রেলের কোটি কোটি টাকার খুচরা যন্ত্রাংশ ক্রয়ে ব্যাপক কারচুপি

158

রেলের কোটি কোটি টাকার খুচরা যন্ত্রাংশ কেনাকাটায় ব্যাপক কারচুপি হয়েছে। এক সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে চলছে সব কেনাকাটা। নিজস্ব ওয়ার্কশপ থাকলেও নগরীর মোগলটুলি ও মাদারবাড়ির বিভিন্ন ওয়ার্কশপে রেলের খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরি করা হচ্ছে। বিদেশি বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে খোলাবাজারের ওয়ার্কশপে তৈরির যন্ত্রাংশ। জরুরি দেখিয়ে এলটিএম পদ্ধতিতে (লিমিটেড টেন্ডার মেথড) রেলের খুচরা যন্ত্রাংশ কেনার নামে কোটি কোটি টাকার খরচ দেখানো হচ্ছে পূর্বাঞ্চল রেলে। এতে বরাদ্দের শতকার ৭৫ শতাংশ টাকা যাচ্ছে কেনাকাটায় জড়িত সিন্ডিকেটের পকেটে। পাহাড়তলী ওয়ার্কস ম্যানেজার সাইফুল ইসলামের পছন্দের চার ঠিকাদার হলেন, মোরশেদ আলম, সুভাষ, হাসান ও সালাউদ্দিন। সিন্ডিকেটের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো হলো-এসডি ট্রেডার্স, মোর্শেদ ট্রেডার্স, তাসলিমা আলম, হাসান এন্টারপ্রাইজ, তাহমিনা এন্টারপ্রাইজ, আনিছ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ও তালুকদার এন্টারপ্রাইজ। রেল কর্মকর্তা সাইফুলের বদান্যতায় ঘুরে ফিরে এ সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে পূর্বাঞ্চল রেলের খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহের ব্যবসা। ঠিকাদার মোর্শেদ ও সুভাষ একদিনে ৬০ লাখ টাকার অধিক যন্ত্রাংশ (নাটবল্টু, বগির দরজার কব্জা, হুক, ইঞ্জিন বাল্ব রিলিজ, নানা রকম জোয়ালসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ) তৈরির অর্ডার পেয়েছেন এমন নজিরও রয়েছে। এছাড়া সাইফুলের চাচাতো ভাই খন্দকার তারেকও নিয়মিত এলটিএমএ কাজ করেন ওয়ার্কশপে। তার প্রতিষ্ঠানের নাম খন্দকার বিল্ডার্স।
ঘুরেফিরে পছন্দের এ ঠিকাদার সিন্ডিকেটকে যন্ত্রাংশের চাহিদাপত্র দিচ্ছে পাহাড়তলী ওয়ার্কশপের কর্মব্যবস্থাপক (নির্মাণ) সাইফুল ইসলাম। নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্কশপে- রেলের বগির দরজায় ব্যবহৃত কব্জা, লোহার নাটবল্টু, দরজার হুকসহ নানা সামগ্রী তৈরি করা হলেও ওয়ার্কস ম্যানেজার সাইফুল আলম জানান, যন্ত্রাংশগুলো কোথায় তৈরি করা হচ্ছে তা তিনি জানেন না। অথচ এসব যন্ত্রাংশ বুঝে নেয়ার দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। অভিযোগ আছে তিনি নিজেই ঠিকাদারদের সাথে যন্ত্রাংশ কেনাকাটায় জড়িত।
টেন্ডারে অনিয়ম ও সরকারি অর্থ অপচয় রোধে ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট (ই-জিপি) টেন্ডার সিস্টেম চালু রয়েছে। কিন্তু পাহাড়তলী ওয়ার্কস ম্যানেজার সাইফুল ইসলাম জরুরি দেখিয়ে সবসময় পছন্দের ঠিকাদার দিয়ে এলটিএম পদ্ধতিতে কোটি কোটি টাকার যন্ত্রাংশ কেনাকাটা করতে পছন্দ করতেন।
রেলকর্মকর্তা সাইফুল ইসলামের দাবি- পাহাড়তলী ওয়ার্কশপে রেলের সব ধরনের যন্ত্রাংশ তৈরির মেশিন রয়েছে। কিন্তু জনবল সংকটের কারণে খোলাবাজারের ওয়ার্কশপে অদক্ষ কারিগরের তৈরি যন্ত্রাংশ রেলে ব্যবহার করছেন। তাঁর দাবি, বছরে দুইবার রেলের খুচরা যন্ত্রাংশ কেনাকাটা হয়। রেলের নানা টেন্ডার ইজিপিতে হলেও সরকারি কোষাগারের কোটি কোটি টাকা খরচে রেলে ব্যবহৃত যন্ত্রাংশ জরুরি দেখিয়ে এলটিএমের মাধ্যমে নেয়া হচ্ছে। তবে এখন থেকে ইজিপির মাধ্যমে কেনাকাটা করা হবে বলে জানিয়েছেন রেল কর্মকর্তা সাইফুল।
জরুরি দেখিয়ে (এলটিএম) কোটি কোটি টাকার খুচরা যন্ত্রাংশ কেনার বেশ কিছু নথিপত্র এ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। রেল কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বছরে দুইবার যন্ত্রাংশ কেনাকাটা করা হয় এমন দাবি করলেও প্রাপ্ত নথিপত্রে দেখা যায়, বছরে একাধিকবার কোটি কোটি টাকার যন্ত্রাংশ কেনা হয়েছে। এলটিএমের মাধ্যমে পছন্দের ঠিকাদার দিয়ে ২০১৮ সালে এক বছরে তিন কোটি ৯৭ লাখ ২৩ হাজার ১২৮ টাকার খুচরা যন্ত্রাংশ কিনেছে ওয়ার্কস ম্যানেজার। যেমন-২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে ৯০ লাখ ৯১ হাজার ২৫০টাকা। এর দুইমাস পর মার্চ মাসে ৭৪ লাখ ৫৭ হাজার ৪২০ টাকা। মে মাসে ৮১ লাখ ৬৫ হাজা১৮, জুলাই মাসে ৬৩ লাখ ৩৩ হাজার ১৯০ ও আগস্ট মাসে ৮৬ লাখ ৭৬ হাজার ২৫০ টাকার খুচরা যন্ত্রাংশ কেনা হয়েছে এলটিএমে।
এর আগে ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে ৩৭ লাখ ৬৬ হাজার টাকার খুচরা যন্ত্রাংশ ক্রয় করা হয়। এভাবে সারাবছরই চলছে কেনাকাটা। এরমধ্যে বেশিরভাগ অর্ডার দেয়া হয়েছে মোর্শেদ- সুভাষ সিন্ডিকেটকে। যেমন ২০১৮সালের ১৫ মে মোর্শেদের দুটি লাইসেন্স মোর্শেদ এন্টারপ্রাইজ ও তার স্ত্রীর নামে করা লাইসেন্স তাসলিমা আলমের অনুকূলে একদিনে ৬১ লাখ ৪৮ হাজার ৩০০ টাকার খুচরা যন্ত্রাংশের অর্ডার দেয়া হয়েছে। বিপুল পরিমাণ অর্থে কি ধরনের যন্ত্রাংশ তৈরি করেছেন তা মনে নেই বলে জানান ঠিকাদার মোর্শেদ আলম।
রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, নিয়ম অনুযায়ী রেলের ব্যবহৃত পণ্য কেনার পর স্টোরে মজুদ করার কথা। স্টোরে দায়িত্বরত কর্মকর্তা পণ্যের গুনগত মান পরিদর্শন করে মজুদ করবেন। পরবর্তীতে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করবেন। কিন্তু সরকারি কোষাগারের বিপুল অর্থ ব্যয়ে খোলাবাজারে তৈরি এসব যন্ত্রাংশ স্টোর রুমে রাখা কিংবা গুনগত মান নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।
মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে ঠিকাদার মোর্শেদ আলম প্রথমে কোন কিছুই না জানার ভান করেন। পরে একদিনে ৬০ লাখ টাকার অধিক যন্ত্রাংশের অর্ডার পাওয়ায় কথা জানতে চাইলে নিজে ও স্ত্রীর নামে দুটি লাইসেন্সে দশ বছরের অধিক সময় ধরে রেলের খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহ করছেন বলে জানান। তিনি বলেন, পাহাড়তলী ওয়ার্কশপে বিগত দশ/বারো বছরের মধ্যে কোন যন্ত্রাংশ তৈরি হয়নি। ওয়ার্কশপে কাজ হয় না বললেই চলে। নগরীর মাদারবাড়ি ও মোগলটুলির ওয়ার্কশপে কারিগর দিয়ে রেলের খুচরা যন্ত্রাংশ আমরা তৈরি করি। জুবলি রোডে কিছু লোকাল ওয়ার্কশপে তৈরি করা হয়।
চারজনের সিন্ডিকেট প্রসঙ্গে মোর্শেদ বলেন, যারা সব সময় মালামাল দেয় তাদের বেশি বেশি অর্ডার দেয়া হয়। এলটিএমে বেশি অর্ডার দেয়া হয়। কারণ রেলের ক্রাইসিস মৌসুম থাকে। আমি লোকাল ওয়ার্কশপ থেকে রেলের যন্ত্রাংশ আগেভাগে তৈরি করে রাখি। কারণ আমি বুঝি কখন কি লাগবে। তাই রেলের কর্মকর্তারা আমাকে কাজ দেন। রেলে ৫৬ হাজার আইটেম আছে। একেক স্থানে একেক রকম লাগে। তারা স্যাম্পল দেয় আমরা তৈরি করে দিই। পনেরো বছরের অধিক সময় ধরে ওয়ার্কশপে এভাবে ঠিকাদারি করেন বলে দাবি করেন মোর্শেদ।
দিনে কোটি টাকার অর্ডার প্রসঙ্গে মোর্শেদ বলেন, বছরে দুইবারের বেশি টেন্ডার করতে পারে না রেল। তাই একসাথে দিয়ে দেয়। কোটি কোটি টাকার কি ধরনের যন্ত্রাংশ রেলে সরবরাহ করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না। পরক্ষণে ঠিকাদার মোর্শেদ বলেন. আপনি এসব তথ্য কোথায় পেলেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুর্বাঞ্চল রেলের অতিরিক্ত প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (পরিদর্শন) প্রকৌশলী আনোয়ারুল ইসলাম জানান, ওপেন টেন্ডার ও প্রকল্পের জিনিসপত্র পরিদর্শক দেখে থাকেন। কিন্তু ওয়ার্কস ম্যানেজারের যন্ত্রাংশ কেনাকাটার এখতিয়ার নেই। জরুরিভিত্তিতে কোন যন্ত্রাংশ কিনতে হলে স্টোর বিভাগ থেকে ‘স্টক আউট সার্টিফিকেট’ নিতে হবে। স্টোরের অনুমতি সাপেক্ষে ওয়ার্কস ম্যানেজার বাজেটের ২০ শতাংশ পণ্য কিনতে পারেন। তবে জরুরি দেখিয়ে ওয়ার্কস ম্যানেজার যে সব পণ্য কিনেন তা স্টোরে নেয়া হয় না। সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রণ বিভাগের কর্মকর্তারা এ যন্ত্রাংশ পরিদর্শনও করেন না। নিজেই সব পণ্য বুঝে নেয়ার দায়িত্ব পালন করেন। যার কারণে এলটিএম পদ্ধতিতে যেসব যন্ত্রাংশ কেনা হচ্ছে সে সম্পর্কে আমার কোন ধারণা নেই।