লামায় পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত নিচু এলাকা

38

গত কয়েক দিনের বর্ষণের ফলে উজান থেকে নেমে আসা সৃষ্ট পাহাড়ি ঢলের পানিতে লামা পৌর এলাকাসহ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের নিচু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। মাতামুহুরী নদী, লামাখাল, বমুখাল, ইয়াংছা খাল, বগাইছড়িখাল, ইয়াংছা খাল ও পোপা খালসহ বিভিন্ন স্থানের পাহাড়ি ঝিরিগুলোতে অস্বাভাবিকভাবে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় গৃহবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় ১৫ হাজার মানুষ। কর্মহীন হয়ে পড়েছে ওইসব এলাকার শ্রমজীবী মানুষগুলো। একই সাথে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে পাহাড়ধসও দেখা দিয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার নাগাদ মাতামহুরী নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। এদিকে প্রবল বর্ষণে পাহাড়ধসে প্রাণহানির আশঙ্কায় ইতোমধ্যে উপজেলা প্রশাসন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদগুলোর পক্ষ থেকে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের নিরাপদ আশ্রয় নেয়ার জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে ও মাইকিং করে তাগাদা দেয়া হয়। দুর্যোগ কবলিতদের জন্য ৫৫টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এ টানা ভারি বর্ষণ অব্যাহত থাকলে ভয়াবহ বন্যাসহ পাহাড়ধসে মানবিক বিপর্র্যয়ের আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।
স্থানীয় সূত্র জানায়, গত শুক্রবার রাত থেকে মুষলধারে বর্ষণ শুরু হয়। আর এ টানা বর্ষণের ফলে সৃষ্ট পাহাড়ি ঢলের পানিতে উপজেলায় অবস্থিত নদী, খাল ও ঝিরির পানি ফুঁসে উঠে পৌরসভা এলাকার নয়াপাড়া, বাসস্ট্যান্ড, টিএন্ডটি পাড়া, বাজারপাড়া, গজালিয়া জিপ স্টেশন, লামা বাজারের একাংশ, চেয়ারম্যান পাড়ার একাংশ, ছোট নুনারবিলপাড়া, বড় নুনারবিলপাড়া, উপজেলা পরিষদের আবাসিক কোয়ার্টার সমূহ, থানা এলাকা, ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের ইয়াংছা বাজারসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের নিচু এলাকা প্ল­াবিত হয়। এতে পৌর এলাকার হলিচাইল্ড পাবলিক স্কুলসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি বেসরকারি সংস্থার কার্যালয়সহ শতশত ঘরবাড়ি, দোকানপাট রয়েছে। আবার অতি বৃষ্টির কারণে বিভিন্ন স্থানে পাহাড়ধস দেখা দিয়েছে। গত কয়েক দিনে লামা-ফাঁসিয়াখালী সড়কের লাইনঝিরি ও মিরিঞ্জা এলাকায় এক পাশের মাটি ধসে পড়েছে। এছাড়া ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের বড়ছন খোলা এলাকার ব্রিজ, পৌরসভা এলাকার মাস্টার পাড়া ও মধুঝিরি আনসার ভিডিপি কার্যালয় সংলগ্ন পূর্বপাড়া শাহাদাতের বাড়ির পাশের ব্রিজটি পানির স্রোতের টানে দেবে গেছে। এতে ওই এলাকার হাজার হাজার মানুষ দুর্ভোগে পড়েন। একই সময় উপজেলার বিভিন্ন স্থানের গ্রামীণ সড়কগুলো ধসে পড়েছে বলেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন। অন্যদিকে লামা আলীকদম সড়কের কেয়ারারঝিরি এলাকা পানিতে ডুবে যান চলাচলসহ যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। মাতামুহুরী নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় ও নদীর চাম্পাতলী এলাকার পশ্চিম পাশে সরু হওয়ায় দ্রæত পানি নামতে না পারায় এ বন্যার সৃষ্টি হয় বলে স্থানীয়দের দাবি। তারা বলেন, গজালিয়া ইউনিয়নের সাফমারা ঝিরি এলাকায় একটি ঝিরি কেটে নদীর গতি পরিবর্তন করলে বন্যা থেকে রক্ষা পাবে পৌরসভা এলাকার ৪০ হাজার মানুষ।
ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জাকের হোসেন মজুমদার জানান, পাহাড়ি ঢলের পানিতে ইয়াংছা বাজারের একাংশ প্লাবিত হয়েছে। পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণদের নিরাপদে সরে যাওয়ার জন্য তাগাদা দেয়া হয়। এদিকে খাল ও ঝিরির পানি বৃদ্ধি পেয়ে লামা পৌরসভা, লামা সদর, গজালিয়া, ফাইতং, ফাঁসিয়াখালী, আজিজনগর, সরই ও রুপসীপাড়া ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানের প্রায় ১৫ হাজার মানুষ গৃহবন্দি হয়ে দুর্ভোগে রয়েছে বলে জানান স্থানীয় জনপ্রতিধিরা। বৃহস্পতিবার এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বর্ষণ অব্যাহত থাকায় নতুন করে ঘরবাড়ি প্লাবিত হচ্ছে। বাজারের ব্যবসায়ীরা তাদের মালামাল এবং উপজেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি দপ্তর সমূহ মালামাল ও নথিপত্র নিরাপদে সরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
লামা বাজার পাড়ার বাসিন্দা ও ব্যবসায়ী মো. সেলিম, জাকির হোসেন, পিপলুসহ আরো অনেকে বলেন, প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে ৪-৫ বার পাহাড়ি ঢলের পানিতে শত শত ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্লাবিত হয়। পানি ওঠার সময় ঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালামাল নিয়ে বেকায়দায় পড়তে হয়। এমনকি বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। প্রতিবারের মত এবারও প্রথম বারের মত প্লাবিত হচ্ছে লামা বাজার।
লামা বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাপান বড়–য়া জানান, গত কয়েক দিনের বর্ষণে বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ঢলের পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে ব্যবসায়ী ও পরিবারগুলো তাদের মালামাল নিরাপদে সরিয়ে নিচ্ছেন। দ্রæত পানি বৃদ্ধির কারণে কেউ কেউ আবার ক্ষতির সম্মুখিন হয়। অতি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের কারণে পৌর এলাকাসহ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে চলতি মৌসুমের বীজতলা এবং বিভিন্ন ফসলাদি পানির নিচে তলিয়ে গেছে বলে কৃষকরা জানিয়েছেন।
পাহাড়ি ঢলে লামা পৌরসভার নিম্ন এলাকা প্লাবিত হওয়ার সত্যতা নিশ্চিত করে পৌরসভার মেয়র মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, পৌরসভার কাউন্সিলরদের সমন্বয়ে বন্যার পরিস্থিতি সার্বক্ষণিক তদারকি করার জন্য কমিটি গঠন করার পাশাপাশি প্লাবিত লোকজনকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার জন্য নৌকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রিত ও পাহাড়ি ঢলে প্লাবিতদের মধ্যে শুকনো খাবার ও খিচুড়ি বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এদিকে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও আশ্রিতদের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়। দুর্যোগকালীন সময় জরুরি প্রয়োজনে যোগাযোগের জন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে।
লামা উপজেলা নির্বাহী অফিসার নূর-এ-জান্নাত রুমি বলেন, পাহাড়ে ঝুঁকিপুর্ণ বসবাসকারীদের নিরাপদে সরে যাওয়ার জন্য আগে থেকেই প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ও মাইকিং এর মাধ্যমে বারবার তাগিদ দেয়া হয়েছে। এছাড়া দুর্যোগকালীন উপজেলার বিভিন্ন স্থানের ৫৫টি বিদ্যালয়কে আশ্রয় কেন্দ্র ঘোষণা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে পৌরসভা এলাকার ২৬ পরিবারসহ বেশ কয়েকটি পরিবার আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। তাছাড়া পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃপক্ষকেও ঝুঁকিপুর্ণ বসবাসকারীদের নিরাপদে সরে যাওয়ার জন্য তাগিদ দিতে বলা হয়েছে। জরুরি প্রয়োজনে যোগাযোগের জন্য কন্ট্রোল রুমও খোলা হয়েছে।