রেল স্টেশন-বাস টার্মিনালে ঘরমুখো মানুষের স্রোত

57

জনস্রোত নেমেছে বাস টার্মিনাল ও রেল স্টেশনে। হাজার হাজার মানুষ, লোকে লোকারণ্য। নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ একাকার। সবাই ছুটছেন বাড়ি- শেকড়ের টানে বাড়ির পাণে। নগরী হতে চলেছে ফাঁকা। জনারণ্যের নগরী যেন বাস-ট্রেনের ছাদে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাচ্ছে বাড়ি। হাজারো দুর্ভোগেও প্রিয়জনদের কাছে যেতে চান মানুষ। নৌ-পথেও শহর ছাড়ছে মানুষ। তবে দূর পাল্লার বাসে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ রয়েছে; রয়েছে দীর্ঘসময় পর গাড়ি ছাড়ার অভিযোগও। আর মাত্র একদিন; কাল বাদে পরশু সোমবার উদ্যাপিত হবে পবিত্র ঈদ-উল আযহা। এই কোরবানীর ঈদকে ঘিরে শহর ছাড়ছে মানুষ। শুধু মুসলমানরা নয়, ছুটি পেয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনও বাড়ি যাচ্ছেন সমানতালে।
ঈদ-উল আযহা উপলক্ষে গতকাল শুক্রবার থেকে শুরু হয়েছে টানা ৯ দিনের ছুটি। মাঝে একদিন খোলা থাকলেও তেমন একটা উপস্থিতি থাকবে না অফিস আদালতে। বেশিরভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারি সেদিন ছুটি নিয়েছেন, অনেকে উপস্থিত থাকবেন না। ফলে ১৮ আগস্ট থেকেই অফিস-আদালত খোলা থাকবে।
বৃহস্পতিবার অফিস শেষ করে আগেভাগেই বের হয়ে শেকরের টানে নিজ জন্মভিটের দিকে ছুটেছেন অনেকে। তবে মানুষের স্রোত বেড়েছে গতকাল শুক্রবার থেকে। ভোর থেকেই মানুষ ছুটেছেন বাস টার্মিনাল ও রেল স্টেশনে। কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না।
শুক্রবার রেল স্টেশনে সরেজমিনে দেখা গেছে, ঘরমুখো মানুষের স্রোত নেমেছে। পুরো স্টেশন জুড়ে মানুষ আর মানুষ। স্টেশন ছেড়ে বাইরেও অপেক্ষমাণ রয়েছে মানুষ। এদের মধ্যে নারী-শিশুর আধিক্য চোখে পড়ার মতো। তারা অপেক্ষায় থাকছেন কতক্ষণে ট্রেন আসবে, আবার ছাড়বে। গত বৃহস্পতিবারের চেয়ে দ্বিগুণ মানুষ দেখা গেছে শুক্রবার। ট্রেন আসার সাথে সাথে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন যাত্রীরা। কার আগে কে উঠবে এই প্রতিযোগিতা দেখা গেছে। প্রতিটি ট্রেনে লাগানো হয়েছে অতিরিক্ত বগি। ভিড়ের কারণে অনেকে নিজের বগিতে পৌঁছাতে না পেরে কাছের বগিতেউ উঠে পড়েন। এ সময় নারী ও শিশুদের দুর্ভোগ পোহাতে হয় বেশি।
রেলওয়ের পরিবহন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, এমনিতে নরমাল দিনগুলোতে প্রতিটি ট্রেনে ১৬ বগি থাকে। ঈদে প্রতিটি ট্রেনে অতিরিক্ত আরো ৪টি বগি যুক্ত করা হয়েছে। প্রতিটি ট্রেনে ১২শ’ থেকে ১৩শ’ যাত্রী যাচ্ছে। একটি বগিতে ৬০ জন করে বসতে পারছে। প্রতিদিন চট্টগ্রাম থেকে ২০ হাজারেরও বেশি যাত্রী পরিবহন করছে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল।
স্টেশন ম্যানেজার আবুল কালাম আজাদ বলেন, সব ট্রেন সিডিউল অনুযায়ী ছাড়ছে। দু’একটি হয়তো যাত্রীর চাপের কারণে কিছুটা বিলম্ব ঘটছে। তিনি বলেন, প্রতিটি ট্রেনে অতিরিক্ত বগি সংযোজন করা হয়েছে। দু’জোড়া অতিরিক্ত ট্রেনও দেয়া হয়েছে। আশা করি যাত্রীদের কোনো সমস্যা হবে না।
সরেজমিনে দেখা গেছে, চাঁদপুরগামী যাত্রীরা অনেকে ঝুঁকি নিয়ে ট্রেনের ছাদে উঠে পড়েন। বৃষ্টি থেকে নিজেকে বাঁচাতে কেউ ছাতা, কেউ পলিথিন মাথায় দেন। ছাদেও দেখা গেছে মানুষ আর মানুষ। স্পেশাল ট্রেনের প্রতি বগিতে সিটের পাশাপাশি ছিল দাঁড়িয়ে যাওয়া মানুষের আধিক্য। এসব যাত্রীরা অগ্রিম টিকেট না পেয়ে দাঁড়িয়ে গন্তব্যে যাওয়ার টিকিট কেে ছেন।
ট্রেনের ছাদে ওঠা মিনার আলী নামে এক যাত্রীর কাছে ঝুঁকি নিয়ে ট্রেনের ছাদে বসে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, টিকিটের জন্য ফেরত এসেছি। পরে এসে দাঁড়িয়ে যাওয়ার টিকেট কেটেই স্টেশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করি। এখন যদি ট্রেনের ছাদে উঠে না যাই, পরদিন থেকে মানুষের ভিড় আরো বাড়বে। তখন যাওয়াটা আরো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে।
আরো বেগতিক অবস্থা দেখা গেছে বাস টার্মিনালগুলোতে। বাস টার্মিনালগুলোতে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়েছে পুরো টার্মিনাল এলাকা। শুভপুর বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে দেখা গেছে, মানুষ আর মানুষ। তিল ধারণের ঠাঁই নাই। এই বাস স্ট্যান্ড থেকে ১৭টি জেলার বাস ছাড়ে। নারী-শিশুকে নিয়ে এসেছেন লোকজন। টিকিট আগেই করা আছে। অনেকে তাৎক্ষণিক করছেন। বাস আসছে, আর যাত্রীরা উঠছেন। নিমিষেই পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে বাস। এ বাস স্ট্যান্ড যেন মানুষের মেলা। বাস স্ট্যান্ড ছাড়িয়ে পুরো এলাকা জুড়ে মানুষ আর মানুষ।
নোয়াখালী যাবেন মানিক মিয়া। তিনি বললেন, অনেক দিন পর মার কাছে যাব। আর দেরি করতে পারছি না। মাকে দেখতে মনটা আনচান করছে। ফেনীর যাত্রী শামীম খান যাচ্ছেন স্ত্রী ও দু’পুত্র নিয়ে। তিনি বললেন, গত কোরবানের ঈদের পর আর বাড়ি যাওয়া হয়নি। এবার যাচ্ছি। গ্রামে আমার বাবা-মা থাকেন। তাদের সাথেই ঈদ করব। কতই না আনন্দ।
কদমতলী বাস স্ট্যান্ডে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। সোনাপুরের বাস ভাড়া ২৫০ টাকা হলেও নেয়া হচ্ছে ৩০০-৩৫০ টাকা। এভাবে প্রতিটি রুটে ৫০ থেকে ১০০ টাকা বাড়তি নেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
কে সি দে রোড, গরীবুল্লাহ শাহ মাজার বাস কাউন্টার, অলংকার মোড়, সিটি গেইটে বাস স্টেশনেও একই অবস্থা। দূর পাল্লার বাসেও ভিড়। ঢাকাসহ বিভিন্ন দূর-দূরান্তের জেলার মানুষগুলো নগর ছাড়ছে। কাউন্টারে টিকিটও নেই। আগেই টিকিট শেষ হয়ে গেছে। কিছু কিছু টিকিট মিলছে। সব বাসেই যাত্রী। কোনো সিট খালি নেই। বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল, অক্সিজেন মোড়, শাহ আমানত সেতু এলাকায় অসংখ্য যাত্রীর ভিড়। হাজার হাজার যাত্রী এসব বাস স্ট্যান্ডে দেখা গেছে। একের পর এক বাস ছাড়ছে আর যাত্রীরা উঠছেন।
এদিকে দূর পাল্লার আন্তঃজেলা বাস (এসি বাস) কাউন্টারগুলোতেও ছিল ভিড়। অনেকে টিকিটের জন্য গিয়েও টিকিট পাননি। বিশেষ করে ঢাকা, যশোর, রংপুর, বগুড়া, মাগুড়া, খুলনা, বাগেরহাট, ফরিদপুর, রাজশাহী অঞ্চলের যাত্রীরা চাহিদা মতো টিকিট পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেছেন। বাস মালিক সমিতির নেতারা জানান, এসব রুটে বাস সার্ভিস কম। একটি বাস যেতে একদিন লেগে যায়। ফিরে আসতে হয় খালি। এজন্য প্রতিটি কোম্পানির একটি কিংবা দু’টির বেশি বাস নেই এসব রুটে। বাস মালিক সমিতির নেতারা জানান, ঈদ উপলক্ষে চট্টগ্রাম থেকে প্রতিদিন ১২শ’র মতো গাড়ি আসা-যাওয়া করছে।
নৌপথেও যাত্রীদের এবার বিড়ম্বনার শেষ নেই। চট্টগ্রাম থেকে স›দ্বীপ, হাতিয়া ও বরিশালের নৌপথের যাত্রীরা এবার হতাশ। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডবিøউটিএ) এ পথে চারটি জাহাজ পরিচালনা করলেও ঈদ উপলক্ষে অতিরিক্ত কোনো লঞ্চ বা জাহাজের ব্যবস্থা করেনি। ফলে যাত্রীরা বেসরকারি লঞ্চ বা জাহাজে করেই বাড়ি ফিরছেন। চাহিদা বেশি থাকায় ঝুঁকি নিয়ে লঞ্চগুলোতে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। একই সঙ্গে অতিরিক্ত ভাড়া নেয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ করছেন যাত্রীরা।