রেল স্টেশনে প্রকাশ্যে ধূমপান স্বাস্থ্যঝুঁকিতে যাত্রীরা

92

প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ট্রেনে করে শহর থেকে শহরে ঘুরে বেড়ান। ফলে সবাইকে রেলস্টেশনের প্লাটফর্ম হয়ে যেতে হয়। অনেককে আবার ট্রেনের জন্য দীর্ঘসময় প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু এই অপেক্ষা বা চলাচল পুরোটায় অস্বস্তিকর হয়ে উঠে উন্মুক্ত ধূমপানের দরুণ। যার কারণে এই বিশাল সংখ্যক যাত্রী পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছেন। যেখানে বাদ পড়ছে না শিশু ও বয়স্ক মানুষও। আইন থাকলেও প্রকাশ্যে ধূমপানের বিষয়টি নিয়ে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ না থাকায় স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখে পড়তে হচ্ছে হাজার হাজার রেল যাত্রীদের।
৭ বছরের ছোট সন্তান আর বয়স্ক মাকে নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যাবেন লিয়াকত হোসেন। নগরীর বাকলিয়া এলাকার বাসিন্দা লিয়াকত হোসেন পেশায় একজন ডাক্তার। বেলা ৩টার মহানগর গোধূলীর ট্রেনের জন্য আধ ঘণ্টা আগেই প্ল্যাটফর্মে পৌঁছান তিনি। কিন্তু প্ল্যাটফর্মের যাত্রীছাউনিতে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে অস্বস্তিতে পড়তে হয় তাকে। কারণ তার পাশেই প্ল্যাটফর্মের মেঝেতে বসে কথা বলছেন ৫-৬ উদ্বাস্তু মানুষ, সবাই মিলে ধূমপান করছে তারা। সেখান থেকে উঠে প্ল্যাটফর্মের এক কোণার একটি দোকানের সামনে আসেন তিনি। কিন্তু সেখানেও ৩-৪ জনের আড্ডা। তারাও ধূমপান করছে, পরস্পর গালাগাল করছে। ফলে বাধ্য হয়ে সেখান থেকেও সরতে হয় লিয়াকত হোসেনকে।
গত রবিবারে তাকে চট্টগ্রাম নতুন রেলস্টেশনে এভাবেই অস্বস্তিতে পড়তে দেখা যায়। লিয়াকত হোসেনের মত হাজারো যাত্রীকে প্রতিদিন একই রকম অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় এই স্টেশনে।
কথা হয় লিয়াকত হোসেনের সাথে। তিনি পূর্বদেশকে বলেন, ‘একজন বাবার কাছে পরম নির্ভরতার স্থান তার শিশু সন্তান। কিন্তু মনে হচ্ছে সেই সন্তানকে যথাযথভাবে রক্ষা করতে পারছি না। একজন ডাক্তার হিসেবে পরোক্ষ ধূমপান মারাত্মক ক্ষতি ও হুমকির কথা আমার অজানা নয়। তাই চোখের সামনে ভালবাসার মানুষগুলোকে এর শিকার হতে দেখতে ভীষণ খারাপ লাগে। সরকার এত উদ্যোগ নেয়, যত্রতত্র ধূমপান বন্ধ করতে পারে না!’
সরেজমিন দেখা যায়, চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে সর্বমোট নয়টি প্ল্যাটফর্ম। এর মধ্যে কয়েকটি প্ল্যাটফর্মের যাত্রীছাউনির মাঝবরাবর গড়ে উঠেছে কয়েকটি অবৈধ দোকান। ট্রেন আসা যাওয়ার সময় প্রতিটি দোকানের সামনেই ধূমপায়ীদের জটলা লেগে থাকে। ফলে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হতে হয় চলাচলরত যাত্রীদের। এছাড়া ট্রেনের ভিতরে দুই কম্পার্টমেন্টের মাঝখানের স্থানে এবং দরজায় দাঁড়িয়ে ধূমপানের ঘটনাতো অহরহ। এমনকি এসি কম্পার্টমেন্টের সামনে দাঁড়িয়েও ধূমপান করেন অনেকে। ফলে পুরো কম্পার্টমেন্ট সিগারেটের গন্ধে ভরে যায় অভিযোগ করেছেন অনেকে। এইসব কারণে ট্রেনের ভিতরে শিশু থেকে শুরু করে প্রত্যেককেই শিকার হতে হয় পরোক্ষ ধূমপানের।এদিকে পরোক্ষ ধূমপানকে প্রত্যক্ষ ধূমপানের থেকেও মারাত্মক ক্ষতিকর বলছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে শিশুদের জন্য পরোক্ষ ধূমপান খুবই বিপজ্জনক বলে জানান চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন জেনারেল হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. সুশান্ত বড়ুয়া।
তিনি পূর্বদেশকে বলেন, ‘শিশুদের শ্বাসকষ্ট ও হাঁপানির অন্যতম প্রধান কারণ এই পরোক্ষ ধূমপান। বাবা, বড় ভাই বা পথচারী যে ধোঁয়া ছাড়ছে, তার শিকার হচ্ছে শিশুরা। ব্যাপক জনসচেতনতা বাড়ানো ছাড়া এই বিপদ থেকে শিশুদের রক্ষার উপায় নেই।’
সম্প্রতি ঢাকায় পরিচালিত এক গবেষণায় উঠে এসেছে পরোক্ষ ধূমপানের মারাত্মক ক্ষতির বিষয়টি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ইয়র্ক, ইউনিভার্সিটি অব এডিনবার্গ এবং লিডস সিটি কাউন্সিলের জনস্বাস্থ্য বিভাগ যৌথভাবে এই গবেষণার কাজটি করেছে। বিষয় ‘সেকেন্ডহোম স্মোক এক্সপোজার ইন প্রাইমারি স্কুল চিল্ড্রেন : এ সার্ভে ইন ঢাকা’। ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর অক্সফোর্ড থেকে প্রকাশিত নিকোটিন অ্যান্ড টোব্যাকো রিসার্চ সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে গবেষণাটি।
গবেষণার ফলাফলে বলা হয়েছে, ঢাকা সিটি কর্পোরেশন ও এর আশপাশের ১১-১৩ বছরের ৯৫ শতাংশ শিশুর শরীরে ক্ষতিকর নিকোটিন রয়েছে। আর এর কারণ পরোক্ষ ধূমপান। ভয়াবহ ব্যাপার হলো এ গবেষণায় যে শিশুদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সবাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র।
তামাক বিষয়ে বৈশ্বিক প্রকাশনা ‘দ্য টোব্যাকো অ্যাটলাস ২০১৮’ এর তথ্য অনুযায়ী, তামাকের কারণে বাংলাদেশে বছরে ১ লাখ ৬২ হাজারের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করছে।
অন্যদিকে গ্যাটস রিপোর্ট ২০১৭ বলছে, দেশের মোট জনসংখ্যার ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ অর্থাৎ ৩ কোটি ৭৮ লাখ মানুষ তামাকজাত পন্য সেবন করে। পরোক্ষভাবে ধূমপানের শিকার হয় আরো ৪ কোটি ৮ লাখ জন। তামাকজনিত রোগের চিকিৎসা, অকালমৃত্যু ও পঙ্গুত্বের কারণে প্রতিবছর পাঁচ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয় বলেও জানা গেছে।
অন্যদিকে তামাক নিয়ন্ত্রণে প্রণীত আইন ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ অনুসারে ট্রেনসহ সমস্ত পাবলিক পরিবহনে ধূমপান শতভাগ নিষিদ্ধ। শুধু তাই নয়, যাত্রী সাধারণের দাড়ানোর স্থান অর্থাৎ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মেও ধূমপান নিষিদ্ধ করা হয়েছে এই আইনে। আইন অমান্যে রয়েছে ৩শ টাকা অর্থদÐের বিধান। কিন্তু প্রয়োগ না থাকায় অধিকাংশ মানুষই এই আইন সম্পর্কে সচেতন নয়।
চট্টগ্রামে তামাক নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে চলেছে বেসরকারি সংগঠন ইপসা। ইপসার উপ পরিচালক নাছিমা বানু বলেন, ‘দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে ট্রেনই এখন সবচেয়ে নিরাপদ পরিবহন। নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় প্রতিদিন হাজারো মানুষ শিশুসহ পরিবার পরিজন নিয়ে ট্রেনে করে দূর-দূরান্তে যাওয়া আসা করে। কিন্তু অসচেতনতার কারণে এই নিরাপদ পরিবহনেই হয়ে উঠছে স্বাস্থ্যের জন্য অনিরাপদ ও মারাত্মক ক্ষতিকর। ট্রেনের দুই কামরার মাঝখানে ও রেলস্টেশনে প্রতিনিয়ত ধূমপান করা হয় যার ফলে যাত্রীরা প্রতিনিয়ত পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়।
এমনকি রেলওয়ের অনেক কর্তৃত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরও রেলস্টেশনে যত্রতত্র ধূমপান করতে দেখা যায়। তাই যাত্রীদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতকল্পে এবং তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নে রেলস্টেশন ও ট্রেনে ধূমপান বন্ধে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মো. তোফাজ্জল হোসেন পূর্বদেশকে বলেন, পাবলিক প্লেসে ধূমপান একটি জাতীয় সমস্যা। যারা ধূমপান করেন, তাদের কোনো কাÐজ্ঞান নেই। তাই তাদের কারণে যে অন্যদের অস্বস্তিতে পড়তে হয়। সেটাও তাদের বিবেকে ধরে না। রেলওয়ের প্লাটফর্মগুলো অনেকটা পাবলিক প্লেস। এখানে মানুষের যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। তারপরও আমরা কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা করবো। পাবলিককের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করবো। এছাড়াও প্লাটফর্মে যাতে ধূমপান না করে, এমন বাণী সমৃদ্ধ কিছু লেখা আমরা ওই জায়গাগুলোতে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করবো।