রৌদ্রের ফোয়ারা থেকে দূর অনন্তের অন্ধকারে …

402

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর উপমহাদেশের মফস্বল এলাকা বাংলার ‘জলপাইহাটি’। যুদ্ধের ধাক্কা সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে কথিত তৃতীয় বিশ্বের শোষিত নাগরিকগণ। দারিদ্রের কশাঘাতে নিষ্পেষিত নিশীথ সেন স্বল্প বেতনে ‘জলপাইহাটি’র একটি কলেজে অধ্যাপনারত। কিন্তু তিনি স্বপ্ন দেখেন আরো একটু স্বচ্ছলতার। বেতন বাড়ানোর জন্য কর্তৃপক্ষকে বার বার অনুরোধ জানাতে থাকেন। সবসময় তা অগ্রাহ্য হয়। এমনকি একবার তার আবেদন ছিঁড়ে ফেলার ঘটনাও ঘটে। অথচ তাঁর জুনিয়ররা শিক্ষক রাজনীতি ও কর্তৃপক্ষের কৃপায় স্বজনদের বেশি বেতন দিচ্ছেন। এক মাসের ছুটির দরখাস্ত দিয়ে নতুন চাকরির সন্ধানে তার স্বপ্নের শহর কলকাতায় ধনী বন্ধু জিতেন দাশগুপ্তের বাসায় উঠেন। জিতেন বিয়ে করেননি, কিন্তু নিশীথ লোকমুখে নমিতা সেন নামিয় এক মেয়েকে বিয়ের কথা শুনেছেন। সত্যিই নমিতাকে দেখে সত্যতা খুঁজে পান। যদিও বয়স্ক জিতেনের স্ত্রী, সে কিন্তু সতী-সাধ্বী নয়। একজন দ্বিচারিণি মহিলা। কলকাতায় বসবাসরত ক্লাশফ্রেন্ড যারা বিভিন্ন কলেজে দায়িত্বরত সবার কাছে একে একে চাকরির জন্য ধর্না দেন। সময়ের তুলনায় নিশীথ বেশ কিছুটা পিছিয়ে। কারণ তার বিলেতি ডিগ্রি নেই, টেকনিক্যাল জ্ঞান নেই, বয়সও আরেকটা কারণ, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সামনে নিজেকে দাঁড় করাতে পারে না। কলকাতায় গিয়ে যে যেন এক অদ্ভুত ঘূর্ণিপাকে জড়িয়ে যান। তার তৃতীয় নয়ন দিয়ে অবলোকন করেন ব্যস্ত নগরী কলকাতাকে। সেখানে শিক্ষা ব্যবসায়ীদের হাতে শিক্ষা বিপর্যস্ত, গণিকাদের ব্যস্ততায় নগরী রাতে বেলায় আরো বেশি সরব হয়ে উঠে। অবক্ষয়ের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে নগরী কলকাতা। তিনি একে একে সব জায়গা থেকে খালি হাতে ফেরত আসেন।
“তিন চার বছর ধরে কলকাতার কলেজেগুলোতে চাকরির চেষ্টা করছে সে। প্রথম বছর প্রানান্ত প্রয়াস করেছিল, অতটা হয়রানি চাকরির দিক থেকে কোনো ব্যবসার দিকে ঘুরিয়ে দিলে দাঁড়িয়ে যেতো ব্যবসাটা। … কিন্তু কলেজের চাকরিটা হল না।’ (পৃ-১৭১)
এদিকে ঘরে অসুস্থ স্ত্রী সুমনা, গোপন বিপ্লবি রাজনৈতিক দলের সদস্য পুত্র হারীত, কন্যা রানু এলাকার চরিত্রহীনদের খপ্পরে এবং ভানু অসুস্থ। কলকাতা থেকে ফেরার আগেই অসুস্থ স্ত্রী ও এক কন্যাকে হারান। একদিন পুত্র হারীত ঘর ছাড়লেও সে ফিরে আসে। এক অনিশ্চিত ভ্রমণে তিনি বেরিয়েছিলেন, কিন্তু হতাশ হয়ে ফেরেন। সবপ্রচেষ্টাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তাই বলা যায় উপন্যাসটি এক ব্যর্থ অধ্যাপকের জীবনভাষ্য বৈ আর কিছু নয়।
রূপসী বাংলার কবি, প্রেম ও প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪)। কবি হিসেবেই বাংলা সাহিত্য ও বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে অধিক পরিচিত। তিনি ঝরা পালক (১৯২৭), ধূসর পাÐুলিপি(১৯৩৬), বনলুা সেন(১৯৪২), মহাপৃথিবী (১৯৪৪), সাতটি তারার তিমির (১৯৪৮) এবং রূপসী বাংলা (১৯৫৭)সহ বিখ্যাত বিখ্যাত কবিতাগ্রন্থ লিখার জন্য বিশেষভাবে খ্যাত। বনলুা সেন, রূপসী বাংলা, ধানসিঁড়ি নদীর কথা বললেই যে নামটি স্মরণে আসে তা জীবনানন্দ দাশই। অথচ তিনি কবিতাগ্রন্থ ছাড়াও বেশ ক’টি উপন্যাসও রচনা করেছেন যা কালজয়ী। কারু বাসনা (১৯৮৬), জীবন প্রণালী (১৯৮৭), প্রেতিনীর রূপকথা (১৯৯০), জলপাইহাটি (১৯৮৫), বাসমতীর উপাখ্যান (১৯৮৮) এবং মাল্যবান (১৯৮৫) সার্থক উপন্যাস। বেশকিছু ছোটোগল্পেরও সার্থক নির্মাতা তিনি। এখানে আমরা তাঁকে একজন সার্থক ঔপন্যাসিক হিসেবে পাই। এ উপন্যাসের বুনট একটু জটিল হলেও, শক্তিশালী ভাষা-শৈলির কারণে বাংলা সাহিত্যে একটা বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
’জলপাইহাটি’ উপন্যাসের কেন্দ্রিয় চরিত্র নিশীথ সেন। শেষের দিকে নিশীথ পুত্র হারীত চরিত্রও বেশ গুরুত্ব ¡পায়। গবেষক রোখসানা চৌধুরী ‘জলপাইহাটি’ নামকরণ সম্পর্কে বলেন, ‘মূল পাÐুলিপির দ্বিতীয় খাতার ১ম পৃষ্ঠার উল্টোদিকে অস্পষ্টভাবে ‘সময়ের ঘাম’ এবং ‘ক‚লকিনারা’ লেখা দেখা যায়। কবি মনে করেছিলেন এ দ’ুটো থেকে যেকোনো একটি নাম বাছাই করবে। যেহেতু কবির মৃত্যুর পর উপন্যাসটি আলোর মুখ দেখে। পরবর্তীতে উপন্যাসটির নামকরণ করেন কবির অনুজ অশোকানন্দ দাশ।’ নিশীথ সেন চরিত্রটি জীবনানন্দের নিজের আত্মকথন বলে অধিকাংশ গবেষকই মনে করেন। অমর মিত্র বলেন, ‘জলপাইহাটি’ পড়তে পড়তে বারবার মনে হয়েছে, কাহিনির রেখাটি এখানে জীবনানন্দ দাশের নিরূপায় আশ্রয়মাত্র, তিনি বারংবার কাহিনি থেকে সরে গিয়ে আত্মকথনে মগ্ন হয়েছেন।’ অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীরও সেব্যাপারে একমু। তবে তিনি সেখানে আত্মজৈবনিকের বাইরে গিয়ে আরো দু’টি বিষয় যুক্ত করেছেন। ‘যেমন প্রথম নৈসর্গিক এবং দ্বিতীয়টি ঐতিহাসিক। নৈসর্গিক সময়বোধ যুগ যুগ ধরে তৈরি হয়। জীবনানন্দের নৈসর্গিক সময়বোধ প্রগাঢ়: নৈসর্গিক সময় এবং মানুষী সময়ের পরস্পর প্রবিষ্ট তাঁর কাজে ঘুরে ঘুরে এসেছে। এই পরস্পর প্রবিষ্টতার মধ্যে তিনি ঘটনার এবং আখ্যানের পরিসর তৈরি করেছেন। আত্মজৈবনিক সময়ের ফ্রেমে তিনি ঐতিহাসিক সময় ধরতে গিয়ে ইতস্তত, দ্বিধান্বি^ত হয়েছেন, সেজন্য তাঁর ঐতিহাসিকবোধে নৈসর্গিকবোধের গভীরতা আসেনি।’
‘জলপাইহাটি’ প্রকৃতপক্ষে কবির জন্মস্থান বরিশাল শহরই বলে অনেকে মনে করেন। উপন্যাসে বৃটিশ থেকে স্বাধীনতা, ঔপনিবেশিক শাসন, দেশ বিভাগ, দাম্পত্য সমস্যা, নারী পাচার ও ছোটখাট সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়ে বিশদভাবে নয়, সম্যক আলোকপাত করা হয়েছে। মার্ক্সবাদ ও ‘দাস ক্যাপিটালে’র কথা এসেছে ঘুরে ফিরে। বেশি আলোচিত হয়েছে শিক্ষক রাজনীতি ও দুর্নীতি। বৃটিশ রাজশক্তির দোসর সেকালের শিক্ষকরা শিক্ষকদের এভাবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবে, একে অপরকে ঠকাবে, স্বার্থ হাসিল করবে-এটা যেন দূরারোগ্য ব্যাধি। যার থেকে নিস্তার পাইনি আমরা এখনো। কালের সাক্ষী হিসেবে তৎকালীন শিক্ষা-ব্যবস্থার অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনার চিত্র ফুটে উঠেছে। নিশীত পুত্র হারীতকে সবাই কম্যুনিস্ট কি না বারে বারে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেছে। তাই হয়তো অনেকেই জীবনানন্দের রাজনৈতিক বিশ্বাস হারীতের উপর দিয়ে ছাপিয়ে দিয়ে নিজের বিশ্বাসকে প্রকাশ করেছেন বলেও মত দেন। কথায় বলে-সংসারের অশান্তি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ভয়াবহ! সংসারে অশান্তি সৃষ্টি হলে দাম্পত্য জীবন বিষবৎ হয়ে যায়। আমরা জীবনানন্দের সবক’টি উপন্যাসে দেখি ঘুরে ফিরে দাম্পত্য কলহ এসেছে। ‘জলপাইহাটি’ তার ব্যতিক্রম নয়। জিতেন দাশগুপ্ত, রবিশঙ্কর ও নিশীথ সেন নিজেই তার জ্বলন্ত সাক্ষী। রবিশঙ্করের কথা, ‘আমার ছেলেপুলেরা কে কার ছেলে মেয়ে বুছে উঠতে পারছি না। আমার সঙ্গে কারুরই তো চোখ নাকের মিল নেই-কেমন একটা সমস্যার চোরাবালিতে ঠেকে কাতর হয়ে বললে রবিশঙ্কর!’ (পৃ-১৬১)
নিশীথ সেন সম্পর্কে হারীতকে জুলেখা বলেন, ‘যার সঙ্গে জীবনের পঁিচশ ত্রিশটা বছর কাটল তাকে এরকম অবস্থায় ফেলে চলে যায় বটে কেউ কেউ, কিন্তু-চলে গেলেন প্রফেসরের মতন মানুষও। এটা কি তার অপরাধ, এদেশের অপরাধ নাকি যুগেরই-ঠিক বুঝতে পারছি না আমি। ঢের রক্ত, গøানি, বিশৃঙ্খলায় ভরে আছে এ যুগ, এ যুগে প্রফেসর সেনের মতন ওরকম মানুষকেও হয়ত তাই এরকম হতে হয়।’ (পৃ-২৭৪)
এ রকম অসংখ্য দাম্পত্য সমস্যার কথা আছে পুরো উপন্যাস জুড়েই। ১৯৪৭-৪৮ সালের দিকে উপন্যাসটি রচিত হয়েছে। নামে ‘জলপাইহাটি’ হলেও জলপাইহাটির কথা খুব একটা আসেনি। কেবল কলকাতার আলোচনাই বেশি হয়েছে। বাস্তবেও জীবনানন্দ চাকরি জীবনে কোথাও সুস্থির হতে পারেন নি। তাই অনেক খ্যাতিমান গবেষক একে আত্মজৈবনিক উপন্যাস বলতেও দ্বিধা করেননি। কবি ও ঔপন্যাসিক জীবনানন্দ দাশের জীবনজুড়ে অন্ধকার তাড়িয়ে বেড়াতে বেড়াতে শেষ পর্যন্ত দুঃখজনকভাবে একদিন ট্রামের তলায় পিষ্ট হন! দীপ্তি ত্রিপাটি বলেন, “আসলে ‘জলপাইহাটি’র গল্প অন্ধকারেরই গল্প। উপন্যাস পাঠ শেষ হলে মনে হয় এ উপন্যাসের নায়ক দু’জন নিশীথ+হারীত..। বা বলা যায় অন্ধকারই এ উপন্যাসের নায়ক এবং নায়িকা অপ্রেম। অন্ধকার ও অপ্রেমই এ উপন্যাসের জগতে ঘুরে বেড়াচ্ছে।’ অন্ধকার জগতের বাসিন্দা হারীত সবসময় থেকেছে অন্ধকার চোরাগলিতে। বেরিয়ে আসার চেষ্টা নিশীথ করলেও চরিত্রগত বৈপরিত্যের কারণে হারীত চায়নি। উপন্যাসের শেষের দিকে দেখা যায় বাবা-ছেলে দু’জনের প্রেমিকা একজনই হয়ে যায় তা সুলেখা। যা এ সমাজব্যবস্থার জন্য অনিরাময়যোগ্য ক্ষতস্বরূপ! তবে সুলেখাকে শেষ পর্যন্ত তারা দু’জনের কেউ পায়নি ওয়াজেদ আলীর সাথেই সুলেখার বিয়ে হওয়ার কথা!এ উপন্যাসে প্রবলভাবে অজাচার উপস্থাপিত হতে দেখা গেছে। অনেকসময় তা দৃষ্টিকটু বলে মনে হয়েছে। যা-ই হোক এই অজাচার, ব্যভিচার, লোভ-লালসা, মাদবদ্রব্যের সয়লাব, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, নারী পাচার, গীনকাবৃত্তি ও শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা ইত্যাদি অন্ধকার জগতের কার্যকলাপে জলপাইহাটি থেকে কলকাতা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো উপন্যাসের পটভ‚মি। ‘..অন্ধকারের ভেতর এই সব মানুষের নিশ্বাস মেদুর করে রাখছে রাতের বাতাসকে। অনুভব করছিল হারীত; কিন্তু থাকছে না কিছু, দূর অন্ধকার অনন্তের দিকে চলে যাচ্ছে মানুষের নিশ্বাস.. (পৃ-২৬৮)
তথ্যসূত্রঃ
১। জীবনানন্দ দাশ জন্মশতবার্ষিক স্মারকগ্রন্থ-আবদুল মান্নান সৈয়দ/আবুল হাসনাত সম্পাদিত
২। আধুনিক কবিতা : প্রাসঙ্গিক বিবেচনা-কমরুদ্দিন আহমদ
৩। জীবনানন্দ দাশের উপন্যাস বিষয়বস্তু ও প্রকরন- রোখসানা চৌধুরী
৪। জলপাইহাটি-জীবনানন্দ দাশ: ঐতিহ্য সংস্করণ (২০১৭)
৫। জলপাইহাটি: উপলব্ধির পুনঃপাঠ-অমর মিত্র, পৃ:৬৯
৬। আধুনিক বাংলা কাব্য পরিচয়-দীপ্তি ত্রিপাটি (১৯৯২) পৃ-১৬২