লাগেজের আড়ালে বেড়েছে সিগারেটের চোরাচালান

96

শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে আমদানি নিষিদ্ধ বিদেশি সিগারেটের চোরাচালান বেড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দুবাইভিত্তিক সংঘবদ্ধ চোরাচালান চক্র লাগেজের আড়ালে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিদেশি সিগারেট বিমানবন্দর দিয়ে দেশের বাজারে নিয়ে আসছে। শুল্ক ফাঁকির সিগারেটের এই কারবারে সব খরচ বাদ দিয়েও চোরাকারবারিদের দ্বিগুণ লাভ। প্রতি বছর বাজেটে সিগারেটের ওপর শুল্ক বৃদ্ধির কারণে দেশে উৎপাদন ও বাজারজাতকৃত সিগারেটের মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় শুল্ক ফাঁকির ভিনদেশি এসব সিগারেটের চাহিদাও বাড়ছে ব্যাপকভাবে।
অভিযোগ রয়েছে, বিমানবন্দরে দায়িত্বে নিয়োজিত কতিপয় শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করেই বিমানবন্দরের বাধা ডিঙিয়ে দেশের বাজারে ঢোকে ভিনদেশি এসব সিগারেট। সিগারেটের চালান বিমানবন্দরে আসার আগেই তাদের পকেটে চুক্তিবদ্ধ টাকা পৌঁছে দেয় চোরাকারবারিরা। বিমানবন্দরে কে কখন দায়িত্বরত রয়েছেন সেই তথ্য কর্মকর্তারাই ফোনে নিশ্চিত করেন চোরাকারবারিদের। তথ্য পাওয়ার পর বহনকারীদের সিগারেটভর্তি লাগেজসহ দুবাই কিংবা শারজাহ বিমানবন্দর দিয়ে ফ্লাইটে তুলে দেন চোরাচালান চক্রের সদস্যরা। ফ্লাইট অবতরণের পর বহনকারীকে সিগারেটভর্তি লাগেজসহ বিমানবন্দরের বাধা ডিঙাতে বেগ পেতে হয়না। চুক্তির হেরফের কিংবা নির্ধারিত কর্মকর্তা কোনও কারণে দায়িত্বে না থাকলেই কেবল ধরা পড়ে সিগারেটের চালান। তবে বিমানবন্দর কাস্টমস এর যুগ্ম কমিশনার নাহিদ নওশাদ মুকুলের দাবি, দায়িত্বরত কাস্টমস কর্মকর্তাদের যোগসাজশের অভিযোগ সত্য নয়। সেরকম হলে গত পক্ষকালের ব্যবধানে বিমানবন্দরে পরপর তিনটি বিদেশি সিগারেটের চালান আটক হত না। বরং বর্তমানে দায়িত্বরত কাস্টম কর্মকর্তাদের নজরদারি যে কোনও সময়ের তুলনায় বেশি হওয়ায় চোরাচালান প্রতিরোধ সম্ভব হয়েছে।
বিমানবন্দর কাস্টমস সূত্র জানায়, গত ২৮ আগস্ট সকালে শাহ আমানত বিমানবন্দরে দুবাই থেকে আসা বিজি-১৪৮ ফ্লাইটটি অবতরণের পর তিন যাত্রীর কাছ লাগেজ থেকে ৮১৪ কার্টন বিদেশি সিগারেট জব্দ করা হয়। যার আনুমানিক বাজারমূল্য ১২ লাখ ২১ হাজার টাকা। এর দু’দিন আগে গত ২৬ আগস্ট একই ফ্লাইটে আসা ৫৪৭ কার্টনে আনা এক লাখ ৯ হাজার ৪০০ শলাকা সিগারেট ও রিদমি ব্র্যান্ডের ২০টি মোবাইল সেটও পরিত্যক্ত অবস্থায় জব্দ করা হয়। তারও আগে গত ১৫ আগস্ট বিকেলে কয়েকটি লাগেজ নিয়ে সন্দেহ হওয়ায় সেগুলো তল্লাশি করে এক হাজার ৯৫০ কার্টন বিদেশি সিগারেট আটক করে কাস্টমস কর্মকর্তারা। গত ১০ আগস্ট এয়ার এরাবিয়ার (জি-৯ ৫২৩) ফ্লাইটে শারজাহ থেকে চট্টগ্রামে আনা হয় এ চালানটি। জব্দ করা সিগারেটের মধ্যে ‘৩০৩’ ব্র্যান্ডের এক হাজার ৪১০ কার্টনে ২০০ করে মোট দুই লাখ ৮২ হাজার শলাকা এবং ‘ইজি’ ব্র্যান্ডের ৫৪০ কার্টনে এক লাখ আট হাজার শলাকা রয়েছে। যার আনুমানিক বাজারমূল্য প্রায় ১৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালের ২৯ এপ্রিল ফেল্ট (এক ধরনের ফোম) আনার ঘোষণা থাকলেও ‘৩০৩’ ও ‘মন্ড’ ব্র্যান্ডের ৬৫০ কার্টন সিগারেট আনা হয়েছে। যার মূল্য ১৩ কোটি টাকা। কাস্টমস কর্তৃপক্ষের দাবি, বিমানবন্দরে এ পর্যন্ত আটক হওয়া বিদেশি সিগারেটের মধ্যে সেটিই সর্ববৃহৎ চালান। ওই বছরের ৭ মে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ৬৬ লাখ ৯৪ হাজার পিস সিগারেট পাওয়া যায়। শুল্কসহ যার আনুমানিক মূল্য ১০ কোটি ৪ লাখ টাকা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশে প্রচলিত আইনানুযায়ী সব সিগারেটের প্যাকেটে ‘ছবিযুক্ত সংবিধিবদ্ধ সতর্কতা’ এবং ‘রাজস্ব স্ট্যাম্প’ ব্যবহারে বাধ্যবাধকতা থাকলেও শুল্কফাঁকির ভিনদেশি এসব সিগারেটের প্যাকেটে কিছুই সে ধরণের কিছুই থাকে না। এমনকি মেয়াদোর্ত্তীণের তারিখও নেই। বিদেশি সিগারেট আমদানিতে ৩৫০ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। দেশের বাজারে প্রতি বছর প্রায় ৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা মূল্যের ভিনদেশি সিগারেট বেচাকেনা হয়। এসব সিগারেট থেকে আমদানি শুল্ক আদায় করতে পারলে বছরে প্রায় একশ’ ৩০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় বাড়ত।
নগরীর বিভিন্ন অভিজাত শপিং মল ছাড়াও পাইকারি পণ্যের বৃহত্তম বাজার রিয়াজউদ্দিন বাজারে ৩০ থেকে ৪০টি দোকানে প্রকাশ্যেই প্রতিদিন গড়ে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকার বিদেশি সিগারেট বেচাকেনা হয়। নগরীর তিনটি পাইকারি বাজারে প্রতিদিন প্রায় ১৫ থেকে ২৫ লাখ টাকার অবৈধ সিগারেট কেনাবেচা হয়। সে হিসাবে মাসে প্রায় আট কোটিরও বেশি টাকার অবৈধ সিগারেট বিক্রি হচ্ছে। যার পরিমাণ বছরে দাঁড়ায় ১০০ কোটি টাকা। ঢাকার কিছু কিছু স্থানে পাইকারি হারে বিক্রি হলেও চট্টগ্রামেই মূল ঘাঁটি বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। এসব দোকানে বিক্রি হওয়া বিদেশি সিগারেটের মধ্যে রয়েছে, ইজি স্পেশাল গোল্ড, মন্ড, স্ট্রবেরি, ভন ইন্টারন্যাশনাল, উইনস্টোন, গ্রান্ড-২০০০, ইজি অউরা, বø্যাক, মালবোরো, উলসন ল্যান্ড এম, ত্রি জিরো ত্রি, মডার্ন, ডাবল হ্যাপিনেস ও ডানহিলসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সিগারেট।
বিক্রেতারা জানান, মূলত সমুদ্রবন্দর এবং বিমানবন্দর দিয়ে শুল্ক ফাঁকি মাধ্যমে সিগারেটগুলো নিয়ে আসা হয়। বন্দর-কাস্টমস কর্মকর্তা ও পুলিশের সঙ্গে যোগসাজশে চোরাকারবারিরা এই কাজটি করে থাকেন। এসব চোরাই সিগারেট কেনাবেচার নির্দিষ্ট কিছু লোক আছে। ফোন করে খবর দিলেই তারা এসে দোকানে দোকানে সিগারেট দিয়ে যায়। এখন খুচরা বিক্রেতাদের এসব সিগারেট কিনতে বা বিক্রি কোনও ঝক্কি পোহাতে হয় না।
দেশে উৎপাদন ও বাজারজাতের সাথে যুক্ত সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশে উৎপাদিত প্রিমিয়াম সেগমেন্টের ২০ শলাকা সিগারেটের মূল্য ১৮২ টাকা। উচ্চ সেগমেন্টের ২০ শলাকার এক প্যাকেট সিগারেটের দাম ১০৮ টাকা। আর বিদেশ থেকে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আনা এসব সিগারেটের ২০ শলাকার প্যাকেট বিক্রি করা হয় ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা। যেমন মন্ড স্ট্রবেরি, মন্ড আপেল এই ২০ শলাকার একটি প্যাকেটের দাম মাত্র ৯০ থেকে ৯৫ টাকা। যা দেশের প্রিমিয়াম সেগমেন্টের ২০ শলাকার সিগারেটের চাইতে অনেক কম। ফলে এসব সিগারেটের চাহিদাও বেশি। কিন্তু আমদানি শুল্ক দিয়ে বৈধপথে আনলে ২০ শলাকার এক প্যাকেট সিগারেট প্রায় তিনগুণ দামে বিক্রি হত। চোরাকারবারিরা শক্তিশালী নেটওয়ার্কের মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর, চীন ও দুবাই থেকে অবৈধ পথে এসব সিগারেট আনছে। দেশি প্রিমিয়াম ব্র্যান্ডের সিগারেট বিক্রির চেয়ে খুচরা বিক্রেতারা শুল্ক ফাঁকির সিগারেট বিক্রি করলে পাঁচগুণ বেশি মুনাফা পায়।