রেজাউল করীম (১৯০২-১৯৯৩)

49

শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, অনুবাদক। পুরো নাম রেজাউল করীম মুহম্মদ জওয়াদ। জন্ম বীরভূম জেলার রামপুরহাট থানার শাসপুর গ্রামে, ১ জুলাই ১৯০২। পিতা হাজী আবদুল হামিদ, মাতা জারিয়া খাতুন।
রেজাউল করীমের প্রাথমিক শিক্ষা নিজ গ্রামে, কামালুদ্দিন মিয়ার পাঠশালা ও অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল মিডল স্কুলে। পরে কলকাতা মাদ্রাসা থেকে ম্যাট্রিক (১৯২০), কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে আইএ (১৯২৮) এবং ইংরেজিতে অনার্সসহ বিএ (১৯৩০) পাশ করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ (১৯৩৪) ও ‘ল’ ডিগ্রি (১৯৩৬) লাভ করে ব্যাঙ্কশাল কোর্ট, আলিপুর কোর্ট ও বহরমপুর কোর্টে ওকালতি করেন। ১৯৪৭ সালে তিনি ওকালতি ছেড়ে বহরমপুর গার্লস কলেজে অধ্যাপক পদে যোগদান (১৯৪৭) করেন। এ কলেজ থেকেই তিনি ১৯৮২ সালে অবসর গ্রহণ করেন। ইতোমধ্যে রেজাউল করীম রাজনীতিতে যোগদান করেন। ১৯৩০ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত সা¤প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টির চেষ্টা করেন। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভারতীয় রাজনৈতিক পরিবেশ সা¤প্রদায়িকতায় আচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। ১৯৩৭ সালের নির্বাচন হয়েছিল সা¤প্রদায়িক ভিত্তিতে যার বিপক্ষে ছিলেন রেজাউল করীম। সা¤প্রদায়িক রাজনীতি মোকাবিলা করার জন্য রেজাউল করীম অগ্রজ মঈনুদ্দিন হোসায়নের সঙ্গে মিলিতভাবে প্রতিষ্ঠা করেন ‘অ্যান্টি সেপারেট ইলেক্টরেট লীগ’। এ লীগের সভাপতি ছিলেন রেজাউল করীমের মামা বহরমপুরের আইনজীবী আবদুস সামাদ এবং সম্পাদক ছিলেন মঈনুদ্দিন হোসায়েন। জীবনের দীর্ঘসময় তিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, কিন্তু তার আবিলতা তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। গোষ্ঠীগত কিংবা মতাদর্শগত রাজনীতি তিনি পরিহার করে চলেন। তিনি একদিকে গান্ধী ও আবুল কালাম আজাদ-এর রাজনীতির প্রশংসা করেছেন। অপরদিকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে আলোচনা করেছেন লেনিনের নেতৃত্ব। শোষিত, বঞ্চিত ও লাঞ্ছিত মানুষের কল্যাণে তাঁর রাজনীতি উদ্বুদ্ধ। এ লক্ষ্যে তিনি তুর্কীবীর কামাল পাশা গ্রন্থ লিখে প্রচার করেন। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উজ্জীবনে তিনি ১৯৩৮ সালে দূরবীন নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। এ পত্রিকায় তিনি এ মত প্রচার করেন যে, হিন্দু-মুসলিম অবিভাজ্য একটি জাতি, দ্বিজাতিতত্তে¡র ধারণা একটি সাময়িক বিভ্রান্তি মাত্র। এ সময়ে তিনি লেখেন ‘বঙ্কিমচন্দ্রের নিকট মুসলমানদের ঋণ’ প্রবন্ধ। এ প্রবন্ধ লেখার জন্য তিনি মুসলিম লীগ ও অন্যান্য মৌলবাদী সংগঠন প্রভাবিত মুসলিম সমাজ কর্তৃক নিন্দিত ও লাঞ্ছিত হয়েছিলেন। অসা¤প্রদায়িক চেতনা তাঁর রাজনীতির এক উল্লেখযোগ্য দিক।
সাহিত্যের প্রতি রেজাউল করীমের আকর্ষণ ছিল আকৈশোর। পারস্যের শ্রেষ্ঠ কবি-সাহিত্যিকদের রচনাবলির সঙ্গে তাঁর পরিবারের আগ্রহ ছিল। রুমী, সাদী, হাফেজ, ওমর খৈয়ম প্রমুখ কবি-সাহিত্যিক ও গুণী-জ্ঞানীদের রচনা নিয়ে তাঁর পরিবারে আলোচনা হতো। পারিবারিক আবহে সাহিত্যের প্রতি রেজাউল করীমের অনুরাগ জন্মে। তিনি ১৯২৫ সালে সৌরভ নামে একটি মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করেন। দেখা যায়, সাহিত্য অনুরাগের এ পর্বে রেজাউল করীম ইসলামের অতীত গৌরবে মুগ্ধ ছিলেন। তাঁর এ সময়ের কিছু কবিতা ও গদ্য রচনায় এ কথার প্রমাণ মেলে। তবে ঞযড়সধং চধরহব (১৭৩৭-১৮০৯)-এর অমব ড়ভ জবধংড়হ (১৭৯৪-৯৬), ঞযব জরমযঃ ড়ভ গধহ (১৭৯১-৯২) প্রভৃতি গ্রন্থ পড়ে তাঁর মধ্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। স¤প্রদায়নিরপেক্ষ মানুষের অধিকার, বৈপ্লবিক চিন্তাধারা, সত্যপ্রীতি, যুক্তিবাদ প্রভৃতি বিষয়ে রেজাউল করীম আকৃষ্ট হন। পরবর্তীকালে রচিত দুটি প্রবন্ধে তিনি টমাস পেনকে ‘মানববন্ধু’ বলে উল্লেখ করেন। রেজাউল করীমের ফরাসী বিপ্লব (১৯৩৩), নয়া ভারতের ভিত্তি (১৯৩৫) এবং ঋড়ৎ ওহফরধ ধহফ ওংষধস (১৯৩৭) গ্রন্থ তিনটিতে তাঁর উল্লিখিত মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়।
সংস্কৃতি সমন্বয়ের ভাবনা ও সাহিত্য সাধনায় নিষ্ঠার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৮৪ সালে রেজাউল করীমকে সম্মান সূচক ডিলিট ডিগ্রি প্রদান করে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ১৯৯১ সালে তাঁকে বিদ্যাসাগর স্মৃতি পুরস্কার প্রদান করে। ১৯৯৩ সালের ৫ নভেম্বর তার মৃত্যু হয়। সূত্র : ইন্টারনেট