শপথের মাস মাহে রবিউল আউয়াল

64

রোমান, পারস্য সাম্রাজ্য ও আরব জাতিদের আবাসভূমি সর্বক্ষেত্রে নৈরাজ্য, অরাজকতা আর হিংস্রতার তাÐব চলছিল। সন্ত্রাস, ষড়যন্ত্র ও পাশবিকতার কারণে বিশ্বময় নেমে আসে অন্ধকার। যে সময়কে আমরা মষড়ড়সু বা অন্ধকার যুগ বলি। তখনকার সময়ে মানব জাতির নেতৃত্বে থাকা ইহুদিরাই হয়ে উঠেছিল সবচেয়ে বেশি মানবতা বিরোধী কর্মকাÐের হোতা। তারা নবী রাসুলদের হত্যা এবং তাদের ধর্মগ্রন্থ ‘তালমুদ’ বিকৃত করার মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বের মালিকানা দাবি করে। এমনি অবস্থার চির অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে মহান আল্লাহ তা’য়ালা শেষ নবী, শ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহম্মদ (দ:) কে দুনিয়াতে পাঠান সৃষ্টি জগতের জন্যে শান্তির দূত হিসেবে সূরা আম্বিয়া: আয়াত ১০৭। তাই মানব সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা আর নিপীড়িতদের মুক্তির কথা ভেবে সার্বক্ষণিক ব্যকুল থাকত নবী (দ:) হৃদয়। তাই প্রিয় নবী (দঃ) হাশিম, হোজরা ও তায়েফ বংশীয় নেতাদের শপথবাক্য পাঠ করানোর মাধ্যমে তিনি গঠন করেন ‘হিলফুল ফুযুল’। অশান্তি ও বিশৃঙ্খলারোধ, অসহায় গরীবদের সাহায্য এবং মুসাফির বা বণিকদের সুরক্ষা করার লক্ষ্য নির্ধারণ করে গঠিত ‘হিলফুল ফুযুল’ই পৃথিবীর প্রথম মানবাধিকার সংস্থা। কল্যাণধর্মী বিশ্ব গড়ে তোলার কাজও আরম্ভ হয় তখন থেকে।
৬২২ খ্রিষ্টাব্দে যখন মিসাকে মদিনা বা ‘মদিনা সনদ’ বিশ্বের প্রথম সার্বজনীন লিখিত সংবিধান রচিত হয় তখন ভারতবর্ষে চলছিল সম্রাট হর্ষবর্ধনের ঐধংযধাধৎফযধহধ (৬০৬-৬৪৭ খ্রি:) রাজত্ব। বাংলায় চলেছিল সামাজিক অস্থিরতা। মদিনা সনদ অনুসরণ করে চলা খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগ ৬৬১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে মানুষের উপর মানুষের প্রাধান্য ছিল না। রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে থাকা কেউ নীতিশূন্য হতে পারেনি। ছিল না কোন ধরনের পেশী শক্তির দাপট বা স্বৈরাচারী আচরণ। রসুলে পাক (দ:) একটি পরিপূর্ণ ও শ্রেষ্ঠ জীবন পদ্ধতির দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন। যার মূলে রয়েছে সাম্য, শান্তি ও স¤প্রীতির মাধ্যমে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের কল্যাণ সাধন। তাই তিনি বলেছেন- ‘সর্বোত্তম মানুষ ঐ ব্যক্তি যে মানুষের কল্যাণ করে’। তাঁর উপর নাযিলকৃত পবিত্র কালামে পাকে বলা হয়েছে মানুষের কল্যাণমুখী জীবন ধারার কথা। দোলনা (ঈৎধফষবৎ) হতে কবর এবং পরকালের অনন্ত জীবনের (টহষরসরঃবফ ষরভব) শান্তি অথবা শাস্তি (আল্লাহর ফায়সালা) এর কথাও বলা হয়েছে এ পবিত্র গ্রন্থে। যাতে মানুষ আল্লাহর নির্দেশ পালনের মাধ্যমে কল্যাণ লাভ করতে পারে।
আমরা সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নতি সাধনের কথা বলি মানুষের স্বার্থে। অর্থাৎ মানব কল্যাণই মুখ্য বিষয়। এমনি বহুমাত্রিক প্রয়াসের মাধ্যমে কল্যাণ সাধনের মূলে রয়েছে সৃষ্টির সেরা হিসেবে মানুষের মমত্ব, দায়িত্ব ও চেতনাবোধ। যে কারণে মহান আল্লাহ মানুষকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষার জন্যে প্রয়োজনীয় যৌক্তিক বিধানের নাম অবশ্যই আসমানি কিতাব আল্ কোরআন। যেখানে মহান রাব্বুল আলামিন অকল্যাণকর সকল মন্দ কাজে নিষেধ এবং কল্যাণকর ভাল কাজের নির্দেশ দেয়ার কথা বলেছেন। যাতে কোরআন নির্দেশিত পথে চলে) মানবগোষ্ঠি শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়।
বর্তমানে আমরা এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন। শহরের অলি গলি বিশেষ করে রেল লাইনের আশে পাশে, মাঠ-ঘাট সর্বত্র নেশাগ্রস্ত মানুষের আনা গোনা দেখা যায় অন্ধকার নামলেই। প্রায় প্রতি দিন ইয়াবা পাচারের ঘটনা চোখে পড়ে সংবাদ পত্রে। অভিনব কৌশল অবলম্বন করছে অপরাধী চক্র। দামি গাড়ি, মোটর সাইকেলের ট্যাংক এমনকি নারিকেলের ভেতরে ইয়াবার সন্ধান পাওয়ার সংবাদ ছাপিয়েছে স্থানীয় দৈনিক। হতাশা, বেকারত্ব, অসৎ সঙ্গ ও পারিবারিক অশান্তির কারণে মানুষ বেছে নিচ্ছে আত্মহননের মত গর্হিত কাজ। যার নতুন সংস্করণ ইষঁব ডযধষব। পরকীয়ার কারণে নিজের সন্তানকে হত্যার ঘটনা আইয়্যামে জাহেলিয়াতকে হার মানাচ্ছে। গুম করে, মোবাইল ফোনে হুমকি দিয়ে অথবা তুলে নিয়ে জিম্মি করে টাকা আদায় করা বেড়েছে। অপরাধীরা যা খুশি তাই করছে। কেন না মানুষ আল্লাহ এবং নবী (দ:) নির্দেশিত পথ ভুলে ইহজাগতিক আরাম আয়েশে মত্ত। যে নীতি নৈতিকতা শ্রেষ্ঠ নবী (দ:) এর কাছে পেয়েছিলাম তার থেকে যোজন যোজন দূরে সরে গিয়ে আমদানি করা আচার আচরণ বা আধুনিকতার সর্বনাশা জোয়ারে আমরা ভেসে যাচ্ছি এক অজ্ঞাত গন্তব্যের দিকে।
ইয়াসরিবে বসবাসকারী ইহুদিগণ বিস্ময়ে অবলোকন করেছে প্রিয় নবী (দ:) এর আদর্শ। ওংষধসরপ ঝঃধঃব বা মদিনাতুর রাসুল হওয়ার পরও তারা তাদের আইন অনুযায়ী চলত। তাদের শবযাত্রার প্রাক্কালে বিশ্ব নবী (দ:) এর দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন একটি বিরল ঘটনা বৈকি। তারা দেখেছে বদর যুদ্ধে বন্দি কাফিরদের সাথে রহমতুল্লিল্ আলামীনের আচরণ। ৮০ মাইল দূরত্ব অতিক্রমের সময় (বদর হতে মদিনা) হুজুরে পাকের নির্দেশে মদিনার আনসারগণ পায়ে হেঁটে এসেছেন, বন্দিগুলোকে পৌঁছে দিয়েছেন তাঁদের বাহনে আরোহন করিয়ে। হয়তোবা এ কারণেই বৃটিশ প্রতœতত্ত¡বিদ খধহঢ়ড়ষব ‘ঝঃঁফরবং রহ গড়ংয়ঁব’ গ্রন্থে বলেন- মুহম্মদ (দ:) ই ছিলেন পৃথিবীর বুকে একমাত্র ব্যক্তি, যিনি তাঁর অনুভূতি জাগ্রত হওয়ার পর থেকে ইন্তেকাল পর্যন্ত ছন্দপতনহীনভাবে পুতপবিত্র জীবন যাপন করে গেছেন। কখনোই তাঁর সত্তার পরিচয় বিস্মৃতি ঘটেনি। আপন ব্যক্তিত্বের মর্যাদা এবং নিজ জাতির শাসক হওয়া সত্তে¡ও তাঁর কাছে যে বিনয় নম্রতা পাওয়া যায় এমনটি আর কোন শাসক বা পয়গম্বরের ভাগ্যে জোটেনি। অন্য এক ইংরেজ লিখক ও খ্যাতিমান নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক জর্জ বার্নাড’শ লিখেছেন- হযরত মুহম্মদ (দ:) জীবিত থাকলে এক কাপ কফি পান করতে যে সময়ের প্রয়োজন এতটুকু সময়ের মধ্যে বর্তমান অশান্ত বিশ্বের তাবৎ সমস্যাবলীর সমাধান দিতে সক্ষম হতেন।
আজ সময় এসেছে উম্মতে মুহম্মদি বা মুসলমানদের চেতনা ফিরে পাওয়ার। ফিরে দেখা সেই স্বর্ণালী যুগ। যখন মদিনার শাসন ছিল উদাহরণ সৃষ্টিকারী বিশ্ব মানবের জন্যে আশীর্বাদ। সময় এসেছে আমাদের শেকড় সন্ধানের। আজকের দিনে নবী আদর্শে পথ চলার শপথ হোক। নিপীড়িত মানুষের কল্যাণে নিবেদিত হই। মাহে রবিউল আউয়াল- হোক বিশ্বময় শান্তি প্রতিষ্ঠার শপথের মাস।
লেখক : রাজনীতিক, প্রাবন্ধিক