শতাধিক পাচারচক্র সক্রিয় ১৩ জেলার গ্রামে গ্রামে

36

লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশি হত্যার ঘটনায় রাজধানীতে ১০৮ মানবপাচারকারী এবং ছয়টি ট্রাভেল এজেন্সির বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এতে লিবিয়া, দুবাইসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত মানবপাচারকারীদের আসামি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে র‌্যাব-১ ও সিআইডি পৃথক অভিযানে ১৩ মানবপাচারকারীকে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে।
গত শুক্রবার বিকালে সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফারুক হোসেন মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘১ জুন পল্টন থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে প্রথম একটি এবং ৪ জুন পল্টন ও বনানী থানায় পৃথক আরও দুটি মামলা হয়েছে। ২০১৮ সালের ফেব্রূয়ারি থেকে ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত পাচারের শিকার হওয়া ভিকটিমের হয়ে এসব মামলা করা হয়েছে।’
প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় মামলা যথাক্রমে ৩৮, ৩৬ ও ৩৪ জন মানবপাচারকারীর বিষয়ে তথ্য দেওয়া হয়েছে। তিন মামলায় মোট নামীয় আসামি ১০৮ জন।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ২০১৮ সালের ফেব্রূয়ারি থেকে ২০২০ সালের মার্চের ২০ তারিখের মধ্যে ৩৮ জন বাংলাদেশিকে ইতালিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাঠানোর কথা বলে পাচার করা হয়। খবর বাংলা ট্রিবিউনের
লিবিয়ায় ৩৮ বাংলাদেশিকে দুই বছর ধরে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে সংগ্রহ করে পাচার করা হয়েছে। পাচারের সঙ্গে দেশের ১৩টি জেলার শতাধিক ব্যক্তি জড়িত। মানবপাচারের গ্রূপগুলো দেশের মাদারীপুর, কিশোরগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, নড়াইল, বরগুনা ও ঢাকায় সক্রিয় রয়েছে।
এসব জেলায় সক্রিয় মানবপাচারকারী হলো মাদারীপুরের রাজৈরে নূর হোসেন শেখ, নজরুল, রবি, জুলহাস শেখ, মিরাজ হাওলাদার, রাসেল মীর, রাজন ওরফে বুলেট, মোমিন, ইলিয়াছ মীর এবং শিবচরের জাকির মিয়া।
ঢাকার রমনার বেইলীরোডের নুরজাহান আক্তার (৪০), আব্দুস সাত্তার (৫০), রুজভেল্ট ট্রাভেল এজেন্সির পরিচালক আকবর হোসেন এবং মগবাজার ওয়্যারলেস গেটের খালিদ চৌধুরী (৪৮)। বনানীর বেঙ্গল টাইগার ওভারসিস লিমিটেড। গোপালগঞ্জের মকসুদপুরের রব মোড়ল। কুষ্টিয়ার মিরপুরের হাজী কামাল। ফরিদপুরের বক্স সরদার। নড়াইলের মোক্তার মোল্লা। কিশোরগঞ্জ ভৈরবের শাওন ও জাফর।
ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার আখাউড়ার রফিকুল ইসলাম সেলিম ও হোসাইন। কুমিল্লার সনাতন দাশ ওরফে দাদা, শরীফ হোসেন, শরীফের দুই সহযোগী সোহেল পাজারী ও হারুন। শরীয়তপুরের রফিকুল ইসলাম। বরগুনা পাথরঘাটার সজল ও ইদ্রিস আলী।
নোয়াখালী সোনাইমুড়ীর রুবেল মির্জা, নাসির উদ্দিন মির্জা ও রিপন মির্জা। তারা তিনজন ছদ্মনাম ব্যবহার করে। তাদের সবার ছদ্মনাম গুডলাক।
মিশরে ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গার আব্দুর রহমান তৌহিদ, নোয়াখালীর কাজী শরীফ ও কাজী ইসমাঈল হোসেন এবং দুবাইয়ে কুষ্টিয়ার সাদ্দাম হোসাইন। অপরদিকে লিবিয়ার বেনগাজীতে আব্দুল্লাহ নামে একজন সক্রিয়।
সিআইডি জানিয়েছে, বিভিন্ন এজেন্সির ও রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক, কর্মচারী ও তাদের দালালরা এসব মানবপাচার চক্রের সদস্য। তারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বেকার যুবকদের টার্গেট করে সচ্ছল জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে ইউরোপে পাঠানোর কথা বলে। এরপর তিন-চার লাখ টাকার বিনিময়ে তাদের অবৈধভাবে ইউরোপে পাঠানোর চেষ্টা করে। লিবিয়ায় তাদের নেওয়ার পর জিম্মি করে পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়ের চেষ্টা করে।
পাচার চক্রের আট সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। রাজধানীর গুলশান থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে পাচার চক্রের মূলহোতা কামাল উদ্দিন ওরফে হাজী কামালকে; কিশোরগঞ্জ থেকে হেলাল মিয়া, খবির উদ্দিন, শহিদ মিয়া; বরগুনার পাথরঘাটা এলাকা থেকে সজল ও ইদ্রিস আলী; গোপালগঞ্জের মকসুদপুর থেকে সেন্টু শিকদার ও নার্গিস বেগমকে। এছাড়াও সিআইডি গ্রেপ্তার করেছে গোপালগঞ্জ থেকে লিয়াকত শেখ ও জুলহাস সরদার; ফরিদপুর থেকে বাচ্চু, শেখ মাহবুব ও শেখ সাহাদুরকে।
সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফারুক হোসেন বলেন, ‘এখানে অনেক ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। হত্যা, অস্ত্র, পাচার, মানিলন্ডারিং, নির্যাতনসহ অসংখ্য অপরাধ হয়েছে। ভিকটিম অসংখ্য, তাই একাধিক মামলা হতে পারে। চাইলে ভিকটিমরাও মামলা করতে পারেন। সিআইডি বাদী হয়ে তিনটি মামলা করেছে। মামলাগুলোর তদন্ত শুরু হয়েছে।’
প্রসঙ্গত, গত ২৮ মে লিবিয়ার মিজদা শহরে মানবপাচারকারীদের হাতে ২৬ বাংলাদেশি নিহত ও ১২ জন আহত হয়েছেন। বাংলাদেশি একটি দালালচক্র উন্নত জীবনের প্রলোভন ও মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই তাদের লিবিয়ায় নিয়ে যায়। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে তাদের ইতালি হয়ে ইউরোপে প্রবেশ করানোর আশ্বাস দিয়েছিল তারা। কিন্তু, লিবিয়াতে পাচারকারী স্থানীয় চক্রটি তাদের মারধর করে মুক্তিপণ চায়। এ সময় মুক্তিপণ চাওয়া নিয়ে দ্ব›েদ্ব পাচারকারীদের স্থানীয় হোতা প্রথমে নিহত হয়। এরপর পাচারকারীদের নির্বিচার গুলিবর্ষণে ওই হতাহতের ঘটনা ঘটে।