন্তানদের অত্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা করে । স্বাধীনতার সূর্যোদয়ের মাত্র ৪৮ ঘণ্টা আগে সংঘটিত এ হত্যাকাÐ ছিল ঠাÐা মাথায় একটি পরিকল্পিত হত্যাকাÐ। সবচেয়ে বড় দুঃখ ও লজ্জার বিষয় এ হত্যাকান্ডে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেছিল এ দেশের মানুষরূপী কিছু দানব। রাজাকার, আল বদর, আল শামস নামের এসব দানবীয় সংগঠন যারা এ দেশের খেয়ে এ দেশের পরে নিজের দেশকে কানা করার কাজে লিপ্ত হয়েছিল। শুধু তাই নয় স্বাধীনতার ঊনপঞ্চাশ বছর পার হলেও এসব ঘরের শত্রæ বিভীষণদের অবাধ বিচরণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। যা দেশ ও জাতির জন্য যেমন দুর্ভাগ্যের তেমনি ত্রিশ লক্ষ শহীদের আত্মার জন্যও রীতিমত অপমানজনক।
বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পরিকল্পনাটি কিন্তু তৈরি হয়েছিল অনেক আগেই। পাকিস্তানি হায়েনারা ভালো করেই জানত বাঙালিদের বেশিদিন দমিয়ে রাখা যাবে না। কারণ যারা জীবন দিতে তৈরি তারা স্বাধীনতার স্পর্শ ছাড়া কখনো ঘরে ফিরে যাবে না। তাই পাকিস্তানি হায়েনারা জাতির মেরুদÐ ভেঙ্গে দেওয়ার যাবতীয় আয়োজন সম্পন্ন করে রেখেছিল। যাতে দেশটি স্বাধীনতা লাভ করলেও মেধাবী সন্তানের অভাবে তার অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়। সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে তারা প্রণয়ন করেছিল একটি বøু-প্রিন্ট। একটি ঘর দাঁড়িয়ে থাকে তার খুঁটির উপর। পাকা দালান বা সেতু দাঁড়িয়ে থাকে তার পিলার বা স্তম্ভের উপর। তেমনি একটি জাতির সম্পদ তার মেধাবী সন্তানেরা। তাঁরা তাঁদের মেধা দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে, গঠনমূলক পরামর্শ দিয়ে একটি জাতির আত্মিক উন্নয়নের পাশাপাশি দেশ পরিচালনায় রাখে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। এ কারণে পৃথিবীর প্রতিটি দেশে মেধাবী সন্তানদের জাতির বিবেক বলা হয়।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানি হায়েনারা অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর। সে সময় থেকেই শুরু হয় ঠাÐা মাথায় পরিকল্পিত হত্যাকাÐ। ২৫ মার্চ গভীর রাতে তারা আক্রমণ চালায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলে এবং শিক্ষকদের বাড়িতে। প্রচÐ গোলাগুলির আওয়াজ শুনে কোরআন পাঠ করতে বসেছিলেন বিজ্ঞানের অধ্যাপক এম মুনিরুজ্জামান। এ অবস্থা থেকেই তাঁকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায় পাকিস্তানি হায়েনারা।
একই বাড়ির নিচের তলা থেকে তারা ধরে নিয়ে যায় ইংরেজির খ্যাতিমান অধ্যাপক জ্যোতিময় গুহ ঠাকুরতাকে। পাশের বাড়ি থেকে নিয়ে যায় দর্শনের অধ্যাপক ড. গোবিন্দ্র চন্দ্র দেবকে। এই তিনজন শিক্ষককে সে রাতেই হত্যা করা হয়। সে রাতেই পাকিস্তানি হায়েনাদের হাতে শহীদ হন প্রতিভাবান সাহিত্যিক, সাংবাদিক শহীদ সাবের, সম্পাদিকা সেলিনা পারভিন ও প্রতিভাময়ী কবি মেহেরুন্নেসা -যিনি মাত্র পঁচিশ বছর পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন।
ঢাকাসহ সারা দেশে মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় ধরে চলে এমন বর্বরোচিত হত্যার ঘটনা। এ নির্মমতার শিকার হন প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। এ প্রতিভাবান ব্যক্তিত্বই ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে প্রথম বাংলা ভাষাকে র্ষ্ট্রাভাষা করার দাবি জানিয়েছিলেন। ৮৫ বছরের এ অশীতিপর মানুষকে তাঁর কুমিল্লার বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে পাকিস্তানিরা হত্যা করে। একইভাবে তারা হত্যা করে ৮৪ বছরের বৃদ্ধ রসায়নের অধ্যাপক যোগেশ চন্দ্র ঘোষকে। হত্যা করে দানবীর রণদা প্রসাদ সাহাকে। গরিবের ঘরে জন্ম নেয়া রণদা প্রসাদ সাহা নিজের চেষ্টায় বড় হয়ে জনহিতকর অনেক কাজ করেছিলেন। ফলে তিনি দানবীর অভিধায় অভিসিক্ত হয়েছিলেন। চট্টগ্রামের খ্যাতনামা কুন্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা, সমাজসেবক নতুন চন্দ্র সিংহও পাকিস্তানি হায়েনাদের নির্মমতার শিকার হয়েছিলেন। একইভাবে নির্মমতার শিকার হন কালজয়ী সুরকার আলতাফ মাহমুদ। তাঁর সুর করা কালজয়ী গান ফেব্রæয়ারি মাস এলে আকাশ বাতাসে অনুরণন তুলে বাংলা ভাষাভাষী প্রত্যেক মানুষকে শোকাভিভূত করে তোলে- “আমার মায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রæয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি”।
পুরো নয় মাস জুড়ে বাংলাদেশকে বধ্যভূমি বানিয়েই ক্ষান্ত হয়নি পাকিস্তানি হায়েনারা। বাঙালির প্রাণের চেয়ে প্রিয় বিজয় যখন দোরগোড়ায় তখন তারা আরও ভয়ংকর চেহারায় আবির্ভূত হয়। যখন তারা বুঝতে পারে বাংলার সোনার ছেলেদের হাতে তাদের শোচনীয় পরাজয় নিশ্চিত, তখন তারা শেষ মরণ কামড় হানে। তারা দেশকে মেধাশূন্য করার ভয়ংকর ষড়যন্ত্রে নেমে পড়ে। এ ষড়যন্ত্রের ফলশ্রæতিতে বাংলাদেশ নামক ভূখÐে পাকিস্তানিদের সমূলে উৎপাটনের পূর্বক্ষণে ডিসেম্বরের ১০ থেকে ১৪ তারিখের মধ্যে তারা একে একে তুলে নিয়ে যায় বাংলার অধ্যাপক মুনির চৌধুরী (যিনি লিখেছিলেন ভাষা আন্দোলনের উপর একমাত্র নাটক কবর), মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আনোয়ার পাশা; ইতিহাসের অধ্যাপক সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য ও গিয়াস উদ্দীন আহমদ ; ইংরেজির অধ্যাপক রাশীদুল হাসান, সাহিত্যিক-সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সার, সাংবাদিক সিরাজ উদ্দীন হোসেন (বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতের পুরোধা ব্যক্তিত্ব), নিজাম উদ্দিন আহমদ ও আ.ন.ম গোলাম মোস্তফাকে। তারা আরো ধরে নিয়ে যায় খ্যাতনামা চিকিৎসক ফজলে রাব্বী, আবদুল আলীম চৌধুরী ও মোহাম্মদ মোর্তজাকে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এদের নিকট আত্মীয়রা মিরপুর ও রাজারবাগ বধ্যভূমিতে অনেকে স্বজনের লাশ খুঁজে পায়। পাকিস্তানি হায়েনা ও এদের দেশীয় দোসররা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের এমন পৈশাচিক নির্যাতন করেছিল যে তাঁদের অনেকের লাশ স্বজনেরা শনাক্তও করতে পারেনি। বুদ্ধিজীবীদের লাশ জুড়ে ছিল আঘাতের চিহ্ন, চোখ-হাত-পা বাঁধা, অনেকের শরীরে ছিল একাধিক গুলি, অনেককে হত্যা করা হয়েছিল ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করে। আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন নিউজউইক এর সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের লেখা থেকে জানা যায়, পাকিস্তানি হায়েনা ও রাজাকার, আল বদর, আল শামস এর নির্মমতার শিকার হয়েছিলেন ১০৭০ জন বুদ্ধিজীবী। আবার কারো কারো লাশতো দূরের কথা হদিসই পাওয়া যায়নি। যেমনটি পাওয়া যায়নি বরেণ্য চলচ্চিত্রকার, সাহিত্যিক জহীর রায়হানের খবর। এ বরেণ্য চলচ্চিত্রকার মুক্তিযুদ্ধকালে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তানিদের হত্যাযজ্ঞের ভিত্তিতে নির্মাণ করেছিলেন ইংরেজি ভাষায় চলচ্চিত্র ‘স্টপ জেনোসাইট’। উদ্দেশ্য ছিল চলমান গণহত্যা বন্ধে এ ধরনের প্রামাণ্য চিত্র বিশ্ব জনমত গড়ে তুলতে সহায়ক হবে। এমনই মেধাবী চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান নিখোঁজ ভাইয়ের সন্ধান নিতে গিয়ে তিনি নিজেই চিরদিনের জন্য নিখোঁজ হয়ে গেলেন।
দেশের এ সব বিশিষ্ট ও প্রতিভাবান মানুষকে হত্যা করতে কারা প্ররোচিত ও পরামর্শ দিয়েছিল? কারা সহায়তা করেছিল? এ সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা আজ খুবই জরুরি। প্রশ্ন উঠতে পারে স্বাধীনতার ঊনপঞ্চাশ বছর পর এ সব পুরানো বিষয়কে নতুন করে টেনে আনা প্রয়োজন আছে কি না? অনেকে ভুলে গেলেও দেশপ্রেমিক কোনো মানুষ ভুলে যাননি এগারো শ মাইল দূর থেকে উড়ে আসা পাকিস্তানি হায়েনাদের পক্ষে জাতির মেধাবী সন্তানদের চেনা ও তাঁদের বাড়িঘরে ঠিক ঠিক পৌঁছে যাওয়া মোটেই সহজ ছিল না। এ কথা দিবালোকের মতো সত্য যে আল বদর, আল শামস আর রাজাকারের মতো ঘরের শত্রæ বিভীষণরাই ছিল হায়েনাদের আসল শক্তি। এ দেশের আলো বাতাসে বেড়ে উঠা মীর জাফরের উত্তরসূরি এ সব দেশকানার দল যদি হায়েনাদের পথ না দেখাত তাহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস লেখা হতো অন্যভাবে আর দেশ এগিয়ে যেত আরো অনেক দূর। আজ তাই ঘরের শত্রæদের, তাদের উত্তরসূরিদের চিহ্নিত করা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ শত্রæমিত্র চিহ্নিত করা না গেলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির পথ চলা সহজতো হবেই না, বরং দিন দিন কন্টকময় হয়ে পড়বে। তাই তাদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করে তাদের প্রতি সবিশেষ ঘৃণা প্রদর্শন করতে পারলেই সার্থক হবে জাতির মেধাবী সন্তানদের আত্মদান। মনে রাখতে হবে সিরাজ তিতুমীর সূর্যসেন আর বঙ্গবন্ধুর মতো মানুষেরা শত সহগ্র বছরে একবার জন্মগ্রহণ করে কিন্তু মীর জাফর, খন্দকার, আল বদর, আল শামস আর রাজাকারদের জন্ম হয় প্রতিদিন।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক