লঘুচাপে সওয়ার হচ্ছে বৃষ্টিবলয়

62

আষাঢ়ের মাঝামাঝি এসে উত্তর বঙ্গোপসাগরে যে লঘুচাপ সৃষ্টির সম্ভাবনা আবহাওয়াবিদরা দেখছেন তাতে একটি শক্তিশালী মৌসুমী বৃষ্টিবলয়ও সওয়ার হচ্ছে। তার মানে, আষাঢ়ের প্রথম পক্ষে বিক্ষিপ্তভাবে বৃষ্টিধারার লুকোচুরি পরিলক্ষিত হলেও শেষ পক্ষে চেনারূপেই ধরে দিতে যাচ্ছে বর্ষা। সক্রিয় মৌসুমী বায়ুর সাথে সাগরে সৃষ্ট লঘুচাপ আর বৃষ্টিবলয়ের সম্মিলনে এবার মধ্য আষাঢ়েই দেশজুড়ে নেমে আসতে যাচ্ছে বর্ষার প্রত্যাশিত বৃষ্টিধারা।
আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণকারী বিভিন্ন সংস্থার পূর্বাভাস বলছে, মৌসুমী বায়ুর সক্রিয় থাকাবস্থায় চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই উত্তর বঙ্গোপসাগরে একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হতে পারে। আষাঢ়ের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরুর পর চলতি বর্ষা মৌসুমে এটিই হবে সাগরে সৃষ্ট প্রথম লঘুচাপ। তার ওপর দেশের দক্ষিণাঞ্চল দিয়ে দুই ধাপে সওয়ার হচ্ছে শক্তিশালী মৌসুমী বৃষ্টিবলয়। যার প্রথম ধাপ শুরু হতে পারে আগামীকাল সোমবার থেকে।
পরবর্তী টানা পাঁচদিন এটি মাঝারি মাত্রায় সক্রিয় থাকতে পারে। তবে, দ্বিতীয় ধাপে ৬ জুলাই থেকে ১১ জুলাই পর্যন্ত এটি তীব্র আকারে রূপ নিতে পারে। এছাড়া, আষাঢ়ের গত পক্ষে বৃষ্টিধারার লুকোচুরির পরও চলতি বর্ষাকালে দেশে গড় বৃষ্টির পরিমাণ গতবছরের তুলনায় দ্বিগুণ হওয়ার আলামত দেখছেন আবহাওয়াবিদরা। তার মানে, মৌসুমের শেষদিকেই বাড়তি বৃষ্টিপাতের প্রবণতা দেখা যেতে পারে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ ও ঢাকা বিভাগেই বৃষ্টি বেশি হতে পারে। এতে নদনদীর পানি বেড়ে বন্যা পরিস্থিতিও সৃষ্টি হতে পারে।
অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, বাংলা ক্যালেন্ডারের পাতায় আষাঢ়ের যাত্রা শুরুর কয়েকদিন আগেই এবার টেকনাফ উপকূল দিয়ে মৌসুমী বায়ুর প্রবেশ এবং বর্তমানে তা দেশের ওপর সক্রিয় থাকলেও এবারের বর্ষা মৌসুমে এখন পর্যন্ত খন্ড-বৃষ্টিরই দেখা মিলেছে। গত কয়েকদিনে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রংপুর ও সিলেট বিভাগ এবং সীমান্তবর্তী প্রতিবেশি দেশের আসাম ও মেঘালয়ে ভারী বৃষ্টিপাতে নদনদীর পানি বেড়ে স্বল্পমেয়াদী বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। তবে, গতকাল শনিবার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বৃষ্টিúাতের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা বিভাগের যশোরে শনিবার দেশের সর্বোচ্চ ৫৫ মিলমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে। আবার একইদিন দেশের সর্বোচ্চ ৩৬ দশমিক আট ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাও ছিল যশোরেই। অবশ্য যৌথভাবে একই তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগের দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়ায়। এ বিভাগে আগের দিন সীতাকুÐ ও নোয়াখালী অঞ্চলে মাঝারি থেকে ভারী মাত্রার বৃষ্টি হলেও গতকাল শনিবার সর্বোচ্চ ৩২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে আরেক দ্বীপ উপজেলা স›দ্বীপে। অন্যান্য এলাকাগুলোর কয়েকটিতে সর্বনিম্ন এক থেকে ১৬ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রের আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ এ সপ্তাহে দেশজুড়ে বৃষ্টিপাত বাড়বে জানিয়ে গতকাল শনিবার পূর্বদেশকে বলেন, মৌসুমী বায়ু সক্রিয় থাকাবস্থায় চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই উত্তর বঙ্গোপসাগরে একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হতে পারে। এর জেরেই দেশজুড়ে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা বাড়তে পারে।’
অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে গতকাল শনিবার সন্ধ্যা ছয়টা থেকে পরবর্তী চব্বিশ ঘণ্টার জন্য প্রচারিত আবহাওয়ার দৃশ্যপটে বলা হয়েছে, মৌসুমী বায়ুর অক্ষের বর্ধিতাংশ উত্তর প্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। এর একটি বর্ধিতাংশ উত্তর-পূর্ব বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে। মৌসুমী বায়ু বাংলাদেশের ওপর সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে দুর্বল থেকে মাঝারি অবস্থায় রয়েছে। আর পূর্বাভাসে বলা হয়, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় এবং রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ ও ঢাকা বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সাথে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী বর্ষণ হতে পারে। এ সময় সারাদেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পেতে পারে।
এর আগে গত মে মাসের শেষদিকে প্রতিবেশি ভারতের আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা ওয়েদার অব ওয়েস্টবেঙ্গল এবারের বর্ষার নির্ঘন্ট ও অর্ধশত বছরের বর্ষার গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে দীর্ঘমেয়াদী পূর্বাভাস দিয়েছিল। তাতে বলা হয়, ইন্ডিয়ান ওসিয়ানিক ডাইপোল পজিটিভ হওয়া এবং এল নিনো তীব্রতা কমে যাওয়ায় উত্তর পূর্ব ভারতের অধিকাংশ রাজ্যগুলোর পাশাপাশি বাংলাদেশেও এবারের বর্ষায় স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি বৃষ্টিপাত হতে পারে। সেক্ষেত্রে এ বছর বর্ষায় ভারতের আসাম, মেঘালয়, মণিপুর ও ত্রিপুরার মত বাংলাদেশের চট্টগ্রামসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে স্বাভাবিকের থেকে অনেকগুণ বেশি বৃষ্টিপাত লক্ষ্য করা যাবে। ওয়েদার অব ওয়েষ্টবেঙ্গলের দীর্ঘমেয়াদী পূর্বাভাস অনুযায়ী, বাংলাদেশে এ বছর বর্ষায় যথেষ্ট বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে এবং কোথাও কোথাও স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকগুণ বেশি বৃষ্টিপাত হবে। স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকগুণ বেশি বৃষ্টিপাত হবে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলিতে। এর ফলে চট্টগ্রামসহ দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলো অতি ভারি বর্ষণ ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বন্যায় আক্রান্ত হতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, গত বছর অর্থাৎ ১৪২৫ বঙ্গাব্দের বৈশাখেই ‘শ্রাবণের উপস্থিতি’ আগাম বর্ষার একধরণের ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। সেই বছর মধ্য বৈশাখ পর্যন্ত দেশে যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে, তা গত সাড়ে তিন দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। তবে, এবার কালবৈশাখী মৌসুমের দৈর্ঘ্য বাড়লেও বিদায় নিতে যাওয়া গ্রীষ্মকালজুড়ে দেশের অধিকাংশ অঞ্চলে মৃদু থেকে মাঝারি মাত্রার তাপদাহ বয়ে গেছে। সিলেট, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণাসহ কিছু কিছু অঞ্চলে বিক্ষিপ্তভাবে কালবৈশাখীর দাপট পরিলক্ষিত হলেও সামগ্রিকভাবে তাপদাহেই পুড়তে হয়েছে বেশিরভাগ এলাকার মানুষকে। একটানা কয়েকবছর দেশে বর্ষাঋতুর দৈর্ঘ্য অনেকটা কমে এসেছিল। আগাম বন্যা ঠাঁই নিতে শুরু করেছিল ইতিহাসের পাতায়। কিন্তু, ২০১৭ সালে বাঁক বদল ঘটিয়ে স্বমহিমায় আবির্ভূত হয় বর্ষাকাল। ওইবছর দেশে বন্যায় শতাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটে। সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয় অর্ধ কোটিরও বেশি বন্যাদুর্গত মানুষকে। বিশেষ করে হাওরাঞ্চলের মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়। হাওরের বাঁধ ভেঙ্গে বন্যার পানিতে ফসল তলিয়ে যায়। এছাড়া, বন্যাকবলিত অন্তত ৩২টি জেলার বাড়িঘর ও ফসলাদি মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়। দেশের নদ-নদীর পানির ৯৩ শতাংশই আসে উজানের দেশগুলো অর্থাৎ নেপাল, ভারত এবং কিছুটা ভুটান থেকে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা এবং মেঘনা অববাহিকায় বৃষ্টিপাতের ওপরই বাংলাদেশে বন্যা হবে কিনা তা অনেকটাই নির্ভর করে। উজানের পাশাপাশি দেশে অতিবৃষ্টি হলে জুনের শেষ দিক থেকে ক্রমাগতভাবে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পায়। আর নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করলেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) অধীনে দেশের তিনটি নদী অববাহিকার তিনশ’ ৪৩ টি পানি সমতল পর্যবেক্ষণ পয়েন্ট রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান প্রধান নদ-নদীর ৯০টি পয়েন্ট থেকে ৫৪টি পয়েন্টে পানির উচ্চতা পর্যবেক্ষণ করে বন্যার পূর্বাভাস দেয়া হয়।