রেল যোগাযোগ ঝুঁকিমুক্ত করার পদক্ষেপ নিন

41

আবারও ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে। সোমবার ভোর রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার মন্দবাগ নামক স্থানে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী তুর্ণা নিশীথা এবং সিলেট থেকে চট্টগ্রাম অভিমুখী উদয়ন এক্সপ্রেস এর মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষে ভয়াবহ এ ঘটনা ঘটে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী একজন শিশুসহ দুর্ঘটনায় তাৎক্ষণিক নিহত হয়েছে ১৬জন। রেলসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, মৃতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া বগির নিচে আরো মরদেহ থাকতে পারে। হতাহতদের উদ্ধার কাজ চলছে। অনেকের কাটা হাত-পা উদ্ধার হচ্ছে। এ দৃশ্য অসহনীয়। আহত হয়েছে অর্ধশতাধিক। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, এবারের ট্রেন দুর্ঘটনা এ যাবতকালের সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা। বিশ্লেষকরা বলছেন গত এক দশকে ছোট ছোট অনেক দুর্ঘটনা ঘটলেও কসবা ট্রাজেডিটি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
দুর্ঘটনার পর চট্টগ্রাম ও সিলেটের সঙ্গে ঢাকার ট্রেন চলাচল প্রায় ৭ ঘণ্টার জন্য বন্ধ ছিল। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ সূত্রে জানা যায়, ট্রেন দুটো দুই দিকে যাচ্ছিল। উদয়নকে লুপ বা সাইড লাইনে যখন পাঠানো হচ্ছিল তখন এর পেছনের তিনটি বগি মূল লাইনে থাকতেই ঢাকাগামী তূর্ণা চলে আসে এবং এ সংঘর্ষ ঘটে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসন ও মন্দবাগ স্টেশনের মাস্টার সূত্রে জানা যায়, তূর্ণার চালক তথা লোকো মাস্টারকে ট্রেন থামানোর জন্য আউটার ও হোম দুই স্থানেই লাল বাতি সংকেত দেওয়া হয়েছিল। কিন্ত চালক ট্রেন দাঁড় করাননি বলেই এ দুর্ঘটনা ঘটে। সূত্রে জানা যায়, এ ঘটনায় জেলা প্রশাসন ও রল কর্তৃপক্ষ পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। রেল কর্তৃপক্ষ তূরণা নিশীথার চালককে অস্থায়ীভাবে বরখাস্ত করেছে। এছাড়া রেল কর্তৃপক্ষ নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে নগদ একলাখ টাকা ও আহতদের প্রত্যেক পরিবারকে ১০ হাজার টাকা করে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও ক্ষতিগ্রস্তদের নগদ অর্থ দেয়ার কথা বলা হয়েছে। আমরা এ ঘটনায় শোকাহত ও মর্মাহত। আমরা মনে করি, এ দুর্ঘটনা নিচক দুর্ঘটনা হিসাবে উড়িয়ে দেয়ার কোন সুযোগ নেই। কারণ তুর্ণা নিশীথার চালক কোন নিয়ম-শৃঙ্খলা বা সতর্কতাকে তোয়াক্কা না করেই ট্রেন চালিয়ে নিচ্ছিলেন বলে সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রাথমিক তথ্য থেকে জানা যায়। সুতরাং এ সংক্রান্ত গঠিত তদন্ত কমিটি সকল বিষয় বিবেচনা করে এ দুর্ঘটনার কারণ উদ্ঘাটনসহ দোষীদের শাস্তির আওতায় আনবে-এমনটি প্রত্যাশা আমাদের।
উদ্বেগের বিষয় হল, ইদানীং ক্রসিং এলাকায় প্রায়ই ট্রেন দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটছে। ট্রেনকে তুলনামূলক নিরাপদ বাহন হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু ঘন ঘন দুর্ঘটনা ঘটতে থাকলে ট্রেন ভ্রমণে মানুষের সেই নিরাপত্তাবোধে যে চির ধরবে, তা বলাই বাহুল্য। কাজেই দুর্ঘটনার কারণগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত করে অবিলম্বে প্রতিকারের ব্যবস্থা নেয়া দরকার। যতদূর জানা যায়, অধিকাংশ সময়ে দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে চালক, গার্ড, স্টেশন মাস্টারসহ সংশ্লিষ্টদের ভুলের কারণে।
সূত্র জানায়, গত সাড়ে ৫ বছরেই এক হাজার ৮টির বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন ১৩০ জন। গবেষকরা বলছেন, কর্তৃপক্ষের যথাযথ নজরদারি না থাকায় প্রতিরোধযোগ্য এসব দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। আর রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, দুর্ঘটনা রোধে রেলের অনেক বিধিবিধান রয়েছে, সেগুলো মানা হয় না বলেই বাড়ছে দুর্ঘটনা। পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাষ্ট্রীয় সেবা প্রতিষ্ঠান হিসেবে রেলওয়ে যোগাযোগ ব্যব¯’ায় একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে ভূমিকা রাখছে। পরিবেশ দূষণরোধ, যাতায়াত নিরাপত্তা, স্বল্প খরচে মালামাল পরিবহন, ভূমির পরিমিত ব্যবহার, যানজট নিয়ন্ত্রণ এবং সর্বোপরি নগরের সঙ্গে গ্রামের সেতুবন্ধনে রেলের গুরুত্ব অনেক। এছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থায় রেলওয়েকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। উন্নয়ন বাজেটও অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। এর পরেও তেমন কোনও সুফল মিলছে না। একের পর এক স্টেশন বন্ধ, মেয়াদোত্তীর্ণ রোলিং স্টক, জরাজীর্ণ রেল কারখানা, লোকবল সংকট, সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছাতে না পারা, টিকিট পেতে ভোগান্তি, ছেঁড়া ও নোংরা আসনসহ নানা অব্যবস্থাপনা লেগেই আছে। আমরা মনে করি, দুর্ঘটনা রোধে রেলওয়ের যে বিধিবিধান রয়েছে, তাতে কোন সময়, কী করতে হবে তার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। সেই বিধিবিধানগুলো যথাযথভাবে মানা হলে আর দুর্ঘটনা ঘটবে না। আমরা এ বিষয়ে রেল কর্তৃপক্ষকে আরো সচেতন ও আইন মানার ক্ষেত্রে কঠোর হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি।