রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সব প্রস্তুতি নিয়েছে বাংলাদেশ

46

বৃহস্পতিবার থেকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরুর সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে সরকার। অবকাঠামোগত সুবিধা, নিরাপত্তাসহ আনুষঙ্গিক সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনারের কার্যালয় এবং জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা।
এদিকে রোহিঙ্গারা রাখাইনে তাদের আদি নিবাসে ফিরে যেতে চায় কিনা তা নিয়ে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) আজ থেকে নির্বাচিত লোকজনের সাক্ষাৎকার নেওয়া শুরু করবে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম সোমবার বলেছেন, ইউএনএইচসিআরের নেতৃত্বে যৌথভাবে আমরা এনিয়ে কাজ করব।
এদিকে সর্বশেষ এই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন পরিকল্পনা নিয়ে আগামীকাল বুধবার নিরাপত্তা পরিষদ রুদ্ধদ্বার আলোচনায় বসতে যাচ্ছে।
ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও বেলজিয়ামের অনুরোধে এই বৈঠক হচ্ছে বলে রয়টার্স জানিয়েছে।
মিয়ানমারের কর্মকর্তার বরাত দিয়ে রয়টার্স তিন দিন আগে জানিয়েছিল, আগামী ২২ আগস্ট ৩ হাজার ৪৫০ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত নেওয়ার দিনক্ষণ ঠিক হয়েছে।
জানা গেছে, ৩ হাজার ৪৫০ জন রোহিঙ্গাকে স্বদেশে ফেরত পাঠাতে প্রস্তুতি চলছে। সংস্কার করা হচ্ছে কক্সবাজারের টেকনাফের প্রত্যাবাসন ঘাট। এছাড়া প্রত্যাবাসন তালিকায় নাম থাকা রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য শিবিরের কর্মকর্তার (সিআইসি) কার্যালয়ের পাশে নির্মাণ করা হয়েছে কিছু ঘর। তবে প্রত্যাবাসন নিয়ে কোনো কোনো রোহিঙ্গার মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে। টেকনাফের কেরনতলী প্রত্যাবাসন ঘাট ও নয়াপাড়ার জাদিমোরা শালবন শিবির ঘুরে এসব তথ্য জানা গেছে।
এছাড়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের উদ্যোগে মিয়ানমারের মিত্র হিসেবে পরিচিত চীনের ‘বড় ভূমিকা’ থাকছে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম। গতকাল সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে তিনি এসব কথা বলেন।
এদিকে মিয়ানমার সরকার কর্তৃক গঠিত ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট কমিশন অফ ইনকোয়ারি’ টিমটি ইতোমধ্যে কক্সবাজার পৌঁছেছে। দেড়শ’ থেকে দুইশ’ রোহিঙ্গার সাক্ষ্য নেওয়ার কথা রয়েছে তাদের। তবে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও সুরক্ষার আশ্বাস না পেলে রোহিঙ্গারা সাক্ষ্য দেবে না বলে মনে করা হচ্ছে।
গত রবিবার শরণার্থী ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ে এক বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রস্তুতি নিয়ে কিছু সিদ্ধান্ত হয়। প্রত্যাবাসন ঘিরে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি শিবিরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ কিছু সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। বেলা সাড়ে ১১টায় শুরু হওয়া এ বৈঠক এক ঘণ্টা স্থায়ী হয়।
টেকনাফের নাফ নদীর তীর ঘেঁষে সরকারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের অধীন কেরনতলী (নয়াপাড়া) প্রত্যাবাসন ঘাট। ঘাটটি চারদিকে কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা। ভেতরে ঢুকে দেখা গেল, টিনের তৈরি আধাপাকা সারি সারি ঘর। এক লাইনে ১১টি করে তিন লাইনে ৩৩টি কক্ষ। বড় একটি পানির ট্যাংক, চারটি শৌচাগার। প্রত্যাবাসন তালিকায় নাম থাকা রোহিঙ্গাদের ফেরতের আগে প্রথমে এখানে রাখা হবে। প্রত্যাবাসনকারী রোহিঙ্গাদের দেখভালে যুক্ত কর্মকর্তাদের জন্য আলাদাভাবে চারটি ঘরও রয়েছে। ট্রলারযোগে প্রত্যাবাসনের জন্য নদীতে স্থাপিত হয়েছে লম্বা কাঠের জেটি। প্রত্যাবাসন কেন্দ্রের নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছে আনসার ব্যাটালিয়ানের একটি দল। ঘাটে কয়েকজন শ্রমিককে কাজ করতে দেখা গেছে।
প্রত্যাবাসন ঘাটের দায়িত্বে থাকা প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের প্রতিনিধি মোহাম্মদ শহিদুল হাসান বলেন, এ ঘাট দিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হওয়ার কথা রয়েছে। তাই কর্তৃপক্ষের নির্দেশে এখানে কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন কাজ-কর্ম চলছে।
এখানে কর্মরত শ্রমিক হামিদুল রহমান ও মোহাম্মদ সেলিম বলেন, ‘শিবিরের কর্মকর্তাদের নির্দেশে প্রত্যাবাসন ঘাটে নতুন করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করছি। প্রতিদিন অফিসের লোকজন তদারক করছেন।’
এছাড়া টেকনাফের নয়াপাড়া জাদিমোরা শালবন রোহিঙ্গা শিবিরে সিআইসি কার্যালয়ের পাশেও তড়িঘড়ি করে প্লাস্টিকের ছোট ছোট চারটি ও লম্বা ত্রিপল এবং বাঁশের ঘর বানানো হচ্ছে। এসব ঘরে প্রত্যাবাসনের তালিকায় নাম থাকা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কর্মকর্তারা আলোচনায় বসবেন বলে জানা গেছে।
জাদিমোরা শালবন শিবিরের নারী চেয়ারম্যান রমিদা বেগম বলেন, প্রত্যাবাসন নিয়ে রোহিঙ্গাদের মাঝে হতাশা বিরাজ করছে। কেননা, শিবিরের সিআইসি কার্যালয়ে পাশে এনজিওরা তাড়াহুড়া করে ছোট ছোট ঘর তৈরি করছে। এ নিয়ে রোহিঙ্গাদের মাঝে কানাঘুষা চলছে। তিনি জানান, সিআইসির সঙ্গে কিছু রোহিঙ্গার বৈঠক হয়েছে। এতে সিআইসি ২২ আগস্ট রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হবে বলে নিশ্চিত করেছেন।
জাদিমোরা রোহিঙ্গা শিবিরের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান বলেন, ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হোক, সেটা আমরা চাই। তবে রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিচার ও নিজ দেশে নাগরিকত্ব দিলে ফেরত যেতে প্রস্তুত। হঠাৎ করে প্রত্যাবাসনের খবরে রোহিঙ্গারা উদ্বিগ্ন। কীভাবে কী হচ্ছে, তা আমরা বুঝতে পারছি না।’
কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ আবুল কালাম বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করতে সরকার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এর বাইরে কিছু বলা যাচ্ছে না।
গত বছরের অক্টোবর মাসে এই প্রত্যাবাসন ঘাট নির্মাণ করা হয়। একই বছরের ১৫ নভেম্বর প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রোহিঙ্গাদের আন্দোলনের মুখে তা স্থগিত হয়।
মিয়ানমার সরকার কর্তৃক গঠিত ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট কমিশন অফ ইনকোয়ারি’ টিমটি ইতোমধ্যে কক্সবাজার পৌঁছেছে। দেড়শ’ থেকে দুইশ’ রোহিঙ্গার সাক্ষ্য নেওয়ার কথা রয়েছে তাদের। তবে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও সুরক্ষার আশ্বাস না পেলে রোহিঙ্গারা সাক্ষ্য দেবে না বলে মনে করা হচ্ছে।
কক্সবাজার শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম বলেছেন, রোহিঙ্গারা নিরাপত্তা ও সুরক্ষার আশ্বাস না পেলে কক্সবাজারে সফরে আসা ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট কমিশন অফ ইনকোয়ারি’ টিমের পক্ষে সাক্ষ্য নেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। এজন্য বৈঠকে আমরা প্রতিনিধিদলকে বলেছি যে, সাক্ষ্য দেওয়া রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার কথা। বিষয়টি মাথায় রেখেই কাজ করা হবে বলে প্রতিনিধিদলও আমাদের আশ্বস্ত করেছেন।
গতকাল সোমবার দুপুরে কক্সবাজার শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়ে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে মিয়ানমাররের তদন্ত দলের প্রতিনিধিদলের বৈঠক শেষে এসব কথা বলেন মিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম। তিনি আরও বলেন, মিয়ানমার সরকার কর্তৃক গঠিত এই ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট কমিশন অফ ইনকোয়ারি’ টিমটি মূলত অগ্রগামী দল হিসাবে কক্সবাজারে এসেছেন। এরপর আসবেন ‘এভিডেন্স কালেকশন এবং ভেরিফিকেশন’ নামের আরও একটি প্রতিনিধিদল।
বৈঠকে উপস্থিত কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন জানিয়েছেন, এটি মূলত অগ্রগামী দল। এরপর আরেকটি দল আসবে। তারা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কীভাবে কাজ করবে না করবে সেটি তদন্ত করার জন্য এই টিমের কক্সবাজারে আসা।
ইন্ডিপেন্ডেন্ট কমিশন অফ ইনকোয়ারি’ দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ফিলিপাইনের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোজারিও মানালো। কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন- মিয়ানমারের সাংবিধানিক ট্রাইব্যুনালের সাবেক চেয়ারম্যান মিয়া থেইন, জাতিসংঘের জাপানের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি কেনজো ওশিমা এবং ইউনিসেফের সাবেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ড. অন তুন থেট।
উল্লেখ্য, রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিষয়টি তদন্তের জন্য ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট কমিশন অফ ইনকোয়ারি’ গঠন করেছে মিয়ানমার সরকার। ওই কমিশনের একটি প্রতিনিধিদল চার দিনের সফরে গত শনিবার বাংলাদেশে আসে। দলটি এমন একটি সময়ে বাংলাদেশে এলো, যখন ২২ আগস্ট রোহিঙ্গাদের প্রথম দলটি তাদের মাতৃভূমি রাখাইনে প্রত্যাবাসিত হতে পারে। এছাড়াও আগামী মাসে ‘এভিডেন্স কালেকশন এবং ভেরিফিকেশন’ নামের আরও একটি টিম আসার সম্ভাবনা রয়েছে। তারা রাখাইনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলো তদন্ত করবেন।
রোহিঙ্গাদের ফেরাতে ‘বড় ভূমিকায়’ চীন : বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের উদ্যোগে মিয়ানমারের মিত্র হিসেবে পরিচিত চীনের ‘বড় ভূমিকা’ থাকছে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম। তবে কবে থেকে প্রত্যাবাসন শুরু হবে তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি বলে জানিয়েছেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে গতকাল সোমবার তার কার্যালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে মন্ত্রিপরিষদ সচিব এসব কথা বলেন।
গত ১-৬ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের সময় দেশটির সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে সহায়তার আশ্বাস মেলে।
রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমিতে ফেরানোর পরিবেশ তৈরিতে চীন মিয়ানমারকে রাজি করানোর পদক্ষেপ নেবে বলে শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন চীনা প্রধানমন্ত্রী লি খ্য ছিয়াং।
ওই সময় শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) আন্তর্জাতিক বিষয় সম্পর্কিত মিনিস্টার সান তাও তাদের দলের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার আশ্বাসও দেন। পরে চীনের প্রসিডেন্ট শি চিন পিংও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে দ্রæত রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে গুরুত্ব দেন।
প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর নিয়ে মন্ত্রিপরিষদকে অবহিত করার বিষয়ে সচিব শফিউল বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের প্রধানমন্ত্রী এবং মহামান্য রাষ্ট্রপতি দু’জনই ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন। তারা বলেছেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য যত রকমের সহযোগিতা দেওয়া দরকার তারা দিয়ে যাবে। মিয়ানমারকে বোঝানোর জন্য চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে দুইবার পাঠানো হয়েছে। আরও যদি পাঠানোর প্রযোজন হয় পাঠাবেন এবং উনারা যত রকমের সাহায্য সহযোগিতা দরকার দেবে। আর ওখানে পরিবেশ তৈরির জন্যও সাহায্য করবে- এটা একটা বড় প্রতিশ্রæতি পাওয়া গেছে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কী চীনের মধ্যস্থতায় হবে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, চীনের একটা বেশ বড় ভূমিকা আছে।