রেলকেন্দ্রিক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার বাড়ছেই

85

ষোলশহর স্টেশনে কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনতে শুনতে রেললাইনের উপর দিয়ে হাঁটছিলেন হযরত আলী স্বাধীন নামে এক ব্যক্তি। এসময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শহরে যাচ্ছিল একটি ডেমু ট্রেন। ট্রেনটি বার বার হুইসেল দিলেও কানে হেডফোন থাকায় শুনতে পাননি তিনি। এক পর্যায়ে ট্রেনে কাটা পড়ে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়েছে তার। গত শনিবার এ ঘটনা ঘটে।
ঢাকার আশকোনা ও কাওলার মধ্যবর্তী রেললাইনে ট্রেনে কাটা পড়ে মাহবুব আলম বুলু (৪৮) নামে এক সাব-রেজিস্ট্রারের মৃত্যু হয়েছে। গত শুক্রবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। তিনি ডেমরার সাব-রেজিস্ট্রার ছিলেন। তবে তার মৃত্যু রহস্যজনক বলে পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে।
গত বছরের ১২ ডিসেম্বর পাহাড়তলী রেলক্রসিং এলাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে ইব্রাহীম শেখ নামে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের এক কর্মচারী মারা গেছেন। রেললাইন পার হওয়ার সময় অসাবধানতাবশত তার পা আটকে যায়। এ সময় চাঁদপুর থেকে চট্টগ্রামে আসা মেঘনা এক্সপ্রেস ট্রেনে কাটা পড়ে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
গত বছরের ২৮ অক্টোবর সীতাকুন্ডের ভাটিয়ারি মাদামবিবিরহাট এলকায় ট্রেনে কাটা পড়ে স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানসহ একই পরিবারের তিনজনের মৃত্যু হয়। ৮ আগস্ট ষোলোশহর রেলস্টেশনে শাটল ট্রেনে কাটা পড়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র রবিউল আলমের দুই পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ৩০ জুলাই সীতাকুন্ডের কুমিরা এলাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যান আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কাজী সিরাত। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে আসার সময় একটি এক্সপ্রেস ট্রেনের ছাদে খেলা করার সময় তিন শিশু পড়ে গিয়ে মারা যায়।
এভাবে নানান দুর্ঘটনায় রেললাইনে প্রতিনিয়তই মানুষ মারা যাচ্ছেন। এনিয়ে গত এক বছরে পূর্বাঞ্চল রেলওয়েতে মারা গেছেন প্রায় ৮শ’ জন। শুধু জানুয়ারিতেই মারা গেছেন ২৮ জন। নিহতদের মধ্যে আইন- শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, ছাত্র থেকে শুরু করে তরুণ, যুবা এবং বৃদ্ধ-বৃদ্ধাও রয়েছেন।
সূত্র জানায়, মহাসড়কের পাশাপাশি রেলপথেও মৃত্যুর মিছিল বেড়েই চলেছে। কোনোভাবেই এ মৃত্যু রোধ করা যাচ্ছে না। কঠোর আইনেও কিছুই হচ্ছে না। আইন অমান্য করে রেললাইন ধরে হাঁটার কারণে মৃত্যুর হারও বাড়ছে বলে জানিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
বাহন হিসেবে রেল নিরাপদ হলেও সাধারণ মানুষের কাছে রেলপথ ক্রমশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। বিশেষ করে রেলকেন্দ্রিক মৃত্যুর হার বেড়েই চলেছে।
রেল সূত্রে জানা যায়, নারী-পুরুষ-শিশু সহ সকল বয়সি লোকেরাই মৃত্যুবরণ করছে। আবার কেউ কেউ আত্মহত্যাও করছে। হত্যাকান্ডের ঘটনাও ঘটছে।
যাত্রীদের তাড়াহুড়োর পাশাপাশি আইন না মানার প্রবণতাই রেল দুর্ঘটনার মূল কারণ বলে মনে করছেন চট্টগ্রাম জিআরপি থানার অফিসার ইনচার্জ মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, যখনই একটি ট্রেন আসে, সেই ট্রেনে ওঠার জন্য যাত্রীদের মধ্যে হুড়োহুড়ি দেখা যায়। রেল দুর্ঘটনায় বিচারের নজির খুব কম। শুধুমাত্র পুলিশের পক্ষ থেকে একটি অপমৃত্যু মামলা করা হয়। আইনের বাধ্যবাধকতার কারণে পরবর্তী সময়ে এসব মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, অবৈধ রেল ক্রসিং রয়েছে শত শত। এগুলো সবসময় খোলা থাকে। অনুমোদন না থাকায় গেটম্যানও থাকে না। ট্রেন আসার সময়ও লোকজন জীবনের ঝুঁকে নিয়ে পারাপার করেন। এমনকি গাড়িও পার হয়। এতে দুর্ঘটনা ঘটে এবং প্রাণহানি হয়। রেলপথ ধরে লোকজন হাঁটেন। রেলগেটের নিরাপত্তা বার ফেলার পরও দৌড়ে পার হয় অনেকেই, কেউ কেউ মোটরসাইকেল চালিয়েও যান এপাশ থেকে ওপাশে। একারণে দুর্ঘটনার শিকার হন লোকজন।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ট্রেনের ইঞ্জিনের শব্দ কম, দ্রæতগতিতে চলে এবং অল্প দূরত্বে থামতে পারে না। এজন্য দুর্ঘটনা ঘটে। আর মুঠোফোনে ব্যস্ত থাকলে এ দুর্ঘটনার আশঙ্কা আরো বেড়ে যায়।
রেল সূত্র জানায়, সারাদেশের রেলপথের দুই পাশে ১০ ফুট করে ২০ ফুট এলাকায় সবসময় ১৪৪ ধারা জারি থাকে। বাংলাদেশ রেলওয়ে আইনানুযায়ী ওই সীমানার ভেতর কাউকে পাওয়া গেলে তাকে আইনের ১০১ ধারায় গ্রেপ্তার করা যায়। এমনকি এই সীমানার ভেতরে গবাদিপশু চরালে আটক করে তা বিক্রি করে সেই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা দেওয়ার বিধানও রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আইনের ধারা-বিধান বই-নথিতেই লিপিবদ্ধ থাকে, সেগুলোর প্রয়োগ হয় না। প্রয়োগ করতে গেলে রেলওয়ে পুলিশকে মুখোমুখি হতে হয় নানা বিব্রতকর পরিস্থিতি ও উটকো ঝামেলার।
রেলওয়ের মহাপরিচালক কাজী মো. রফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, অসচেতনতার পাশাপাশি রেললাইনের দু’পাশে বস্তিও মানুষের আনাগোনা থাকায় এসব দুর্ঘটনা ঘটছে। তিনি বলেন, সচেতনতা সৃষ্টিতে নানা পদক্ষেপ নিয়েও আশানুরূপ ফল মিলছে না। লিফলেট বিতরণ, উঠান বৈঠক ও মাইকিং করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, রেললাইনের দু’পাশে ১০ ফুট করে ২০ ফুট এলাকায় মানুষের প্রবেশ আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। এমন কী, ২০ ফুটের মধ্যে কোনো গবাদিপশু প্রবেশ করলেও তা আটক করে বিক্রির নিয়ম রয়েছে। তবে এই আইনের প্রয়োগ কখনো দেখা যায়নি।
দেখা যায়, রেললাইনের দু’পাশে বস্তি ও দোকান নির্মাণ করে রাখা হয়েছে। রেললাইনের আশপাশে অবৈধ স্থাপনা, বসতি, বস্তি উচ্ছেদ করা হয় বার বার। কিন্তু ছিন্নমূল মানুষ ফের আশ্রয় নেয় রেললাইনের পাশেই। ফলে এসব ঝুঁকিপূর্ণ বসতি রেললাইনে মৃত্যুর হার বাড়াচ্ছে। এ ছাড়া সিগন্যাল না মেনে ক্রসিং পার হওয়ার মতো নাগরিক অসদাচরণও দুর্ঘটনার পেছনে ভূমিকা রাখছে।
রেললাইনে হাঁটার সময় হেডফোন লাগিয়ে গান শুনে অনেকে। ট্রেন আসার শব্দ শুনতে পায় না তারা। এটি মৃত্যুর অন্যতম একটি কারণ।
সিআরবি থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মানুষ সচতেন বলে র্দুঘটনার হার অনেক কমবে। সরকারি আইন মেনে চললে মৃত্যুর সংখ্যা হ্রাস পাবে। ট্রেন লাইনের পাশ দিয়ে না হাঁটা, ট্রেন আাসার সময় পার না হওয়া, কানে হেডফোন লাগিয়ে চলাচল না করাও দুর্ঘটনা রোধ করতে পারে।
ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে অহরহ। পারিবারিক কলহ, প্রেমে ব্যর্থতাসহ নানা কারণে আত্মহত্যা করে অনেকে।
হত্যাকান্ডের ঘটনাও কম নয়। অনেকে রেললাইনে ট্রেনের নিচে ফেলে লোকজনকে হত্যা করা হয়। এধরনের হত্যাকান্ডের রহস্য সহজে উন্মোচিত হয় না। দুর্ঘটনা হিসেবেই চালিয়ে দেয়া হয়।