শহরের প্রবেশ মুখেই বিশৃঙ্খলা

108

শহরের প্রবেশ মুখ তৃতীয় কর্ণফুলী সেতু এলাকার গোলচত্বরে কোনভাবেই শৃঙ্খলা ফেরানো যাচ্ছে না। গোলচত্বর ঘিরে গড়ে উঠা নয়টি সড়কের মুখেই প্রতিনিয়ত গাড়ির জটলা। ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে গাড়ি। এমনকি সরকারের উদ্ধারকৃত জায়গাও দখলে নিয়েছে গাড়ি চালকরা। পানি চলাচলে নির্মিত ড্রেনের উপরেও গাড়ি থাকে। এ যেন অবৈধ গাড়ির স্ট্যান্ড।
প্রতিনিয়ত গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকায় সৃষ্টি হয় ব্যাপক যানজট। এতে যাত্রী ভোগান্তি চরম আকার ধারণ করে। সন্ধ্যা নামতেই এ মোড়টিতে ছিনতাইকারীদের টার্গেটে পরিণত হন যাত্রীরা। মৃত্যুফাঁদে পরিণত হওয়া এ গোলচত্বরে অসংখ্যবার প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) হারুনুর রশিদ হাযারী পূর্বদেশকে বলেন, ‘এখনো কাজকর্ম করছি। সাধারণ মানুষ সুফল পায় মতো ভালো কিছু করার চেষ্টা করছি। কিছু গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে। সেখানে বলে দিয়েছি কোন গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। আমরা সেই মোড়টিতে শৃঙ্খলা ফিরানোর চেষ্টায় আছি। কোন অবৈধ গাড়ির স্ট্যান্ড থাকতে পারবে না। কিছুদিনের মধ্যেই অবস্থার আরো উন্নতি হবে।’
কয়েকজন যাত্রী জানান, প্রতিনিয়ত এই মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ দায়িত্ব পালন করলেও তাঁদের সামনেই গাড়ি চালকরা অনিয়মে মেতে উঠে। পুলিশের আস্কারা পেয়েই এ মোড়ে বেপরোয়া আচরণ করেন গাড়ি চালকরা। এ মোড়ে বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী গাড়ি মালিক সমিতির পক্ষে এক শ্রেণির দালালচক্র পুলিশের সাথে যোগসাজশ রাখেন নিয়মিত। গাড়ির অবৈধ স্ট্যান্ড রাখতেও এই চক্রটি পুলিশকে ম্যানেজ করতে ভূমিকা পালন করেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, গত সোমবার দুপুরে তৃতীয় কর্ণফুলী সেতুর গোলচত্বরে দায়িত্ব পালন করছিলেন কমপক্ষে দশজন পুলিশ সদস্য। এ সময় সেখানে ট্রাফিক পরিদর্শক মো. সামছুদ্দিন, সার্জেন্ট মুজাহিদ, কামরুল, কনস্টেবল নিজাম, তালেব, খলিলুর, রহিম, কালাম, শফিউল দায়িত্ব পালন করছিলেন। ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা আইল্যান্ডে বসানো ছাতার নিচে ঝিরিয়ে নিচ্ছেন। আর টিআইসহ দুই সার্জেন্ট পুলিশ বক্সে বসে আড্ডা দিচ্ছেন।
হঠাৎ একজন সার্জেন্ট গোলচত্বরে মেরিনার্স সড়কের মুখে দাঁড়ানো (চট্টমেট্রো-থ-১১-৮২৫৮) নং সিএনজি অটোরিকশার কাগজপত্র দেখে মামলা দেন। গাড়ি চালক অনুরোধ করলেও ওই সার্জেন্ট কথা রাখেননি। অথচ গাড়িটির আগেই পিছে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ছিল কমপক্ষে আরো ছয়টি সিএনজি অটোরিকশা। যার মধ্যে অধিকাংশই প্রাইভেট লিখা সিএনজি।
মামলার শিকার সিএনজি অটোরিকশা চালক মোহাম্মদ মিজান জানান, ‘অবৈধ গাড়ি পার্কিং করেছি জানিয়ে মামলা দেয়া হয়েছে। অথচ নিজেই দেখছেন আমার আগে পিছে কয়টি গাড়ি। এগুলোর একটাকেও মামলা দেয়া হয়নি। আমি এখানে স্ট্যান্ডে টাকা না দেয়ায় সেটি করা হয়েছে।’
মেরিনার্স সড়কের মুখে দাঁড়ানো সারিবদ্ধ গাড়িগুলোর নিয়ন্ত্রণ করছেন হাতে লাঠি থাকা কয়েকজন যুবক। তাদের সাথে আবার পুলিশের ভালো সখ্যতাও দেখা যায়। প্রতিটি গাড়ি যাত্রী নিয়ে যেতেই লাঠি হাতে থাকা লোক টাকা আদায় করে। একই অবস্থা চাক্তাই সড়কের মুখে দাঁড়ানো সিএনজি টেম্পোগুলোতেও। অবৈধভাবে সেখানে স্ট্যান্ড গড়ে তুলে চাক্তাই-নিউমার্কেট পর্যন্ত যাত্রী পরিবহণ করছে একটি চক্র।
শহর থেকে দক্ষিণ চট্টগ্রামমুখী সেতুর মুখে যাত্রীবাহি গাড়ি ও লেগুনা দাঁড়িয়ে থাকায় ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়। একইভাবে বাস্তুহারা সড়কের মুখে গ্রাম সিরিয়ালের সিএনজি অটোরিকশা অবৈধ স্ট্যান্ড গড়ে তুলেছে। বাস টার্মিনাল থেকে গাড়ি ছেড়ে আসার নিয়ম থাকলেও তৃতীয় কর্ণফুলী সেতু এলাকা থেকেই দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন রুটের উদ্দেশ্যে প্রতিনিয়ত যাত্রীবাহী গাড়ি ছেড়ে যায়। উদ্ধারকৃত সরকারি জায়গাগুলোতেই গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ স্ট্যান্ড। সেখানে দক্ষিণ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বান্দরবান রুটের গাড়ি ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে।
সম্প্রতি গোলচত্বর এলাকায় সিএমপির ট্রাফিক (উত্তর) বিভাগের পক্ষ থেকে কিছু নির্দেশনা দেয়া হলেও সেগুলো কেউ মানছে না। পুলিশের সামনেই এমন নির্দেশনা অমান্য করছে গাড়ি চালকরা। সড়কের পূর্ব প্রান্তে পানি চলাচলের ড্রেনে ঘেঁষে ‘পার্কিং করা সম্পূর্ণ নিষেধ’ সম্বলিত সাইনবোর্ড লাগানো হলেও তা অমান্য করেই গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল।
সোমবার দুপুর ১টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত দেড় ঘন্টা তৃতীয় কর্ণফুলী সেতুর গোলচত্বরে এমন চিত্র দেখা গেলেও হঠাৎ অজ্ঞাত কারণে নড়েচড়ে বসে ট্রাফিক পুলিশ। ‘খোলস’ ছেড়ে বেরিয়ে আসে দায়িত্বে নিয়োজিত সকল পুলিশ সদস্য। এদিক সেদিক দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলোকে লাঠি হাতে তাড়াতে থাকেন টিআই, সার্জেন্ট, কনস্টেবল সবাই। এসময় চলন্ত গাড়িগুলো তাড়াতে দেখা গেলেও যাত্রীশূন্য গাড়িগুলো লাল ভবনের সামনেই অনায়াসে দাঁড়িয়ে ছিল। টিআই সামছুদ্দিন লাল ভবন প্রান্তে গিয়ে কয়েকটি গাড়িকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াতে নির্দেশন দেন। এসময় টিআইয়ের সাথে গাড়ি চালকদের কয়েকজন প্রতিনিধিকে আলাপচারিতায় মেতে উঠতে দেখা যায়।
এ বিষয়ে বাকলিয়া জোনের ট্রাফিক পরিদর্শক (টিআই) মো. সামছুদ্দিনের মুঠোফোনে বেশ কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সংযোগ বন্ধ পাওয়া যায়।
সন্ধ্যা নামতেই ছিনতাই : দিনের বেলায় গোলচত্বরে চরম আকার ধারণ করলেও সন্ধ্যা নামতেই বাড়তি ভাড়ার চাপে থাকেন যাত্রীরা। একই সময়ে সেখানে নিয়মিত ছিনতাইয়ের শিকার হন যাত্রীরা। থেমে থাকা গাড়িতে জানালার পাশে বসা মুঠোফোন, মহিলা যাত্রীদের কানের দুল ও চেইন ছিনতাই নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। যাওয়া-আসার তাড়ায় থাকতে গিয়ে কেউ এসব বিষয়ে পুলিশের শরণাপন্ন না হলেও চিহ্নিত ব্যক্তিরাই মাদকাসক্ত যুবকদের ব্যবহার করে এমন অনৈতিক পেশায় যুক্ত রেখেছেন। এ কাজে জড়িতরা বাস্তুহারা ও চাক্তাই এলাকার বিভিন্ন বস্তিতে বসবাস করেন বলে জানা গেছে।
গত তিনদিন আগে বাঁশখালীর বৈলছড়ি এলাকার মহিলা যাত্রীর চেইন ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছেন ওই যাত্রীর ছেলে সজিব। তিনি বলেন, আমার মা ও বাবা বাড়ি যাওয়ার সময় জানালার পাশে বসা ছিল। এসময় হঠাৎ একটা ছেলে চেইন টান দিয়ে পালিয়ে যায়। বৃদ্ধ বাবা ও মা ছেলেটি দোঁড়ে যেতে দেখলেও নিরুপায় ছিল।
জানতে চাইলে বাকলিয়া থানার ওসি প্রনব কুমার চৌধুরী পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমরা নিয়মিত অভিযান চালিয়ে ছিনতাইকারীদের গ্রেপ্তার করি। মামলা দেয়া হয়। তদন্তে যারাই জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিই। সেখানে যেসব ঘটনা ঘটে সেগুলোর জন্য কেউ অভিযোগ দেয় না। অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নিতে সুবিধা হয়।’