লাল নীল প্রজাপতি

181

পড়ন্ত বিকেল। বেলকনিতে বসে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি নেমেছিল। এখন বৃষ্টি ভেজা মিষ্টি রোদ। আকাশে পাখি উড়ছে। একটা দুইটা নয়। ঝাঁকে ঝাঁকে। কাছে দূরে কিংবা বহুদূরে। কোন অজানা সুখের খোঁজে। পাখিদের চোখেমুখে প্রশান্তির ছাপ। দেখে মনে হচ্ছে অনেক অনেক দিনের পর ওরা সুনীল আকাশের বুকে প্রত্যাশিত ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে। নির্মল বাতাসে প্রাণ ভরে ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে। বাতাসে কিচিরমিচির সুর তুলে পৃথিবীকে তারা জানান দিচ্ছে তাদের খুশির বার্তা। এ এক অনিন্দ্য সুন্দর অনুভূতি!
একটুপর বেলকনি থেকে সামান্য দূরে স্থির দাঁড়িয়ে থাকা কদমফুল গাছটির দিকে আমার দৃষ্টি পড়ে। অসংখ্য পাতার মাঝে লুকিয়ে থাকা পেয়ারার মতো ঝুলানো কদমফুল যেন আমার দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হাসছে। আমি গভীর মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করি। দখিনা বাতাসে পাতার ফাঁক দিয়ে ফুলগুলো এদিক সেদিক নড়ছে। দেখে মনে হচ্ছে আমার মনের কষ্ট তাড়াতে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ দেখি গাছটির একটি ডালে পাতার ফাঁকে মাথা বের করে কদমফুলে পরপর কয়েকবার ঠোকর মারে একটি কাক। আমি অপলক দৃষ্টিতে আরও উদগ্রীব হয়ে চেয়ে থাকি। খানিকক্ষণ পরে কাকটি এদিক ওদিক তাকায়। আমার দিকে চোখ পড়তেই ডাল থেকে উড়াল দেয়। আমি অবাক হলাম। তবে কী আমায় দেখে সে লজ্জায় উড়ে গেছে!
এর মধ্যে আমার স্নেহা মামণি আব্বু! আব্বু! বলে ডাক শুরু করে দিয়েছে।
আমি পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখি আমাদের বেলকনির দক্ষিণ কোণের ছোট্ট ফুলবাগানে খেলছে সে। আমার আসতে খানিক দেরি দেখে স্নেহা ব্যস্ত গলায় বলল,
-আব্বু, জলদি এসো। ওরা চলে যাচ্ছে তো।
আমি ওর কাছে এসে হাঁটুগেড়ে বসে বললাম,
-কই মামণি, কারা চলে যাচ্ছে?
-ঐ যে দুইটা পাতা দেখছো, ওগুলো আমাদের গাছের পাতা। আমি একটু আগে গাছে দেখেছি। গাছের পাতায় হাত রাখতেই উড়াল দিলো। আচ্ছা, আব্বু, গাছের পাতা কেমন করে উড়তে পারে? স্নেহার কথায় আমি না আর হেসে পারলাম না। এরপর ওকে আদর করে বললাম,
– ওগুলো গাছের পাতা নয়, মামণি। ওগুলো হলো প্রজাপতি। লাল নীল প্রজাপতি।
স্নেহা চোখ কপালে তুলে বলল,
-তা কেমন করে হয়? আমি নিজের চোখে দেখলাম, ওরা গাছে ছিল। আমার হাতের ছোঁয়া পেতেই উড়াল দিলো। আর তুমি বলছো, গাছের পাতা না; প্রজাপতি।
আমার তিন বছর বয়সী কন্যা স্নেহার মিষ্টি গালে চুমু খেয়ে বললাম,
– শোন মামণি, ওগুলো আসলেই প্রজাপতি। গাছের পাতা হলে উড়তে উড়তে একসময় নিচে পড়ে যাবে। আর প্রজাপতি হলে মাটিতে পড়বে না। দ্যাখো, ওরা উড়ে উড়ে কোন দিকে যাচ্ছে?
এই কথা বলে আমি পাশের বেডরুমে চলে আসি।
আর স্নেহা একদৃষ্টে প্রজাপতি জোড়ার দিকে তাকিয়ে আছে। ওরা বেশ খানিকক্ষণ ওড়ার পর আবার বেলকনির দিকে আসতে লাগলো। ওদের আসতে দেখে স্নেহার সে কী আনন্দ! সে চিৎকার করে আমায় ডাকতে থাকে,
-আব্বু! আব্বু! তাড়াতাড়ি এদিকে এসো। ওরা আবার আসছে।
আমি তড়িঘড়ি করে বেলকনির দিকে ছুটে আসি। স্নেহা আমায় হাতের ইশারা করে আস্তে করে বলে,
-এখান থেকে দেখো। ওদিকে আর যেয়ো না। নইলে তোমার ছোঁয়া পেলে ওরা আবার উড়াল দেবে।
আমি আগ্রহ নিয়ে বললাম,
-ওরা কী মাটিতে পড়েছিল?
– না, পড়েনি। কিছুক্ষণ উড়ে উড়ে ক্লান্ত হয়ে আবার ফিরে এসেছে।
-তাহলে এখন নিশ্চয় বুঝতে পেরেছো, ওরা গাছের পাতা নয়; প্রজাপতি।
স্নেহা ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে বলল,
-হ্যাঁ, বাবা ওরা আসলে প্রজাপতি।
ওর প্রজাপতি চেনার বিষয় আমার খুব ভালো লেগেছে।
হঠাৎ স্নেহা আমায় প্রশ্ন করে বসে,
-আচ্ছা, আব্বু প্রজাপতি কোথায় বাস করে?
-প্রজাপতি ঠিক বাসা তৈরি করে বাস করে না। যে কোনো ধরনের গাছের ডালে, ঝোপঝাড়ে, ইটের খাঁজে, বিল্ডিংয়ের মাঝের ফাঁকা জায়গায় ওরা বাস করে।
-ওরা তো অনেক ছোট। তাহলে কী খেয়ে বাঁচে?
– প্রজাপতির মূল খাবার হলো ফুলের মধু। তবে ফুলের রেণু, গাছের রস, পাকা ফলের রস, পঁচা মাংস এমন অনেক ধরনের খাবার গ্রহণ করে।
-ওদের ধরে একটু আদর করি, আব্বু।
-না, না, এ কাজ কখনো করো না। ওদের শরীর খুব নরম। ধরলে অল্পতেই ওদের ডানা ছিঁড়ে যেতে পারে। ওরা মারাও যেতে পারে।
ততক্ষণে স্নেহা আমার কোলে উঠে বলল,
-আব্বু, আমি কখনো ওদের ধরব না। ওদের কষ্ট দেব না।
এরপর ওকে নিয়ে আমি ড্রয়িংরুমের দিকে চলে আসি।

হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজ শুনে দরজা খুললাম। আমার স্ত্রী ছাদ থেকে ফিরেছে। সাথে আমার ছেলে সায়ীদও। আমি তখন স্নেহার সাথে গল্প করছি।
সায়ীদের বয়স সাত বছর। এবছর সে প্রথম শ্রেণিতে ওঠেছে। পড়াশোনায় ভালো। কিন্তু পড়তে বসতে চায় না। সারাক্ষণ দুষ্টুমিতে পড়ে থাকে।

প্রায় মিনিট দশেকের মতো সায়ীদের কোন সাড়াশব্দ নেই। এরপর বেলকনি থেকে ছুটে এসে সে উৎফুল্ল হয়ে বলল,
-আব্বু, দ্যাখো এতক্ষণ আমি কী কাজ করেছি!
এই বলে সে প্লাস্টিকের ছোট্ট একটা কৌটা বের করে দেখায়। আমি অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। তাকে কিছু বলতে যাব এমন সময় স্নেহা হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো।
স্নেহার কান্না দেখে সায়ীদ রীতিমতো ভয় পেয়ে গেল।

প্লাস্টিকের কৌটার ভেতর দুইটি প্রজাপতি।
লালটির একটি ডানা ভাঙা। আর নীলটির দেহের কিছু অংশ ছিঁড়ে গেছে।
স্নেহা কান্না জড়িত কন্ঠে বলল,
-আব্বু, সায়ীদ ভাইয়া, আমার প্রজাপতির ডানা ভেঙে দিয়েছে। তুমি ওকে মারো।
আমি সায়ীদকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
-বাবা, তুমি একি করলে! প্রজাপতিগুলো তো আধমরা হয়ে গেছে। ওদের এভাবে ধরলে কেন? আবার রেখেছো প্লাস্টিকের কৌটার ভেতরে!
-কৌটায় রাখলে কী ওদের খারাপ লাগে, আব্বু?
সায়ীদের এমন প্রশ্নে আমি রাগান্বিত হয়ে বললাম,
-অবশ্যই খারাপ লাগে। সায়ীদ, তোমার নাকটা একটু চেপে ধরো। খারাপ লাগলে কিন্তু ছেড়ে দেবে।

আমার কথামতো সায়ীদ নিজের নাক চেপে ধরলো। কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দিয়ে কান্নার সুরে বলল,
– আব্বু, তুমি আমায় নাক চেপে ধরতে বললে কেন? আরেকটু হলে তো আমি মরেই যেতাম।
এই বলে সে কাঁদতে লাগলো।
আমি তার কান্না থামিয়ে বললাম,
-নাক চেপে ধরায় তুমি ঠিকমতো শ্বাস-নিঃশ্বাস নিতে পারছিলে না। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে তোমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। এবার ভাব, তুমি যখন প্রজাপতি দুটিকে প্লাস্টিকের বদ্ধ কৌটায় রেখেছো তখন ওদেরও তো এমনটি লেগেছে। তোমার মতো ওরাও প্রাণী। ওদেরও তো আমাদের মতো শ্বাস-নিঃশ্বাসের প্রয়োজন হয়।
আমার কথা শুনে সায়ীদ লজ্জায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
আমি আবার বললাম,
-তোমার সামান্য আনন্দ যদি অন্য কারোর কষ্টের কারণ হয় তবে সেরকম আনন্দের কোন মানে হয় না। দাও, কৌটাটা আমার হাতে দাও।

সায়ীদের হাত থেকে নিয়ে আমি কৌটার মুখ খুলে দিলাম। মুক্তির পথ পেয়েও প্রজাপতিগুলো কৌটা ছেড়ে পালাচ্ছে না। আমি আলতোভাবে ওদের কৌটার বাইরে বের করলাম।
একটুপর নীল প্রজাপতিটি কাঁপা কাঁপা দেহে উড়াল দিল। লাল প্রজাপতিটি উড়বার জন্য অনেক চেষ্টা করলো। কিন্তু একবার উড়তে গিয়ে আবার মেঝেতে পড়ে গেল।
সায়ীদ দৌড়ে গিয়ে ওর পড়ার রুম থেকে একটা কাগজ এনে বলল,
-আব্বু, এই কাগজের টুকরোয় প্রজাপতিটি নিয়ে নিই। এরপর বেলকনিতে ফুল গাছের পাশে রেখে দিই। যখন ভালো হবে তখন উড়ে চলে যাবে। আমি একটু পরপর গিয়ে ওকে দেখবো। এই তোমাকে ছুঁয়ে কথা দিচ্ছি, আর কোনদিন কারো মনে কষ্ট দেব না।