রেলে সংঘবদ্ধ নিয়োগচক্র!

119

রেলের নিয়োগ মানেই অনিয়ম-দুর্নীতি। সাম্প্রতিক সময়ে এএলএম, ওয়েম্যান, খালাসি ও আরএনবির সিপাহী পদের নিয়োগের পর বিষয়টি আরো জোরেশোরে আলোচিত হচ্ছে রেল অঙ্গনে। ইতোমধ্যে এমন কয়েকটি অভিযোগের তদন্তে কাজ করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রত্যেকটি অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন রেলওয়ের কয়েকজন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা। যারা ঘুরেফিরে বারবার নিয়োগ কমিটিতে থাকেন। আর তাদের কারণেই প্রতিনিয়ত যোগ্য প্রার্থীরা নিয়োগবঞ্চিত হচ্ছেন।
অভিযোগ আছে, রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারী, শ্রমিক সংগঠনের নেতা, ঠিকাদারদের একটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট নিয়োগ নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। যারা প্রার্থীদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়োগ পেতে সহযোগিতা করেন। এ সিন্ডিকেটের পছন্দের ব্যক্তিরাই থাকেন প্রতিটি নিয়োগ কমিটিতে। দীর্ঘদিন ধরে পূর্বাঞ্চলে কর্মরত থেকে এ চক্রটি দোর্দন্ড প্রতাপ দেখাচ্ছেন রেল অঙ্গনে।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক নাসির উদ্দিন আহমেদ পূর্বদেশকে বলেন, ‘যে কয়টি নিয়োগ চলমান আছে সেখানে কমিটিতে রাখার মতো এত কর্মকর্তা আমাদের নেই। এখন চলমান ছয়টি নিয়োগে কমপক্ষে ৪০ জন কর্মকর্তা লাগবে। যে কারণে একই ব্যক্তিদের নিয়োগ কমিটিতে রাখা হয়। এরপরেও আমি যেহেতু নতুন এসেছি কিছু পরিবর্তন আনবো। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে তাদের বাদ দিয়েই কমিটি করার চেষ্টা করবো। নিয়োগ নিয়ে যাতে কোনোরূপ বিশৃঙ্খলা না হয় সেদিকে নজর থাকবে।’
সূত্র জানায়, গত ৩০ জুলাই রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে ছয়টি পদে পৃথক দুটি বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। এতে ট্রেড এ্যাপ্রেন্টিস পদে ৬৭৭ জন, আয়া পদে ১১ জন, নিরাপত্তা প্রহরী পদে ৩৮ জন, পরিচ্ছন্নতা কর্মী পদে ২১৫ জন, ওয়েটিং রুম আয়া পদে দুইজন ও ল্যাম্পম্যান পদে দুইজন নিয়োগ দেওয়া হবে। এসব পদের আবেদনপত্র জমা নেয়ার শেষদিন আগামী ৫ সেপ্টেম্বর। নিয়োগ কমিটিতে ঢুকতে ইতোমধ্যে জোর তৎপরতা শুরু করেছেন অতীতে নিয়োগ নিয়ে বিতর্কিত হওয়া কয়েকজন কর্মকর্তা। বিশেষ করে ট্রেড এ্যাপ্রেন্টিস ও পরিচ্ছন্নতা কর্মী পদের নিয়োগ কমিটিতে থাকতেই বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে সিন্ডিকেটটি। পূর্বাঞ্চলের কয়েকজন প্রভাবশালী ঠিকাদার মন্ত্রী, এমপি পর্যন্ত লবিং করে তাদেরকে কমিটিতে স্থান দিতে তৎপর।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চিফ পার্সোনাল অফিসার কাজী মো. সেলিম পূর্বদেশকে বলেন, ‘ছয়টি পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান আছে। আগামী ৫ সেপ্টেম্বর আবেদন পত্র জমা দেয়ার শেষ সময়। এখনো এসব নিয়োগের কমিটি গঠন নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আবেদনপত্র জমা শেষেই কমিটি গঠন করা হবে।’
জানা যায়, গত দুই বছরে রেলওয়েতে কমপক্ষে ২০টি পদে লোকবল নিয়োগ হয়েছে। প্রত্যেকটি পদের বিপরীতে কয়েকজন কর্মকর্তা কোনো না কোনো পদে নিয়োগ কমিটিতে ছিলেন। এরমধ্যে সহকারী লোকো মাস্টার, খালাসি, ফুয়েল চেকার পদের কমিটিতে ছিলেন পূর্বাঞ্চলের প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। অফিস সহকারী, ওয়েম্যান, গেট কিপার, অফিস সহকারী পদের নিয়োগ কমিটিতে ছিলেন ডেপুটি চিফ অপারেটিং সুপারিনটেনডেন্ট জাকির হোসেন। পিয়ন, ট্রেড এ্যাপ্রেনটিস, গেট কিপার পদের নিয়োগ কমিটিতে ছিলেন সিনিয়র ওয়েলফেয়ার অফিসার আবু খালেদ চৌধুরী। সহকারী লোকো মাস্টার, ক্লিনার, গেট কিপার, খালাসি, স্টোর খালাসি পদের নিয়োগ কমিটিতে ছিলেন রেলওয়ে ট্রেনিং একাডেমির সিনিয়র ট্রেনিং অফিসার জোবেদা আক্তার। অফিস সহকারী, ট্রেড এ্যাপ্রেন্টিস, গেট কিপার, বুকিং সহকারী, সহকারী লোকো মাস্টার পদের নিয়োগ কমিটিতে ছিলেন বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা আনসার আলী। স্টেশন মাস্টার, ওয়েম্যান, ট্রেন নাম্বার টেকার, গুডস সহকারী, সুইপার পদের নিয়োগ কমিটিতে ছিলেন অতিরিক্ত চিফ অপারেটিং সুপারিনটেনডেন্ট সুজিত কুমার বিশ্বাস। এসব পদের নিয়োগের মধ্যে ওয়েম্যান, গেট কিপার, সহকারী লোকো মাস্টার, বুকিং সহকারী ও খালাসি পদের নিয়োগের অনিয়ম নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় হয় রেলে। আর অভিযোগ তীর বেশ কয়েকটি নিয়োগ কমিটিতে থাকা কয়েকজন কর্মকর্তার দিকে। ইতোমধ্যে কয়েকটি পদের নিয়োগের স্বচ্ছতা যাচাইয়ে দুদকের কাছেও অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা।
রেলওয়ে সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি মোখলেছুর রহমান পূর্বদেশকে বলেন, ঘুরেফিরে একই ব্যক্তিরা কমিটিতে আসবে কেন? রেলে এরা একটা নিয়োগ সিন্ডিকেট করেছে। কমিটি করার মালিক জিএম। বারবার যেহেতু নিয়োগের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে সেহেতু কমিটিতে সৎ মানুষদের রাখা উচিত। কয়েকটি নিয়োগ নিয়ে দুদকে মামলা হয়েছে, তদন্ত হচ্ছে। এসবে রেলের দুর্নাম বাড়ছে। তারপরেও তাদের কেন রাখা হয় জানি না। তিনি বলেন, নিয়োগ কমিটিতে টাকা-পয়সা দিয়ে ঢুকে নিয়োগ প্রত্যাশীদের কাছ থেকেই মোটা অংক হাতিয়ে নেয় এ চক্রটি। নিয়োগ কমিটিতে বারবার জোবেদা কেন? বারবার জাকির কেন? এরা ছাড়া কি রেলে অন্য লোক নেই। দুর্নীতিবাজদের বাদ দিয়ে সৎ কর্মকর্তাদের কমিটিতে রাখা উচিত। নয়তো ধরে নিতে হবে জিএম দুর্নীতিবাজদের আশ্রয় দিচ্ছেন। দুদকের তদন্তে কয়েকজন শাস্তি পেলেই হয়তো এ ধারা বন্ধ হবে।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ লুৎফুল কবির চন্দন জানান, ‘রেলের বেশ কয়েকটি নিয়োগ নিয়ে আমাদের যাচাইবাছাই চলছে। নিয়োগ অনিয়মে কারা জড়িত, নেপথ্যে কারা কাজ করেছে সব তদন্ত হচ্ছে। প্রমাণিত হলে কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না।’