শহর শিশুর মানসিক বিকাশে বাধা ও করণীয়

362

শিশু বেড়ে উঠার পথে কতগুলো বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হয়। আবার গুরুত্ব দিলেও শহর পরিবেশে তা করা বা দেওয়া সহজে সম্ভব হয় না। ফলে বেশির ভাগ শহর শিশুর বিকাশ সুস্থ ধারায় হয় না। অভিভাবকরা নানা দুচিন্তায় পড়ে। কিন্তু বিষয়গুলো গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারলে এবং আন্তরিক সচেষ্ট হলে শিশু বেড়ে উঠার পথে প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করা যায়। প্রশমিত করা যায়। বিজ্ঞরা বলেন-শিশু বিকাশের প্রধান বাধা বা অন্তরায় হল অভিভাবকদের আচরণ। আরও একধাপ এগিয়ে কেউ কেউ বলেছেন শিশুকে মানসিক ভাবে হত্যা করে অভিভাবকরা। শিশুর সহজাত বুনিয়াদি গুণাবলী হল শুনার আগ্রহ, দেখার আগ্রহ, স্পর্শ করার আগ্রহ, মানসিক চিন্তন কাঠামো তৈরি করা, নিরাপত্তা ও সাহায্য দানকারীর সহর্চয কামনা, এবং কৌতুহল থাকা। বিজ্ঞরা দেখায়েছেন শূন্য থেকে ছয় বছর শিশুদের মধ্যে স্থান, কালের ব্যবধানে কোন পার্থক্য থাকে না। এসব সহজাত গুণাবলী সকল দেশের সকল সময়ের শিশুতে থাকে।
কিন্তু শিশুর সহিত আচরণগত পার্থকের কারণে, শিশুর বেড়ে উঠার পরিবেশগত পার্থক্যের কারণে এবং শিশুর দেখার বিষয়ে গুণগত পার্থক্যের কারণে শিশুতে শিশুতে বিকাশের পথে পার্থক্য তৈরি হয়ে যায়। যার জন্য সংস্কৃতবান ও মর্যাদাপূর্ণ পরিবার ও তার বিপরীত পরিবেশের শিশুদের মধ্যে পার্থক্য তৈরি হয়ে যায়। প্রথম প্রকারে ইতিবাচক ও দ্বিতীয় প্রকারে নেতিবাচক শিশু গড়ে উঠে। শিশুরা প্রথম দিকে তার পরিবেশের প্রত্যেক কিছুকে প্রবল আগ্রহ নিয়ে দেখে এবং তাতে সীমাহীন কৌতুহল থাকে। এই সহজাত বৈশিষ্ট্য হতে তার চিন্তন কাঠামো তৈরি হয় তার নর্ম গড়ে উঠে। যা ভবিষ্যতের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। এ জন্য অভিভাবকরা শিশুকে নিয়ে কী ভাবছে বা কি স্বপ্ন দেখছে সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হল-সে শিশুর সাথে কি রকম আচরণ করছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ। গাছের গুনাবলী সুপ্ত থাকে গাছের ফলের বীজে। সেই বীজে গুনাবলী প্রকাশ পেতে থাকে অংকুর উদগমের মাধ্যমে যা সাধারণের অগোচরে হয়। সে অংকুর উদগম তথা বীজের বিকাশের সময়ে অনুকূল পরিবেশ তথা উষ্ণতা, পানি, আলো বাতাস সার ইত্যাদি সুষমভাবে দেয়া নিশ্চিত করা না যায় তাহলে সে অংকুরের চারা গাছের ভবিষ্যৎ কি হবে তা আমরা জানি। চারা গাছের বেড়ে উঠা বিঘ্নিত হবে। চারা বেঁকে যাবে। বড় বৃক্ষের প্রতি সবাইর নজর পড়ে কিন্তু সেই বৃক্ষের ভ্রুনের প্রতি পড়ে না। সবায় নজরের আড়ালে অবহেলায় বেড়ে উঠতে হয়। এখানেই সমস্যা তৈরি হয় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। তবে শহর শিশুর জন্য উল্লেখযোগ্য প্রতিবন্ধকতাগুলোর উপর আলোচনা করা হল।
শহর শিশুর উল্লেখ্যযোগ্য প্রতিবন্ধকতঃ
(ক) লম্ফ-ঝম্ফ বা ছুটাছুটি : শিশুর লম্ফ-ঝম্ফ বা ছুটাছুটি বিষয়টি অনেক অভিভাবক গুরুত্ব সহকারে নেয় না, বরং তাতে বিরক্তি প্রকাশ করে। প্রান বাচাঁনোর জন্য মৌলিক বিষয়গুলো প্রকৃতিই সহজলভ্য করে দেয়। যেমন গাড়ী বাড়ী চেয়ে আলো বাতাস গুরুত্বপূর্ণ তাই প্রকৃতিই আলো-বাতাস পাওয়া সহজলভ্য করে দিয়েছে। তেমনি শিশুর সুস্থ বিকাশের জন্য শিশুর মধ্যে লম্ফ-ঝম্ফের বা ছুটাছুটির বিষয় সহজাত বৈশিষ্ট হিসাবে থাকে। তাই তার জন্য লম্ফ-ঝম্ফ দেওয়ার নিরাপদ ব্যবস্থা রাখা চাই। কিন্তু শহরে যারা সীমিত আয়ের মানুষ, বা যারা সীমিত বাসায় থাকে বা যারা চাকুরীজীবি তাদের সন্তানের মধ্যে এই আচরণ করার তেমন সুযোগ থাকে না বা তার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা দেওয়া সম্ভব হয় না। এতে সন্তান বিষন্নতায় ভোগে। দৈহিক বাড় বিঘ্নিত । বাসার জায়গা না থাকলেও বা সময় দিতে না পারলেও বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করলে শিশুকে লম্ফ-জম্ফ করার ব্যবস্থা করা যায়। সকালে বা বিকালে বাসার বাহিরে একটু খোলা জায়গায় ছুটাছুটির সুযোগ দেওয়া যায়। অথবা বাসায় নির্ধারিত দিনে ছুটাছুটির ব্যবস্থা করা যায়। তাও সম্ভব না হলে বাবা-মা সন্তানকে নিয়ে দৈহিক কসরৎ এর নানা খেলা খেলানো যায়। অংকুর উদগেমে পানি যেমন, মূলত শিশুর বেড়ে উঠার পথে ছুটাছুটি তেমন। বড় পরিসরে হউক বা ছোট পরিসরে হউক বড় সময়ে হউক বা সল্প সময়ে হউক ছুটাছুটি লম্ফ-ঝম্ফের ব্যবস্থা করতে হবে।
(খ) হট্টগোল করতে না দেয়া : শিশুর হট্টগোল অনেকের জন্য দুর্বিষহ। কিন্তু শিশুরা একটু হট্টোগোল করবেই। হৈ-চৈ করা এক ধরনের মানসিক ব্যায়াম। সমবয়সিকে নিয়ে কথার খৈ ফোটানো খেলনা নিয়ে হট্টগোল করা ইত্যাদি শিশুর মানসিক বিকাশকে সহায়তা করে। শহরে বাসায় থাকতে হয় বলে, সামাজিক সর্ম্পক শীতল বলে বা বাসায় ফিরে আসলে শিশুর হট্টোগল দুর্বিষহ বলে শিশুর হট্টোগল করা বিঘ্নিত হয়। গ্রামে কার খবর কে রাখে। অন্য দিকের জায়গায় শিশুরা হট্টগোল করলেও অসুবিধা হয় না। আবার গ্রামে পাড়া প্রতিবেশীর সাথে নিরাপদে খেলা যায়, বেড়ানো যায়। শহরে তা সীমিত। কিন্তু বিষয়টাকে গুরুত্ব দিলে ও শিশুর এই বিষয়ে আন্তরিক থাকলে তার ব্যবস্থা করা যায়। পারিবারিক অনুষ্ঠানে, সামাজিক অনুষ্ঠানে বা প্রতিবেশির সমবয়সি শিশুদের সাথে মিশার সুযোগ করে দেওয়া যায়। যাতে সে তার ইচ্ছা-মনোভাব প্রকাশ করতে গিয়ে, আবেগ প্রকাশ করতে গিয়ে, একটু হৈ চৈ করতে পারে। হৈ চৈ করা শিশুরা পরবর্তীতে মানসিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারে। বিষয়টা শিশু বেড়ে উঠার পথে গুরুত্ববহ।
(গ) অতি আদরে রাখা : শহরের অভিভাবকদের সন্তান সংখ্যা খুবই কম। তাই তাদের আবেগগুলো আশাগুলো সেই এক বা দুই সন্তানকে ঘিরে। আবার গ্রামের মুক্ত পরিবেশের অভিভাবকদের মত শহরের অভিভাবরা বড় পরিসরে থাকতে পারে না। শহরের অধিকাংশ অভিভাবক কোন না কোন মাত্রায় হোমসিকে আক্রান্ত। এই দুই মিলে সমস্ত আদরের চাপ আবেগের চাপ সন্তানকে বহন করতে হয়। অত্যধিক আদরের চাপ সন্তানের ক্ষতি করে।
(ঘ) অন্য শিশুর সাথে মিশায় সুযোগ না থাকা : বিজ্ঞানীরা মানুষের মনের বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকাশ করতে পেয়েছে। মনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল পরিবেশের নানা উপাদানের ও ঘটনার সাথে মস্তিষ্কের মিথষ্ক্রিয়ায় মাধ্যমে মন বা মস্তিষ্ক গড়ে উঠে। পরম শূন্য বা উপাদানহীন পরিবেশে মন গড়ে উঠতে পারে না। তাই শিশুকে সামাজিক পরিবেশেই সামাজিক আচরণ ও নর্ম গুলো রপ্ত করতে হয়। এর জন্য প্রয়োজন তার সমবয়সির সাথে মিশার সুযোগ দেওয়া। খেলাধুলা করার সুযোগ দেওয়া। দল বাধার সুযোগ দেওয়া। এতে তার নানামুখী বিকাশ সহজ হয়। কিন্তু নগরের মানুষগুলো একসাথে স্তুপের মত থাকলে কি হবে। কারো সাথে কারো সর্ম্পক তেমন থাকে না। প্রতিবেশী প্রতিবেশীকে চিনে না। ইটের কংকরের মত টুকরা এক জায়গায় থাকি কিন্তু পরস্পরের মধ্যে কোন টান থাকে না সম্পর্ক থাকে না। ফলে অনেকের মধ্যে থেকেও প্রত্যেককে নিসঙ্গতার মধ্যে, বিষন্ন হয়ে পড়ার মধ্যে থাকতে হয়। এর প্রভাব সন্তানের উপর পড়ে। আমরা ভুলে যাই সন্তানের জন্য বন্ধু প্রয়োজন, দল প্রয়োজন। মতামত দেওয়া-নেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করা প্রয়োজন। শহরের শিশুরা তা থেকে বঞ্চিত বলে তারা অসামাজিক হয়ে পড়ে। ফলে তাদের বেড়ে উঠা ত্রæটি পূর্ণ হয়। তাই শিশুদের সামাজিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
(ঙ) স্বাভাবিক ও সুস্থভাবে বেড়ে উঠার জন্য সুষম খাবার নিশ্চিত করা প্রয়োজনঃ শাকসবজি ও পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাবারের ব্যবস্থা নিয়মিত কারা যায় না। অভিভাবকের অসচেতনতা ও অক্ষমতায় এটা ঘটে, শহরের সীমিত আয়ের ও প্রান্তিক তৃণমূল পরিবারের শিশুদের ক্ষেত্রে। যার প্রকটতা গ্রামে কম। অভিভাবক সচেতন হলে অন্য দিকের ব্যয়ের চেয়ে সুষম খাদ্যের বিষয়কে গুরুত্ব দিলে অনেকটা ঘাটতি পূরণ করা যায়। ছয় বছর বয়স পর্যন্ত যদি উল্লিখিত অন্তরায়গুলো থেকে সন্তানকে দূরে রাখা যায়, শিশুর প্রয়োজনগুলো মিটানো যায় তাহলে তারা রুগ্ন হবে না, উদ্যমহীন হবে না দুর্বল মনের অধিকারী হবে না। এ ক্ষেত্রে একটু সচেতনতা ও আন্তরিকতাই প্রয়োজন।
লেখক : প্রাবন্ধিক