লোহাগাড়ায় হাতির আতঙ্কে নির্ঘুম ৩ ইউনিয়নের মানুষ

96

দক্ষিণ চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় হাতি আতঙ্কে বর্তমানে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন উপজেলার কলাউজান, চরম্বা ও চুনতি ইউনিয়নের পাহাড়বেষ্টিত এলাকার অর্ধলক্ষাধিক মানুষ। গত ৭ ডিসেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪ দিনের ধারাবাহিক তান্ডবে নুরুল আলম (৩৮) নামের এক কৃষক ও শাহাব উদ্দিন (৫৫) নামের এক পাহাদারসহ দুইজন নিহত হয়েছে। হাতিরপাল এই সময়ে ২০টি বসতঘর ভাঙচুর করেছে। এসময় পাকা আমন ধান খেয়ে ও পাকা ধান নষ্ট করে অর্ধ কোটি টাকার ক্ষতি করে চলে যায় বন্যহাতির পাল। এখন প্রতিদিন উপজেলার এ তিনটি ইউনিয়নের কোনো না কোনো এলাকায় প্রতিনিয়ত হানা দিচ্ছে হাতির দল। দল বেঁধে যখন-তখন লোকালয়ে হানা দেয়ায় চরম আতঙ্কে রাত কাটাচ্ছেন এসব এলাকার কৃষক ও সাধারণ মানুষ।
উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ও খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ৮ নভেম্বর ভোরে উপজেলায় চলতি বছরে সর্বপ্রথম হানা দেয় বন্যহাতির দল। এ সময় উপজেলার চুনতি ইউনিয়নের পানত্রিশা এলাকায় পাকা আমন ধান খেতে এসে কাদায় আটকে যায় একটি হাতি। ফলে দল বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে হাতিটি। পায়ে গ্যাংগ্রিনে (পচনশীল ঘা) আক্রান্ত ছিল হাতিটি। পরে দু’দিন পর ১০ নভেম্বর হাতিটি মারা যায়। ওই সময় হাতির দলটি কৃষকদের লক্ষ লক্ষ টাকার পাকা আমন ধান খেয়ে ও নষ্ট করে পুনরায় বনে চলে যায়। এরপর বান্দরবান থেকে গত ২১ নভেম্বর বৃহস্পতিবার ভোরে উপজেলার লোহাগাড়া-কলাউজান সীমান্তে লম্বাদিঘীর পাড় এলাকায় হানা দেয় একটি হাতির দল। এ সময় কৃষকের লক্ষ লক্ষ টাকার আমন ধান খেয়ে এবং নষ্ট করে ওইদিন রাতে উপজেলার আমিরাবাদ সুখছড়ী ও চরম্বা মাইজবিলা হয়ে বান্দরবানের বনাঞ্চলে চলে যায়। ওই সময় হাতির আক্রমণে কোনো লোকজন আহত, প্রাণহানি ও বসতঘর ভাঙচুরের শিকার না হলেও কৃষকের ক্ষেত, আমন ধান ও ফসলাধির ব্যাপক ক্ষতি হয়। হাতির দলটিতে ১৪টি হাতি ছিল বলে স্থানীয়রা জানান।
এরপর গত ৭ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ৮ টার দিকে চরম্বা ইউনিয়নের মাইজবিলা এলাকার লোকালয়ের পাকা আমন ধানের বিলে অতর্কিতভাবে হানা দেয় বন্যহাতির দল। ওই সময় ধান রক্ষার্থে হাতি তাড়াতে গিয়ে হাতির আক্রমণে নির্মমভাবে প্রাণ হারান নুরুল আলম (৩৭) নামের এক কৃষক। তিনি ওই এলাকার আব্দুস ছোবহানের ছেলে। ওইদিন রাতভর তান্ডব চালিয়ে মাইজবিলার আজু মিয়া (৬০), মোক্তার আহমদ (৪০), রোফাইয়া বেগম (৩৮), জেসমিন আক্তার (৩৭) ও তফুরা খাতুন (৬০) সহ ৫ জনের বসতঘর ভাঙচুর করে হাতির পাল। পরদিন ৮ ডিসেম্বর রবিবার গভীর রাতে চরম্বা ইউনিয়নের মাইজবিলা মধুফকির পাড়ার লোকালয়ে ঢুকে পুনরায় তান্ডব চালিয়ে আব্দুস শুক্কুর (৪৮), আব্দুর রহিম (৩৮), সাদ্দাম হোসেন (২৮) ও মরিয়ম বেগম (৪৫), রাবেয়া বেগম (৪০), নাছিমা আক্তার (৩৫), আব্দুল গফুর (৩৮) ও আবু ছালেকের (২৯) সহ ৮টি বসতঘর ভাঙচুর করে হাতির দল। একইদিন রাত ১১ টার দিকে উপজেলার চুনতি ইউনিয়নের পানত্রিশা মংডুলার চর এলাকায় ১৮টি হাতি দল বেঁধে ধান ক্ষেতে হানা দেয়।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পদুয়া বন রেঞ্জের ডলু বনবিট কর্মকর্তা মোবারক হোসেন। তিনি বলেন, রাত ১১ টার দিকে লোকালয়ে প্রবেশ করে ডলু বিটের আওতাধীন সুফল প্রকল্প নামের একটি নার্সারীর প্রায় ৯-১০ হাজার গাছের চারা নষ্ট করে ফেলে। এসময় ধান ক্ষেতে হানা দিয়ে প্রচুর ধান ক্ষেত নষ্ট করে ফেলে হাতির দলটি। তবে, আলো জ্বালিয়ে ও পটকা ফাটিয়ে হাতি গুলোকে তাড়িয়ে দেয়ায় কেউ হাতাহত হয়নি।
পরেরদিন গত ৯ ডিসেম্বর সোমবার একই এলাকায় গভীর রাতে হানা দিয়ে আব্দুর রহিম (৩৫) ও দিলোয়ারা বেগমের (৩৮) বসতঘর ভাঙচুর করে। সর্বশেষ গত ১০ ডিসেম্বর মঙ্গলবার রাত ২ টার দিকে উপজেলার উত্তর কলাউজান এলাকায় একদল বন্যহাতি হানা দিয়ে তান্ডব চালায়। এসময় ওই এলাকায় নির্মাধীণ একটি ব্রিজের পাহারাদার শাহাব উদ্দিন হাতি তাড়ানোর চেষ্টা করলে হাতির দলটি তাঁকে শুঁড় দিয়ে প্যাঁচিয়ে পায়ের নিচে পিষ্ট করে। এতে তিনি ঘটনাস্থলেই নিহত হন। এছাড়াও একইদিন চরম্বা মাইজবিলা এলাকায় গভীর রাতে ধানক্ষেত ও ফসলী জমিতে তান্ডব চালিয়ে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেছে বলে নিশ্চিত করেছেন চরম্বা ইউনিয়নের মাইজবিলা ৭নং ওয়ার্ড মেম্বার জয়নাল আবেদীন। তিনি জানান, চরম্বা মাইজবিলা এলাকায় বন্যহাতির দল পরপর ৪ দিন ধারাবাহিকভাবে হানা দিয়ে নুরুল আলম নামের এক কৃষককে মেরে ফেলেছে এবং মাইজবিলা এলাকার ২০টি বসতঘর ভাঙচুর করেছে। এসময় হাতির দলটি অন্তত ১০ একর পাকা আমন ধান এবং ১২ একরের মত সবজিক্ষেত নষ্ট করেছে। সব মিলিয়ে চরম্বা এলাকায় ৩০ লক্ষ টাকার ক্ষয়-ক্ষতি করেছে।
এদিকে, সন্ধ্যা নামলেই হাতির পাল পাকা আমন ধান খাওয়ার জন্য বন থেকে ধান ক্ষেতে চলে আসছে প্রতিনিয়ত। নষ্ট করে চলেছে কৃষকের পাকা ধান ও ক্ষেত। তাই হাতির আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে ওইসব এলাকার লোকজন।
চুনতি পানত্রিশার স্থানীয় কৃষক আবদুর রশিদ জানান, হাতির পাল দিনের বেলায় পাহাড়ি এলাকায় আশ্রয় নিলেও সন্ধ্যার পর দল বেঁধে চলে আসে ধান ক্ষেতে। এলাকায় বন্যহাতির পাল প্রতি রাতেই লোকালয়ে হানা দিচ্ছে। ধান ক্ষেতে ঢোকার আগে স্থানীয় কৃষকরা আলো জ্বালিয়ে, পটকা ফাটিয়ে হাতি তাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।
ধান ক্ষেত রক্ষা করতে কৃষকরা প্রতিদিন জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়ে তাদের ক্ষেত পাহারা দিচ্ছে। হাতি তাড়াতে বন বিভাগের কার্যকরী কোনো ভ‚মিকা না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ওই এলাকার কৃষকরা।
চুনতি পানত্রিশা চাম্বি খাল পানি ব্যবস্থাপনা সমিতির সভাপতি মাস্টার মাহবুবর রহমান এসবের সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, গ্রামের প্রায় মানুষ এখন নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। সন্ধ্যা হলেই গ্রামে হাতি ঢুকে ফসলের ক্ষতি করছে। প্রাণের ভয়ে পাহাড়ি এলাকার জমিগুলোতে কৃষকরা চাষাবাদ বন্ধ করে দিতে পারে বলেও আশংকা করছেন মাহবুবর রহমান।
চুনতি বীর বিক্রম জয়নুল আবেদীন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আক্কাস আলী জানান, গত কয়েকদিন ধরে আমার স্কুলের পাশে হাতির পাল দেখেছি। এলাকার মানুষ মশাল জ্বালিয়ে ও ঢাকঢোল পিটিয়ে হাতি তাড়ানোর চেষ্টা করছে।
চুনতি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন জনু বলেন, হাতি মারার নিয়ম নাই। ভয় দেখিয়ে তাদের বনে ফেরত পাঠানোর জন্য এলাকাবাসীকে সচেতন করা হয়েছে। বনবিভাগ ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করার জন্য ইউনিয়ন পরিষদে ফরম পাঠিয়েছে এবং আমরা সেভাবে কাজ করছি।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের চুনতি রেঞ্জ কর্মকর্তা মনজুরুল আলম জানান, আমরা বিষয়টি নিয়ে অবগত আছি। সত্যি কথা বলতে ক্ষেতে ধান পাকলে ফসলি জমিতে পাহাড়ি হাতির আনাগোনা বেড়ে যায়। হাতিদের বিরক্ত না করলে হাতিরা সচরাচর মানুষের উপর আক্রমনাত্মক হয় না। হাতিরা যে পরিমাণ ফসলের ক্ষতি করবে তা নির্ধারণ করে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সরকারি বিধান রয়েছে।
বন ছেড়ে হাতি কেন লোকালয়ে?
গত দুই বছর ধরে চট্টগ্রাম অঞ্চলে বার বার পাহাড় ছেড়ে লোকালয়ে চলে আসছে বন্যহাতি। হাতির আক্রমণে প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। বন্যপ্রাণী গবেষকদের মতে, তিন কারণে বন ছেড়ে হাতি এখন লোকালয়ে চলে আসছে। মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের আবাসস্থল তৈরির জন্য কক্সবাজারের ‘হাতির অভয়ারণ্য’ বন-জঙ্গল কেটে সাফ করা হয়েছে। যে কারণে হাতির আবাস ও চলাচলের জায়গা সংকুচিত হয়ে গেছে। সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ায় ও স্থলমাইন স্থাপনের কারণে হাতি মিয়ানমারে যেতে পারছে না এবং বন-জঙ্গলে হাতির খাদ্যের ব্যাপক অভাব দেখা দিয়েছে।
গবেষকরা আরো বলছেন, হাতিকে পাহাড়ে রাখার পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারলে কিংবা তার চাহিদা মেটাতে না পারলে ভবিষ্যতে এই অঞ্চলের পাহাড়ের নিকটবর্তী আরও বিভিন্ন এলাকা আক্রান্ত হবে, যেখানে অতীতে কখনো হাতির বিচরণ দেখা যায়নি। আর হাতির আক্রমণে মানুষের মৃত্যুর জন্য সনাতন পদ্ধতিতে হাতি তাড়ানোর কৌশল, কৌতুহলী জনতার অতি উৎসাহী আচরণ এবং সচেতনতার অভাবকে দায়ী করেছেন সংশ্লিষ্টরা।