রেলওয়েতে সুরক্ষা সামগ্রী কেনা নিয়ে ‘তামাশা’

380

করোনা প্রতিরোধে মানসম্মত সুরক্ষা সামগ্রী যৌক্তিক মূল্যে ক্রয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে সকল বিভাগীয় প্রধানদের চিঠি দিয়েছিলেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক। গত ১০ জুন দেয়া সেই চিঠিতে নিম্নমানের সুরক্ষা সামগ্রী সংগ্রহ এবং বাজারের দরের চেয়ে অতিরিক্ত মূল্যে এসব সামগ্রী সংগ্রহের অভিযোগ উত্থাপনের কথা বলা হয়। সমস্ত বিধি বিধান মেনে মানসম্মত সুরক্ষা সামগ্রী বাজার দরের ভিত্তিতে যৌক্তিক মূল্যে ক্রয় নিশ্চিত করতে বিভাগীয় কর্মকর্তাদের অনুরোধ করেছিলেন জিএম সরদার সাহদাত আলী।
জানা যায়, পূর্ব রেল জিএমের এমন অনুরোধেও কর্ণপাত করেনি সুরক্ষা সামগ্রী ক্রয়ে জড়িত থাকা কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা। বাজার দরের চেয়ে অধিক মূল্যে দেয়া নিম্নমানের সুরক্ষা সামগ্রী ক্রয়ে উল্টো ঠিকাদারকে সহযোগিতা করেছেন।
অভিযোগ উঠেছে, সুরক্ষাসামগ্রী সরবরাহ করা ঠিকাদারের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়েই অধিক মূল্য দেখিয়ে কেনা হয়েছে এসব সামগ্রী। যার বেশিরভাগই ব্যবহার অনুপযোগী। জুন মাসে বিল আদায়ের লক্ষ্যে কম দামের সুরক্ষা সামগ্রী বেশি দাম দেখিয়ে দ্রুত সরবরাহ করলেও বিল পেতেও হিমশিম খাচ্ছেন কয়েকজন ঠিকাদার।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) সরদার সাহদাত আলী পূর্বদেশকে বলেন, ‘শুধু সুরক্ষা সামগ্রী নয়, সবকিছু ক্রয়ের ক্ষেত্রে সততা বজায় রাখতে বলা হয়েছে। এখনতো সুরক্ষা সামগ্রী কেনাকাটা হচ্ছে না। যা কেনার কিনে ফেলেছে আগে। এরপরেও কোন জায়গায় দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে চেক করে দেখবো। এগুলো যাচাই বাছাইয়ে কমিটি আছে। তারাই মূল্য নির্ধারণ করে। বিষয়টি আমি খোঁজ নিচ্ছি।’
রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে আলাপকালে জানা যায়, ঠিকাদারদের অসঙ্গতিপূর্ণ ও অযৌক্তিক দর দেখানো সুরক্ষা সামগ্রী ক্রয়ের বিল দেখেই তা আটকে দিয়েছেন পূর্বাঞ্চলের অর্থ উপদেষ্টা ও প্রধান হিসাব অধিকর্তা। এখন ওই কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে বিল ছাড়িয়ে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন কয়েকজন সুরক্ষা সামগ্রী ক্রয়ে জড়িত থাকা কর্মকর্তা ও ঠিকাদাররা। কিন্তু অর্থ উপদেষ্টা কোনভাবেই এসব বিল ছাড় দিচ্ছেন না। উল্টো অযৌক্তিক দাম কমাতে ঠিকাদারদের চাপ দিয়েছেন। এ সুরক্ষা সামগ্রীগুলো ক্রয়ে বড় ধরনের আর্থিক লেনদেন ঘটেছে বলেও জানান রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের অর্থ উপদেষ্টা ও প্রধান হিসাব অধিকর্তা কামরুন নাহার পূর্বদেশকে বলেন, আমি কোন নির্দিষ্ট ঠিকাদারের নামও দেখি না। চিনিও না। শুধুমাত্র দামটা দেখি। এর মধ্যে যে কমিটিগুলোতে আমি আছি সেখানে আমি কিছু আপত্তি তুলেছি। যেখানে রেটগুলো আমার বেশি মনে হয়েছে সেগুলো আমি ছাড় দিই নাই। অক্সিজেনের দাম অনেক বেশি দিয়েছিল, তা আমি কমিয়েছি। যতটুকু পারছি আমি করছি। একজনে কতটুকু করা যায়। কিছু কিছু জিনিসের দাম কমেছে। যেমন অক্সিজেনের দাম দিয়েছিল প্রতিটা ৫৮ হাজার টাকা। এখন তা ৪১ হাজারে এনেছি। মাস্কের দাম দিয়েছিল ৩৫০ টাকার উপরে। সেগুলো আমি বলার পর কমিয়ে ৩২০ করে দিয়েছে। আমি তারপরেও বলেছি যারা ব্যবহার করবে তারা কি বলে তা দেখতে হবে। যে কারণে কিছু বিলে স্বাক্ষর করি নাই। বলেছি সবগুলোর দাম কমাতে হবে।’
সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহ করা এক ঠিকাদার বলেন, ‘আমি কিছু সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহ করেছি। তা নিয়ে আপত্তি দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা। এখন সেগুলো আমি ঠিক করে দিচ্ছি। এসব সামগ্রী দিয়ে কোন লাভ হয়নি।’
সূত্রগুলো জানায়, নিরাপত্তা বিভাগ, বাণিজ্যিক বিভাগ ও পরিবহন বিভাগেই সবচেয়ে বেশি সুরক্ষা সামগ্রী কেনা হয়েছে। লিমিটেড টেন্ডারিং ম্যাথডের (এলটিএম) পদ্ধতিতে এসব সুরক্ষা সামগ্রী ক্রয় করা হয়। প্রতিটি বিভাগ জরুরী প্রয়োজনে এসব সুরক্ষা সামগ্রী চেয়ে চাহিদা পত্র দিলে প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (সিসিএস) ও পূর্বাঞ্চল সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (সিওএস) কার্যালয় এসব সামগ্রী ঠিকাদারদের মাধ্যমে সরবরাহ করেন। নির্দিষ্ট দপ্তরের অনুমোদন সাপেক্ষে সুরক্ষা সামগ্রীর বিল প্রদান করার কথা নিজ নিজ বিভাগের। কিন্তু নিম্নমানের সামগ্রী দেয়া নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে নড়েচড়ে বসে রেল প্রশাসন।
রেলওয়ের দুইজন কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘কর্মকর্তারা যেসব সুরক্ষা সামগ্রী নিয়েছেন তা কিছুটা মান থাকলেও কর্মচারীদের দেয়া হয়েছে নিম্নমানের সুরক্ষা সামগ্রী। বাজারের নিম্নমানের স্যানিটাইজার দেয়া হয়েছে। প্রতিটি বিভাগের সব সামগ্রী দেখলেই যে কেউ বুঝবে পণ্যগুলোর মান কতটা খারাপ। কোথাও কোথাও কেএন৯৫ মাস্কের পরিবর্তে কাপড়ের মাস্ক দেয়া হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন এগুলো তদন্ত করলেই প্রমাণ পাবে।’
চাহিদাপত্র অনুসারে কি পরিমাণ সুরক্ষা সামগ্রী কেনা হয়েছে জানতে প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (সিসিএস) রুহুল কাদের আজাদের মুঠোফোনে বেশ কয়েকবার ফোন দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। গত ৭ জুলাই রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (সিওএস) প্রকৌশলী মো. বেলাল হোসেন সরকারের দপ্তরে গেলে তিনি সাংবাদিকদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। এসময় তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। বলেন, আমি কোনধরনের সুরক্ষা সামগ্রী ক্রয় করি নাই। এতগুলো সুরক্ষা সামগ্রী তাহলে কারা কিনলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, সবই তো জানেন আমাকে প্রশ্ন করছেন কেন?
পরে মুঠোফোনে জানতে চাইলে রেলওয়ে সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (পূর্বাঞ্চল) কার্যালয়ের সহকারী সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (সদর) মো. এমদাদুর রহমান পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমরা কোন সুরক্ষা সামগ্রী ক্রয় করি নাই। কারা কিনেছেন জানি না। সাধারণত কিছু কিনতে হলে আমাদের কাছে চাহিদা পত্র দিতে হয়। কিন্তু এগুলো আমাদের কাছে আসেনি। হয়তো অফিস বন্ধ থাকায় আমাদের কাছে আনতে পারেনি।