রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সুমতি ফিরবে কি মিয়ানমারের নতুন নেতৃত্বের

39

রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে মিয়ানমারের নতুন সরকার কি পদক্ষেপ নেন তা দেখার বিষয়। তবে সরকার নতুন হলেও নেতৃত্ব এবং নেতৃত্বের অধিনস্ত মানুষগুলো যে পুরাতন সেই কথা মাথায় রেখে পথ চলতে হবে। মিয়ানমারের নতুন নির্বাচিত নেতৃত্বের সুমতি ফিরবে কিনা-তা নিয়েই আমাদের আগ্রহ কম নয়। বৈশ্বিক রাজনৈতিক মেরুকরণ কখন কোনদিকে ঘুরবে সেই কথা জোর দিয়ে কেউ বলতে পারবে বলে আমাদের মনে হয় না। তবে গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে সেনানিয়ন্ত্রিত দেশগুলোতে তাদের পৌষ্য নেতৃত্ব ক্ষমতায় আসবে-সেটা আগাম বলা যায়। সম্প্রতি মিয়ানমারের জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিশ্ব সম্প্রদায়ের তীক্ষè দৃষ্টি ছিল দেশটির প্রতি। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো আগাম বার্তা দিয়ে বলেছে, সেনাবাহিনীর ইচ্ছের প্রতিফলন ঘটবে মিয়ানমারের নির্বাচনে। অর্থাৎ যার সুদৃঢ় ও কঠিন নেতৃত্বে দেশটির বড় একটি জনসংখ্যাকে অবৈধ বলে জাতিগত নিধন ও গণহত্যা চালিয়ে বাকিদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করেন সেই এখন দেশটির সেনাবাহিনীর গুডবুকে। সর্বশেষ তিনিই অর্থাৎ অং সাং সুচিই এখন দেশটির নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। সাবেক গণতন্ত্রের মানসকন্যা সুচি এখন বিশ্ববাসীর কাছে জাতিগত সংঘাত ও বিদ্ধেষ সৃষ্টিকারী নেত্রী। তাকেই সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় মিয়ানমারের জনগণ নির্বাচনে বিজয় করেছেন। সেই সাথে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে নতুন কোন আশার আলো ঝলক দিবে কিনা-তা নিয়ে দ্বিধায় আছেন বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। তবে সম্প্রতি চীনের শীর্ষ পর্যায় থেকে এ সংকট নিরসনে তাদের আগ্রহের কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশকে। সেই সূত্রে কিছুটা প্রত্যাশা করা একেবারে অবান্তর নয়।
বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, মিয়ানমারের পরিস্থিতি বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ মানবিক এবং মানবাধিকার সংকটের একটি, যা এটি আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ। বিশেষ করে যখন কোভিড মহামারির কারণে বিশ্ব এক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এই সংকট সমাধানের লক্ষ্যে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটিতে চতুর্থবারের মতো প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। গত বুধবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। রোহিঙ্গা সংকট দিনে দিনে প্রকট হয়ে উঠছে। মানবিক সংকট হিসেবে শুরু হলেও পর্যায়ক্রমে ভূরাজনৈতিক সংকটে রূপ নিচ্ছে রোহিঙ্গা ইস্যু। সংকট সমাধানের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়কে মূল ভ‚মিকা রাখতে হবে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ওআইসি ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন যৌথভাবে প্রস্তাবটি উত্থাপন করে। এতে পৃষ্ঠপোষকতা করে ১০৪টি দেশ। এটি মিয়ানমারে মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ অন্যান্য সহিংসতার শিকার নির্যাতিত রোহিঙ্গা মুসলিম ও সংখ্যালঘু স¤প্রদায়ের প্রতি বিপুলসংখ্যক জাতিসংঘ সদস্য রাষ্ট্রের শক্তিশালী, ঐক্যবদ্ধ ও অকুণ্ঠ সমর্থনেরই বহির্প্রকাশ। প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয় ১৩২টি দেশ। বিপক্ষে ৯টি। আর ভোটদানে বিরত থাকে ৩১টি দেশ। অর্থাৎ বিপুল ব্যবধানে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ওআইসির সদস্য রাষ্ট্র ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, সুইজারল্যান্ডসহ উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আন্তঃআঞ্চলিক জোটের সমর্থন ও সহপৃষ্ঠপোষকতা পায় প্রস্তাবটি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের বিষয়ে জাতিসংঘে পাঁচ দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। আশার কথা হলো, এখনো আন্তর্জাতিক মহল রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে তৎপর রয়েছে। জাতিগতভাবে নিধনের উদ্দেশ্যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে আসছে কয়েক দশক ধরে। কিন্তু গত ২০১৬ সালের অক্টোবর এবং সর্বশেষ গত বছরের ২৫ আগস্টের পর থেকে অভিযানের নামে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর অত্যাচার-নির্যাতন শুরু করে নির্মমভাবে। সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা, ধর্ষণের শিকার হয়েছে অসংখ্য রোহিঙ্গা নারী। সহিংসতার ঘটনায় প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এর আগে থেকেই আরো অন্তত ৪ লাখ রোহিঙ্গা বিভিন্ন সময়ে পালিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। রোহিঙ্গাদের প্রতি সমবেদনা এবং মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় বাংলাদেশের প্রতি সংহতি এবং রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসনের তাগিদ জানিয়ে আসছে বিশ্ব সম্প্রদায়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গাদের নাগরিক পরিচয়ের স্বীকৃতি, তাদের ওপর নিপীড়ন বন্ধ করা ও নিরাপদ বসবাসের নিশ্চয়তা দেয়ার জন্য মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগে বিশ্ব সম্প্রদায়ের জোরালো ভ‚মিকা রাখতে হবে।