শরতের বিদায়, কার্তিককে সাথে নিয়ে এলো হেমন্ত

249

ভয়াল করোনাকে সাথে নিয়েই বিদায় নিল শরৎকাল। এখন চলছে হেমন্ত কাল। মঙ্গল কাব্যের কবি মৃকৃন্দ রাম চক্রবর্তীর কালকেতু উপখ্যানে প্রথম এ ঋতুর কিঞ্চিৎ আভাস আমরা পাই। ‘কার্তিক মাসেতে হয় হিমের প্রকাশ/ যগজনে করে শীত নিবারণ মাস ’। বৈষ্ণব কবিদের পদাবলীতে ও হেমন্তের ইংগিত মেলে।
গত দুমাস ধরে প্রকৃতিতে অমল ধবল হাওয়া ছিল, স্বচ্ছ আকাশে শরতের মেঘ মালাদের আনাগোনা ছিল। এই রোদ এই বৃষ্টির লুকো চুরি লুকো চুরি গল্প সবই ছিল। কিন্তু করোনার করাল থাবায় প্রকৃতির এই মধুর মূরতি মানুষ দেখার সুযোগ পায়নি। মানুষের জীবন গত আট মাস ধরে বিপন্ন করোনা ভাইরাসের মরণ থাবায়। মরণঘাতি এই ভাইরাস কত মানুষকে ছিনিয়ে নিয়ে গেলনা ফেরার দেশে। তার তান্ডব লীলা আর খান্ডবদাহনে মানুষের জীবন এখনো ওষ্ঠাগত। কোন ওষুধ নেই, কোন চিকিৎসা, নেই. কোন ডাক্তার। সে এক ভয়ার্ত আর বিভীষিকাময় চিত্র। যিনি আক্রান্ত আপনজনেরা ও যেতে পারেনি তার পাশে। এখনো মানুষ ভয় আর আতংকে কালাতিপাত করছে। বেঁচে থাকার বাসনায় যত দূর পারা যায় সচেতনতা অবলম্বন করে সুরক্ষিত হয়ে মানুষ কেবল বেঁচে থাকায় চিন্তায় বিভোর রয়েছে। এই অবস্থায় প্রকৃতির রূপরস বর্ণ গন্ধ আস্বাদন করা মানুষের পক্ষে অনেক কষ্টকর ও কঠিন হয়ে ওঠে। এর পরেও থেমে থাকেনা প্রকৃতি আর জীবনের গতি। প্রকৃতি তার যাবতীয় ঐশ্বর্য্য আর প্রাচুর্য্যরে ডানা মেলে দিয়ে প্রতিনিয়ত উজাড় করে তার অপার মহিমাকে পৃথিবীতে ছড়াতে ব্যস্ত রয়েছে। তবে গত আট মাসের লক ডাউনে অনেক দূষণমুক্ত হয়েছে এই পৃথিবী। ফলে আমরা দেখেছি আকাশ নির্মল, বাতাস বিশুদ্ধ, গাছ পালারা সজীব, পাখিরা মুখর কলকাকলিতে, সাগরের জল স্বচ্ছ আর সুনীল, সেখানে আপন মনে হেসে খেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে ডলফিনেরা। করোনার অবাধ সংক্রমণ ও বিস্তারের মাঝে ও চলছে প্রকৃতির লীলাবৈচিত্র্য আর পালাবদল। ভাদ্র মাসকে শীতের জন্ম মাস বলা হলেও কার্তিকের সূচনালগ্নে ও প্রচুর গরম। মানুষ যেন গরমে একেবারে হাঁস ফাস করছে। শীতের কোন লক্ষণ আমরা এখনো প্রকৃতিতে দেখছিনা। তবে শিশিরের টুপ টুপ শব্দ আর শেষ রাতের হাল্কা শীতল হাওয়া একটু একটু করে জানান দিচ্ছে ঋতু বৈচিত্র্যের এই দোলাচল। ঋতু পরিক্রমায় কার্তিক আর ও অগ্রহায়ণ মিলে হেমন্ত কাল। ‘কৃত্তিকা’ ও ‘আদ্রা’ এই দুই তারার নামানুসারে রাখা হয় এই এই দুই মাসের নাম। কার্তিক মানেই মংগা, সব কিছু দাম। কৃষকের গোলার ধান তলা নিতে, ক্ষেতে তরিতরকারি শাক আনাজ ফলে কম। তাই এর নাম মরা কার্তিক। এর পরেই আসবে অগ্রহায়ন মাস, এ মাসে সার্বজনীন লোকজ উৎসব নবান্ন। ‘অগ্র’ ও ‘হায়ন’ এর অর্থ হলো ‘ধান’ আর ‘ধানকাটার মৌসুম’। হেমন্তকে বন্দ না করে কবিগুরু লিখে ছিলেন : হিমের রাতে ওই গগণের দীপগুলিরে হেমন্তিকা করলো গোপন আঁচল ঘিরে ঘিরে’ আবার বিদ্রোহী কবি বলেন : ‘ঋতুর খাঞ্জা ভরিয়া এলো কি ধরণীর সওগাত/ নবীন ধানের সুঘ্রাণে আজি অঘ্রাণ হলো মাৎ”। আর হেমন্তের কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন : ‘ধুধু মাঠ ধানক্ষেত কাঁশফুল বালুকার চর/ বকের ছানার উপর যেন মোর বুকের উপর/ এলোমেলো ডানা মেলে মোর সাথে চলিল নাচিয়া’ অথবা ‘যে মাঠে ফসল নেই তাহার শিয়রে চুপে দাঁড়ায়েছে চাঁদ-কোন সাধনাই তার ফসলের তরে’। আসলেশীতগ্রীষ্ম কিংবাবর্ষারমতো হেমন্ত অত তীব্র প্রখর বা মুখরা নয়, তাকে আলাদা করে দেখা যায় না। ম্লান ধুসর আর অস্পষ্ট হেমন্তকাল শুধু অনুভবের। বসন্তের কোকিলের ডাক, ফুলের গন্ধ, পাখির গান অথবা গ্রীষ্মের খরতাপ, বৈশাখী ঝড় কিং বা বর্ষার ভরা নদী, ঘনঘোর বরষার ঝম ঝম বৃষ্টির মতো করে হেমন্ত জানান দেয় না যে আমি আছি, আমি এসেছি। অনেক রাশ ভারী এবং শান্ত প্রকৃতির এ ঋতু। তবে ঝড় তুফান আর ঘুর্ণিঝড়ের আশংকা এই ঋতুতে তে বেশি হয়। তারপর ও গান কবিতা আর ছন্দে কত ভাবেইনা হেমন্ত বন্দনা করেছেন কবিরা । কত রূপে কত রং এ এই ঋতু মহিমা ছড়িয়েছে। যদিও এই রূপ চট করে চোখে পড়েনা। গভীরভাবে খেয়াল করলে বোঝা যাবে প্রকৃতি পাল্টাচ্ছে ধীরে, অতি ধীরে। শহরে খুব বেশি ধরানা পড়লে ও গ্রামে তা অনেক বেশি স্পষ্ট ও দৃশ্যমান। বিলের জলে শাপলা শালুক কুড়াতে ব্যস্ত কিশোর কিশোরীরা। বড়শি বা জাল দিয়ে চলছে মাছ ধরার উৎসব। আর গাছিরা খেজুর গাছ সাফ করে তৈরি করছে রস আহরণের জন্য। গ্রাম বাংলার এসব চিরায়ত রূপেই হেমন্ত কাল অত্যন্ত সুন্দর ও নান্দনিকভাবে প্রতি ফলিত হয়ে উঠে আমাদের সামনে।